কেদারীর মা
আমার মায়ের সুখদুঃখের অন্তরঙ্গ দরদি ছিল কেদারীর মা। রহিমের মা বু, আর ছেলে কেদারীকে রাখিয়া কেদারীর বাপ মরিয়া যায়। অল্পবয়সে বিধবা হইয়া কেদারীর মা বাহাদুর খাঁকে ঘর-জামাই করিয়া মেয়েকে তার সঙ্গে বিবাহ দেয়। কয়েক মাস খাইতে দিয়া বাহাদুর খাঁ শাশুড়িকে আলাদা করিয়া দিল। প্রতিবেশীরা পরামর্শ দিল নিকা বসিতে। কিন্তু বাল্যবিধবা কেদারীর মা নিকা বসিল না। কেদারীকে বুকে লইয়া এ-বাড়ি ও-বাড়ি কাজ করিয়া কোনোরকমে পেটের আহার জোগাইত। এই কেদারীর মা শুধু আমার মায়েরই অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিল না, সমস্ত গ্রামের বধূদের সে ছিল সবচাইতে আপনার জন। কারও কোনো অসুখ-বিসুখ বিপদ-আপদ হইলে কেদারীর মা স্বেচ্ছায় যাইয়া সেখানে উপস্থিত হইত।
তাহাকে ডাকিতেও হইত না। কারও প্রসববেদনা উঠিলে কেদারীর মা শুধু বাচ্চার নাড়ি কাটিয়াই কর্তব্য শেষ করিত না, যে-কয়দিন পোয়াতি আঁতুর-ঘরে থাকিত সে-কয়দিন রাত্র জাগিয়া তাকে দেখাশোনা করিত। দিনে রান্নাবান্না করিয়া খাওয়াইত। প্রতিদানে সে কিছুই পাইত না। বউরা গোপনে সোপনে তাকে দুই-চার সের ধান বা চাউল দিত। কোনো কোনো নতুন ছেলের মা খুশি হইয়া তাকে এক-আধখানা কাপড়ও কিনিয়া দিত। এই কেদারীর মা ছিল গাঁয়ের গেজেট। সমস্ত গ্রামখানা দিনমানে সে একবার টহল দিয়া আসিত। তারপর কার বাড়ি কি হইতেছে, কে বউকে ধরিয়া ঠেঙাইয়াছে, কার বউকে কে নোলক কিনিয়া দিয়াছে, কোন বাড়িতে নতুন ফকির আসিয়া তেলেসমাতি দেখাইতেছে, কোথায় বউ শাশুড়িতে যুদ্ধ লাগিয়েছে ইহার আনুপূর্বিক সকল খবর বাড়িতে বাড়িতে কহিয়া, ওর চুলাটা নিবিয়া গিয়াছিল, তাহাতে দু’একখানা লাকড়ি ঠেলিয়া দিয়া, ওর ছেলেটি নোংরা হইয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল, তাহাকে ধুইয়া মুছিয়া একটু কোলে করিয়া, ও-বাড়ির বউ একা একা চুল বাঁধিতে পারিতেছিল না, তার মাথায় একটি সুন্দর বিনুনি তৈরি করিয়া চুল বাঁধিয়া দিয়া, ও-বাড়ি হইতে কলার মোচাটা আনিয়া সে-বাড়ির বউকে দিয়া, সে-বাড়ি হইতে একসের চাল লইয়া, ও-বাড়ি হইতে দুখানা ডাঁটা তুলিয়া, সে-বাড়ির নতুন বউটির কানেকানে কি কহিয়া মুখে একটি ঠোকনা মারিয়া হাসিয়া গড়াইয়া সমস্ত গ্রামখানিকে সে আনন্দমুখর করিয়া তুলিত। এইরূপে বাড়ি বাড়ি চলিয়া কত বাড়িতে যে সে পান খাইত, কত বাড়িতে যে এটা-ওটা চাখিয়া দেখিত, তাহার আর লেখাজোখা থাকিত না।
এই কেদারীর মা আমার মায়ের কত কাজ যে করিয়া দিয়াছে তাহার ইয়ত্তা নাই। আমার পরে আমার যত ভাইবোন হইয়াছে তাহাদের প্রত্যেকের আঁতুরের সময় কেদারীর মা শুধু দাইয়ের কাজই করে নাই, যে-সাতদিন মা আঁতুরঘরে থাকিতেন সে-সাতদিন আমাদের রান্নাবান্না ও ঘর-সংসারের সমস্ত কাজ করিয়া আমাদিগকে খাওয়াইয়া দাওয়াইয়া মায়ের আঁতুরঘরে সমস্ত রাত জাগিয়া নবজাতকের দেখাশোনা করিয়াছে। কেদারীর মা শুধু আমার মায়েরই বন্ধু ছিল না, আমাকেও সে বড়ই ভালোবাসিত।
কার্তিক পূজার রাত্রে হিন্দুপাড়া হইতে মেয়েলি কণ্ঠের গান ভাসিয়া আসিত। বিলম্বিত লয়ের কি অপূর্ব দূর। সেই সুর আমার বালকমনটিকে পাগল করিয়া তুলিত। এখন হিন্দুপাড়ায় শুধু পূজা হয়। রাত জাগিয়া মেয়েদের গান গাওয়ার প্রচলন উঠিয়া গিয়াছে। ভোর না হইতেই কেদারীর মার সঙ্গে হিন্দুপাড়ায় যাইতাম ঘট কুড়াইতে। কার্তিক পূজার ছোট ছোট ঘট চাহিয়া আনিয়া আমরা খেলা করিতাম। রেলের রাস্তা পার হইয়া ছোট গাঙের তীরে কাজেম মোল্লার বাড়ি। তারপর যাদব চুলির বাড়ি পার হইলেই নমঃশূদ্রদের পাড়া।
চলবে…