আমার মা
আমাদের গ্রামে আলিমদ্দি মোল্লার বাড়িতে আর বাহাদুর খাঁর বাড়িতে খেজুরের রস জ্বাল দিয়া গুড় তৈরি হইত। সকাল হইলে তাহাদের বাড়ি যাইয়া কলাপাতা লইয়া বসিয়া থাকিতাম। চার-পাঁচটা চৌকা একসঙ্গে জুড়িয়া দিয়া গুড়ের বাইন বানানো হইত। তাহাদের প্রত্যেক চৌকার উপর এক-একটি করিয়া জালা। জালা একটি ডিমের অর্ধেকের মতো প্রসর মুখবিশিষ্ট এক প্রকারের লম্বা হাঁড়ি। তাহার তলার দিকটা মুখ হইতে ক্রমেই সরু হইয়া গিয়াছে। সেই জালায় খেজুরের রস ভরিয়া বাইনের ভিতরে নাড়া বা খড়ের আগুনে জ্বাল দেওয়া হয়।
বাহাদুর খাঁর স্ত্রী ছিলেন আমার গ্রাম-সম্পর্কের বোন। তাঁর ছেলে রহিম ছিল আমার সমবয়সী। রস জ্বাল দেওয়ার মৌসুমে প্রায় সারা দুপুরই তাঁহাদের বাড়িতে কাটাইতাম। রহিমের মা বু আমাকে বড়ই ভালোবাসিতেন। আমি রস জ্বাল দিতে সাহায্য করিতাম। তার বিনিময়ে জ্বালা হইতে গুড় ঢালিবার পর ঝিনুক দিয়া যে চাঁছি উঠাইতেন তাহার একটু আমার কলার পাতে ঢালিয়া দিতেন। তাহাই চাটিতে চাটিতে বাড়ি ফিরিতাম। মাঝে মাঝে বু গুড় দিয়া নৈটানা বানাইয়া দিতেন। গুড়কে বেশি জ্বাল দিয়া আঠার মতো করা হইত। তাহা খাইতে দাঁতে আটকাইয়া যায়।
চুষিয়া চুষিয়া অনেকক্ষণ খাইতে পারা যায়। যেদিন বু এই নৈটানা বানাইতেন সেদিন আমি তাঁর অনেক কাজ করিয়া দিতাম। আমাদের বাড়িতে গুড় তৈরি হইত না। সব সময় বাজান গুড় কিনিয়া আনিতে পারিতেন না। খুব অল্পদামের ঝরা রসের (দিনের ভাগে খেজুর গাছে যে ঘোলা রস পড়ে) গুড় দুই-এক হাঁড়ি বাজান কিনিয়া আনিতেন। সেই গুড় আনিলে আমার হাতখানা প্রায় সময়ই গুড়ের হাঁড়ির মধ্যে থাকিত। আমরা কয়েক ভাই মিলিয়া সাত-আট দিনের মধ্যেই এক হাঁড়ি গুড় শেষ করিয়া ফেলিতাম। ছোটবেলায় ভালো জামাকাপড় পরিতে পারি নাই। শীতের বস্ত্রও সব সময় ছিল না। এজন্য বিশেষ যে কোনো দুঃখ অনুভব করিতাম তা আজ মনে পড়িতেছে না।
আর কোনোকিছু লইয়াই মা-বাপের প্রতি অভিযোগ করি নাই কিন্তু আমার সেই বাল্যবয়সের বাড়তির সময় যে মিষ্টি এবং পুষ্টিকর খাদ্যের জন্য আমার সমস্ত দেহকে তাড়না করিয়া ফিরিত, সেই ক্ষুধার পরিপূরণের জন্য বনে-জঙ্গলে এ-ফল সে-ফল টুকাইয়া বেড়াইতাম। কারও বাড়িতে পিঠা বানাইলে যাইয়া চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতাম। পিঠা বানাইয়া বাড়ির গৃহিণী তার ছেলেমেয়েদের দিত। আর-আর সকলকে দিত। আমি মনে মনে ভাবিতাম এর পরে আর এক খোলা পিঠা হইলেই বুঝি আমাকে সাধিবে। সেই খোলা শেষ হইয়া আরও এক খোলা শেষ হইত। গৃহিণী আমার দিকে ফিরিয়াও চাহিত না। তারপর একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বাড়ি ফিরিয়া আসিতাম। সেই বাড়ির ছোট ছেলেমেয়েরা বলিত, ও আমাদের পিঠায় চোখ লাগাইয়া গেল। নিজের খাবার হইতে এক টুকরা পিঠা আমার গায়ে ছুড়িয়া মারিয়া ছড়া কাটিয়া বলিত-
“তুই খাস না তোর পাঁচ পরানে খায়।
বাড়ি আসিয়া মাকে বলিতাম, “মা! ওদের বাড়িতে কেমন পিঠা করিয়া খাইতেছে, আমাকে একখানাও দিল না। মা তুই আমাকে পিঠা বানাইয়া দে।” আঁচলে চোখ মুছিয়া মা বলিতেন, “আজই তোকে পিঠা বানাইয়া দিব। আর ওদের বাড়ি যাইস না।”
কতদিন মনে মনে বলিতাম, আমার বাজান যদি মাস্টার না হইয়া কৃষাণ হইতেন; আলিমদ্দি, বাহাদুর খাঁর মতো খেজুরের গাছ কাটিয়া রস বাহির করিয়া আনিতেন, কত মজা করিয়া খাইতে পারিতাম! আমাদের মাচায় আর ঘরে গুড়ের হাঁড়ি বসানো থাকিত। আমাদের ধানের বেড়িতে কতরকমের ফসল আসিত। মা পিঠা বানাইয়া কূল পাইতেন না। আর এই যে ডলনে বা মইতে চড়িবার জন্য এর ওর হাতে-পায়ে ধরি, আমার বাজান কৃষাণ হইলে তাঁরই পিছনে পিছনে যাইয়া মজা করিয়া মইতে চড়িতাম-ডলনে চড়িতাম। এই মন্দ-ভাগ্যের জন্য মাঝে মাঝে আমি কাঁদিয়া ফেলিতাম।
আমার সমবয়সী চাষিছেলেরা দুপুর হইতে তাদের বাপ-চাচাদের জন্য হালের ক্ষেতে নাস্তা লইয়া যায়। সেখানে কলার পাতায় করিয়া কি মজা করিয়া ছোটরাও সেই নাস্তার অংশ খায়! মাঠে বসিয়া খাইতে কি মজা! আমার বাজান যদি মাঠে লাঙল বাহিতেন, রোজ আমি আমার বন্ধুদের মতোই নাস্তা লইয়া যাইতাম।
চলবে…