মায়ের সংসার
আমার কোনো ভাই হওয়ার আগে মা গোপনে কিছু চিড়া কুটিয়া ঘরের মাচার মধ্যে লুকাইয়া রাখিয়াছিলেন। মা যখন এদিক-ওদিক কাজে থাকিতেন আমি তখন সেই মাচায় উঠিয়া এটা-ওটা খাইবার জিনিস খুঁজিতাম। আমার সেই খুঁজিবার ক্ষমতা এমনই নির্ভুল হইত যে মা যেখানে যাহা গোপন করিয়া রাখিতেন আমি অনায়াসে তাহার সন্ধান পাইতাম। বোধ করি সকল মায়ের ছেলেরাই ইহা পায়। সেদিনও আমার স্ত্রী ছেলেদের প্রতি অভিযোগ করিতেছিলেন, “ফলটা মূলটা যেখানেই লুকাইয়া রাখি কেমন করিয়া যেন বান্দরগুলি খুঁজিয়া পায়।” এইভাবে মাচা খুঁজিয়া কোনোদিন কলাটা, আমটা বা পেয়ারাটা পাইতাম। সেদিন খুঁজিতে খুঁজিতে ধানের বেড়ির মধ্যে একটি নতুন পাতিল দেখিতে পাইলাম।
সেই পাতিল খুলিয়া দেখি তুষ-কুঁড়াসহ এক পাতিল চিড়া। তখন আর আমাকে পায় কে? সেই চিড়া বাহির করিয়া আনিয়া কুলায় ঝাড়িয়া কতক ভাইদের দিলাম, কতক নিজে খাইতে বসিলাম, এমন সময় মা কোথা হইতে আসিয়া তুষ-কুঁড়াসহ সেই চিড়ার পাতিলটি ছোঁ দিয়া লইয়া গিয়া কাঁদিতে বসিলেন। তখনকার দিনে আঁতুড়ঘরে পোয়াতিরা শুধু একবেলা ভাত খাইতে পাইত। রাতে চিড়াভাজা ছাতু ঝালসহ খাইবার নিয়ম ছিল। আঁতুড়ঘরে বসিয়া ঝালের ছাতুও মা একা খাইতেন না। আমাদিগকে ভাগ দিতেন। মায়ের সেই দুর্দিনের অবলম্বন চিড়াগুলি খাইয়া মাকে যে কি অসুবিধায় ফেলিলাম তখনকার বালকবয়সে তাহা বুঝিতে শিখি নাই। হয়তো মায়ের শরীর এই সময় এত খারাপ ছিল যে পুনরায় চিড়া কুটিয়া রাখিবার সামর্থ্য তাঁহার ছিল না। আজ আমার সংসারে ছেলেমেয়েরা এত ভালো ভালো খাবার ফেলিয়া-ছড়াইয়া খায়। একথা ভাবিতে চোখ অশ্রুপূর্ণ হইয়া আসে, সামান্য কয়টি চিড়ার জন্য আমার মা সেদিন এমন করিয়া চোখের পানি ফেলিয়াছিলেন।
একবার মায়ের কাছে আমি খুব মার খাইয়াছিলাম। আমাদের বাড়িতে গুড় মিষ্টি খুব কমই থাকিত। আমার ছোট ভাই সোয়েদ উদ্দীন তখন কয়েক মাসের। তার দুধ খাইবার জন্য মা কিছু মিছরি একটি বাঁশের চুঙ্গার মধ্যে লুকাইয়া রাখিয়াছিলেন। আমি সেই মিছরি খুঁজিয়া পাইয়া সমস্ত খাইয়া ফেলিয়াছিলাম। মা টের পাইয়া আমাকে তাড়া করিলেন। আমি আমার পিতার চাচাতো ভাই বড় চাচার কাছে আশ্রয় লইতে দৌড় দিলাম। বড় চাচা মায়ের ভাশুর। তাঁর সামনে মা যাইবেন না। কিন্তু পথের মধ্যে আমাকে ধরিয়া আনিয়া মা বেশ উত্তম-মধ্যম তো দিলেনই তারপর টানিয়া লইয়া চলিলেন, “আয় তোকে পাটা পুঁতায় ছেঁচিয়া ফেলি।” প্রতিবেশী কোনো বাড়ির বধু আসিয়া আমাকে ছাড়াইয়া লইয়া গেল। মা আঁতুড়ঘরে যাইয়া মাত্র ছয়দিন কাটাইতেন। সেই ছয়দিনও আঁতুড়ঘরে বসিয়াই মা
আমাদের খাওয়াদাওয়ার তদারক করিতেন। ছয়দিন পরে আঁতুড়ঘর লেপিয়া পুঁছিয়া মা বাহির হইতেন। নতুন ভাইকে পাইয়া আমরা নতুন খেলনার মতো আদর করিতাম। এই ছয়দিন আমাদের আঁতুড়ঘরে যাওয়া নিষেধ ছিল। যদিবা হঠাৎ কোনোদিন সেখানে ঢুকিতাম বাহিরে আসিয়া স্নান করিতে হইত। নতুবা পাড়ার কেহই আমাদিগকে ছুইত না। কেদারীর মা হাত-পা ধুইয়া ভালোমতো পরিষ্কার করিয়া সেই হাত-পা আগুনে সেকিয়া ঘরে ঢুকিত। সকাল হইলে আঁতুড়ঘর হইতে বাহির হইয়া স্নান করিয়া তবে আমাদের অন্যান্য কাজকর্ম করিত। আঁতুড়ঘরখানির দরজা প্রায়ই বন্ধ থাকিত। ঘরের সামনে একটা মরা গরুর মাথার হাড়, একজোড়া ছেঁড়া জুতা ও পিছা রাখা হইত, যেন কোনো অপদেবতা আসিয়া শিশুর ক্ষতি না করে,-কোনো আটকুড়ো মায়ের বদদৃষ্টি যাতে শিশুর উপর না পড়িতে পারে। যদিবা পড়ে তাহাতে শিশুর কোনো ক্ষতি হইবে না। কারণ তার পরই ঘরের সামনে লটকানো সেই হাড়, ছেঁড়া জুতা আর পিছার উপর চাহিলেই তাহার কুদৃষ্টি নষ্ট হইয়া যাইবে।
চলবে…