১২:৩৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-২৭)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:৫৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ অক্টোবর ২০২৪
  • 19

আমার মা

আমাদের মাত্র দুইটি গাভী ছিল। সেই গাভী দুইটির গোবর মা শুকাইয়া রাখিতেন। বাড়ির চারিধারে ছিল অগুনতি বীজেকলার ঝাড়। তাহারই পাতা শুকাইলে তাকে বলিত ফাতরা, সেই ফাতরা কুড়াইয়া মা রান্নাবান্না করিতেন। গোবরের ঘসিগুলি বর্ষাকালের জন্য বাঁচাইয়া

রাখিতেন। সেইজন্য আমার আনা সেই সামান্য উপহার মায়ের কাছে কম ছিল না। আমাদের আশেপাশের চাষিদের প্রত্যেকের বাড়িতে অনেক গরু থাকিত। সেইসব গরুর গোবর শুকাইয়া চাষি-বউরা রান্নাবান্না করিত। তা ছাড়া পাটের মৌসুমে তাদের স্বামীরা ভারা ভারা পাট-খড়ি আনিয়া বাড়ির চারিদিকে দেয়াল করিয়া ফেলিত। সারাক্ষণ তাহারা সেই পাট-খড়ি জ্বালাইয়া মজা করিয়া রান্নাবান্না করিয়া আমাদের বাড়িতে গল্প করিতে আসিত। মা তখন চুলার মধ্যে ঘসি পুরিয়া জ্বালাইবার জন্য ব্যর্থ ফুঁ পাড়িতেছেন। সেই ঘসিও কি মা বেশি করিয়া সংগ্রহ করিতে পারিতেন।

আমাদের ঢেঁকিঘরের চাল দিয়া প্রায়ই বৃষ্টির পানি পড়িত। সেই ঘরের অর্ধেকখানিতে অল্পপরিসর স্থানে ছিল মায়ের আখা জ্বালানোর অমূল্য সম্পদ। তাও কিছু কিছু বৃষ্টিতে ভিজিয়া যাইত। বৃষ্টির দিনে রান্নাঘরে আসিয়া মা কাঁদিয়া অস্থির হইতেন। মা চিৎকার করিয়া বলিতেন, আমার এই রাক্ষসগুলো যদি খাইতে না চাহিত তবে কোন বাপের বেটি আর রান্নাঘরে ঢুকিত। এই রাক্ষস ছেলেদের জন্য মা যে কত আত্মত্যাগ করিয়াছেন দুনিয়ার ইতিহাসে কোনো মা-ই তাহা করে নাই। সেই রাক্ষস ছেলেরা মায়ের সেই আত্মত্যাগ তখন কেহই বুঝিতে পারিত না।

আমাদের অভাবের সংসারে ভালো কিছু রান্না করিয়া খাওয়াইবার ক্ষমতা মার ছিল না। প্রতিদিন বাজারে যাইয়া মাছ তরিতরকারি কিনিবার অর্থ আমার পিতার ছিল না। আমাদের গ্রামের কাহারও ছিল না। কিন্তু বাড়ির ধারে এই পদ্মার খাল থাকায় গ্রামের লোকেরা অবসর সময়ে নদী হইতে মাছ ধরিয়া আনিত। আমার পিতার মাছ ধরিবার শখ কোনোদিনও ছিল না। আর অবসরও ছিল না। শুধুমাত্র রবিবার আর বুধবারের হাটের দিনে বাজান হাট হইতে মাছ কিনিয়া আনিতেন। কোনো কোনো হাটে তিনি যাইতেও পারিতেন না। আমাদের প্রতিবেশীরা যদি কখনও কখনও বেশি মাছ মারিত, তার কিছুটা আমাদের দিয়া যাইত। সপ্তাহে পাঁচ-ছয়দিন মা শুধু ডাল-ভাতই করিতেন। যেদিন শাক রান্না করিতেন সেদিন আর ডাল হইত না।

আমাদের অবস্থা যে খারাপ তাহা বুঝিবার ক্ষমতা আমার তখনও হয় নাই। প্রতিদিন ডাল খাইতে খাইতে পেটে আগুন জ্বলিত। দুপুরবেলা পর্যন্ত এখানে-সেখানে খেলিয়া ক্ষুধায় যখন থাকিতে পারিতাম না, তখন বাড়ি আসিয়া মাকে জিজ্ঞাসা করিতাম, মা আজ কি রাঁধিয়াছ? মা বলিত, ডাল রাঁধিয়াছি। তখন রাগে আমি পাগল হইয়া যাইতাম। ভাতের হাঁড়ি ডালের হাঁড়ি ভাঙিয়া একাকার করিয়া দিতাম। আর গ্রাম্য চাষিছেলেদের কাছে শেখা ইতর গালিগালাজে মাকে বকিয়া অস্থির করিতাম। মা মারিতে আসিলে ছুটিয়া পালাইতাম।

চলবে…

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-২৭)

১১:০০:৫৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১ অক্টোবর ২০২৪

আমার মা

আমাদের মাত্র দুইটি গাভী ছিল। সেই গাভী দুইটির গোবর মা শুকাইয়া রাখিতেন। বাড়ির চারিধারে ছিল অগুনতি বীজেকলার ঝাড়। তাহারই পাতা শুকাইলে তাকে বলিত ফাতরা, সেই ফাতরা কুড়াইয়া মা রান্নাবান্না করিতেন। গোবরের ঘসিগুলি বর্ষাকালের জন্য বাঁচাইয়া

রাখিতেন। সেইজন্য আমার আনা সেই সামান্য উপহার মায়ের কাছে কম ছিল না। আমাদের আশেপাশের চাষিদের প্রত্যেকের বাড়িতে অনেক গরু থাকিত। সেইসব গরুর গোবর শুকাইয়া চাষি-বউরা রান্নাবান্না করিত। তা ছাড়া পাটের মৌসুমে তাদের স্বামীরা ভারা ভারা পাট-খড়ি আনিয়া বাড়ির চারিদিকে দেয়াল করিয়া ফেলিত। সারাক্ষণ তাহারা সেই পাট-খড়ি জ্বালাইয়া মজা করিয়া রান্নাবান্না করিয়া আমাদের বাড়িতে গল্প করিতে আসিত। মা তখন চুলার মধ্যে ঘসি পুরিয়া জ্বালাইবার জন্য ব্যর্থ ফুঁ পাড়িতেছেন। সেই ঘসিও কি মা বেশি করিয়া সংগ্রহ করিতে পারিতেন।

আমাদের ঢেঁকিঘরের চাল দিয়া প্রায়ই বৃষ্টির পানি পড়িত। সেই ঘরের অর্ধেকখানিতে অল্পপরিসর স্থানে ছিল মায়ের আখা জ্বালানোর অমূল্য সম্পদ। তাও কিছু কিছু বৃষ্টিতে ভিজিয়া যাইত। বৃষ্টির দিনে রান্নাঘরে আসিয়া মা কাঁদিয়া অস্থির হইতেন। মা চিৎকার করিয়া বলিতেন, আমার এই রাক্ষসগুলো যদি খাইতে না চাহিত তবে কোন বাপের বেটি আর রান্নাঘরে ঢুকিত। এই রাক্ষস ছেলেদের জন্য মা যে কত আত্মত্যাগ করিয়াছেন দুনিয়ার ইতিহাসে কোনো মা-ই তাহা করে নাই। সেই রাক্ষস ছেলেরা মায়ের সেই আত্মত্যাগ তখন কেহই বুঝিতে পারিত না।

আমাদের অভাবের সংসারে ভালো কিছু রান্না করিয়া খাওয়াইবার ক্ষমতা মার ছিল না। প্রতিদিন বাজারে যাইয়া মাছ তরিতরকারি কিনিবার অর্থ আমার পিতার ছিল না। আমাদের গ্রামের কাহারও ছিল না। কিন্তু বাড়ির ধারে এই পদ্মার খাল থাকায় গ্রামের লোকেরা অবসর সময়ে নদী হইতে মাছ ধরিয়া আনিত। আমার পিতার মাছ ধরিবার শখ কোনোদিনও ছিল না। আর অবসরও ছিল না। শুধুমাত্র রবিবার আর বুধবারের হাটের দিনে বাজান হাট হইতে মাছ কিনিয়া আনিতেন। কোনো কোনো হাটে তিনি যাইতেও পারিতেন না। আমাদের প্রতিবেশীরা যদি কখনও কখনও বেশি মাছ মারিত, তার কিছুটা আমাদের দিয়া যাইত। সপ্তাহে পাঁচ-ছয়দিন মা শুধু ডাল-ভাতই করিতেন। যেদিন শাক রান্না করিতেন সেদিন আর ডাল হইত না।

আমাদের অবস্থা যে খারাপ তাহা বুঝিবার ক্ষমতা আমার তখনও হয় নাই। প্রতিদিন ডাল খাইতে খাইতে পেটে আগুন জ্বলিত। দুপুরবেলা পর্যন্ত এখানে-সেখানে খেলিয়া ক্ষুধায় যখন থাকিতে পারিতাম না, তখন বাড়ি আসিয়া মাকে জিজ্ঞাসা করিতাম, মা আজ কি রাঁধিয়াছ? মা বলিত, ডাল রাঁধিয়াছি। তখন রাগে আমি পাগল হইয়া যাইতাম। ভাতের হাঁড়ি ডালের হাঁড়ি ভাঙিয়া একাকার করিয়া দিতাম। আর গ্রাম্য চাষিছেলেদের কাছে শেখা ইতর গালিগালাজে মাকে বকিয়া অস্থির করিতাম। মা মারিতে আসিলে ছুটিয়া পালাইতাম।

চলবে…