০২:২৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৩৬)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০৩:৪২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪
  • 19

রাঙাছুটুর বাপের বাড়ি

এ-পথ গিয়াছে কোনখানে। এখানে দুইধারে শুধু তেঁতুল গাছের সারি-তারপর বহেড়া গাছের জঙ্গল। শীতল ছায়া ধরিয়া পথিকের প্রাণ জুড়াইতেছে। শাখায় শাখায় পাখির গান ভরিয়া পথিকের মন জুড়াইতেছে। এ-পথ গিয়াছে কোনখানে। সামনে উড়ি-আম গাছ, কানাই-লাঠির জঙ্গল। এ-গাছ হইতে ও-গাছে বেতের লতা আসিয়া একে অপরকে বাঁধিয়া সেই বনভূমিকে মানুষের অগম্য করিয়া রাখিয়াছে। তারই পাশ দিয়া পথ-গোয়াল চামট ছাড়িয়া ডোমরাকান্দি-সেখানে ত্রিমণির উপর সরকারি পাকা কুয়ো। এমন নিটল পানি! পিপাসা না থাকিলেও লোকে এখান হইতে এক ঘটি পানি উঠাইয়া পান করে। এখানে আর এক জিড়ান দিয়া বাঁধা কুয়োর পানি খাইয়া বেহারারা রওয়ানা হয় বামে ঘুরিয়া তাম্বুলখানার রাস্তায়। ডাইনের দিকে সামনে দিয়া আঁকিয়া-বাঁকিয়া গিয়াছে পথ দিগনগরের হাটে, তারপর ধোপাঘাটা, মামুদপুর, যশোর, তারপর দিল্লি, লাহোর, বোধহয় দুনিয়ার শেষ প্রান্তে।
আমরা চলিয়াছি নানাবাড়ির পথে, তাম্বুলখানা গ্রামে। এ-পথের ধারে ধারে গাছগাছালি দাঁড়াইয়া ছায়া বিস্তার করে না। এক দৌড়ে চযামাঠ ছাড়াইয়া পথ যাইয়া ঢোকে গভীর জঙ্গলে। সেখানে বেতগাছের শিষা আসিয়া পথিকের গায়ের চাদর আটকাইতে চায়। শ্যামালতা তার লতাগুলির ফাঁদ মেলিয়া পথিকের পায়ে জড়াইয়া পড়ে। তবু এ-পথ ভালো। গাছের ডালে ডালে কত মাকাল ফল পাকিয়া লাল হইয়া আছে। কুঁচোর লতায় কত কুঁচ ফল পাকিয়া রাঙা হইয়া হাসিতেছে। এ যেন বনরানীর সিঁদুরের ঝাঁপি। হিজল গাছের তলা দিয়া যখন পথ, তখন তো সেখান হইতে যাইতেই ইচ্ছা করে না। রাশি রাশি হিজল ফুল মাটিতে পড়িয়া সমস্ত বনভূমিকে যেন আলতা পরাইয়া দিয়াছে। কোনো গোপন চিত্রকর যেন এই বনের মধ্যে বসিয়া পাকা তেলাকুঁচের রঙে, মাকাল ফলের রঙে আর হিজল ফুলের রঙে মিলাইয়া তার সবচাইতে সুন্দর ছবিখানি আঁকিয়া বসিয়া বসিয়া দেখিতেছে।
তারপর আবার মাঠ। মাঠের পর আবার বন। মামাবাড়ি আর কত দূর-ওই তো সামনে দেখা যায় মুরালদহ। আহা কি মিষ্টি এই গ্রামের নাম! জাঙলা ভরিয়া লাউ-কুমড়ার জালি বাতাসে দোলা দিতেছে। কনেসাজানি শিমলতার জাঙলায় কি রঙ। এ-বাড়ির বউ বুঝি তার নীলাম্বরী শাড়িখানি মেলিয়া ধরিয়াছে এই জাঙলার উপর। ও-বাড়ির গাছে আম পাকিয়া পাকিয়া রাঙা হইয়া আছে। সেই আমের মতো রাঙা টুকটুকে বউটি বাঁশের কোটা দিয়া আম পাড়িতেছে। সে-বাড়ির গাছে হাজার হাজার কাঁঠাল ধরিয়াছে। এ যেন ওদের ছেলেমেয়েগুলি গাছের ডালে ডালে ঝুলিতেছে। এ-গাঁও ছাড়িয়া আসিলাম তাম্বুলখানা গ্রামে। ওই তো মোকিমের বাড়ির বড় বড় তালগাছ দুইটি দেখা যায়। বরোইদের পানের বর ডাইনে ফেলিয়া মিঞাজানের বাড়ির সামনে দিয়া ফেলিদের বাড়ি-তারপর ওই তো নানাবাড়ির নারকেল গাছ। বাতাসে শোঁশোঁ করিতেছে। নানি দাঁড়াইয়া আছেন পথের মধ্যে।
কতক্ষণ যে এইভাবে দাঁড়াইয়া আছেন কে জানে। ভুলি যাইয়া নামিল উঠানের মধ্যে। নানি ডুলির কাপড় উঠাইয়া মাকে নামাইয়া আনিলেন। মা নামিয়া নানির পায়ের ধুলা লইতে নানি মাকে ধরিয়া বারান্দার উপর আনিয়া বসাইলেন। তারপর পাখার বাতাস করিতে করিতে কত কথা। মায়ের মাথার চুলগুলি আলগা করিয়া দেখেন নানি। হাত দুইখানি মুঠি করিয়া বুকের মধ্যে ধরিয়া রাখেন।

চলবে…

সুপ্রিম কোর্টের রায়কে পাশ কাটানোর কৌশল খুঁজছে বিচারকরা, ফেরাতে পারবে কি USAID

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৩৬)

১১:০৩:৪২ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪

রাঙাছুটুর বাপের বাড়ি

এ-পথ গিয়াছে কোনখানে। এখানে দুইধারে শুধু তেঁতুল গাছের সারি-তারপর বহেড়া গাছের জঙ্গল। শীতল ছায়া ধরিয়া পথিকের প্রাণ জুড়াইতেছে। শাখায় শাখায় পাখির গান ভরিয়া পথিকের মন জুড়াইতেছে। এ-পথ গিয়াছে কোনখানে। সামনে উড়ি-আম গাছ, কানাই-লাঠির জঙ্গল। এ-গাছ হইতে ও-গাছে বেতের লতা আসিয়া একে অপরকে বাঁধিয়া সেই বনভূমিকে মানুষের অগম্য করিয়া রাখিয়াছে। তারই পাশ দিয়া পথ-গোয়াল চামট ছাড়িয়া ডোমরাকান্দি-সেখানে ত্রিমণির উপর সরকারি পাকা কুয়ো। এমন নিটল পানি! পিপাসা না থাকিলেও লোকে এখান হইতে এক ঘটি পানি উঠাইয়া পান করে। এখানে আর এক জিড়ান দিয়া বাঁধা কুয়োর পানি খাইয়া বেহারারা রওয়ানা হয় বামে ঘুরিয়া তাম্বুলখানার রাস্তায়। ডাইনের দিকে সামনে দিয়া আঁকিয়া-বাঁকিয়া গিয়াছে পথ দিগনগরের হাটে, তারপর ধোপাঘাটা, মামুদপুর, যশোর, তারপর দিল্লি, লাহোর, বোধহয় দুনিয়ার শেষ প্রান্তে।
আমরা চলিয়াছি নানাবাড়ির পথে, তাম্বুলখানা গ্রামে। এ-পথের ধারে ধারে গাছগাছালি দাঁড়াইয়া ছায়া বিস্তার করে না। এক দৌড়ে চযামাঠ ছাড়াইয়া পথ যাইয়া ঢোকে গভীর জঙ্গলে। সেখানে বেতগাছের শিষা আসিয়া পথিকের গায়ের চাদর আটকাইতে চায়। শ্যামালতা তার লতাগুলির ফাঁদ মেলিয়া পথিকের পায়ে জড়াইয়া পড়ে। তবু এ-পথ ভালো। গাছের ডালে ডালে কত মাকাল ফল পাকিয়া লাল হইয়া আছে। কুঁচোর লতায় কত কুঁচ ফল পাকিয়া রাঙা হইয়া হাসিতেছে। এ যেন বনরানীর সিঁদুরের ঝাঁপি। হিজল গাছের তলা দিয়া যখন পথ, তখন তো সেখান হইতে যাইতেই ইচ্ছা করে না। রাশি রাশি হিজল ফুল মাটিতে পড়িয়া সমস্ত বনভূমিকে যেন আলতা পরাইয়া দিয়াছে। কোনো গোপন চিত্রকর যেন এই বনের মধ্যে বসিয়া পাকা তেলাকুঁচের রঙে, মাকাল ফলের রঙে আর হিজল ফুলের রঙে মিলাইয়া তার সবচাইতে সুন্দর ছবিখানি আঁকিয়া বসিয়া বসিয়া দেখিতেছে।
তারপর আবার মাঠ। মাঠের পর আবার বন। মামাবাড়ি আর কত দূর-ওই তো সামনে দেখা যায় মুরালদহ। আহা কি মিষ্টি এই গ্রামের নাম! জাঙলা ভরিয়া লাউ-কুমড়ার জালি বাতাসে দোলা দিতেছে। কনেসাজানি শিমলতার জাঙলায় কি রঙ। এ-বাড়ির বউ বুঝি তার নীলাম্বরী শাড়িখানি মেলিয়া ধরিয়াছে এই জাঙলার উপর। ও-বাড়ির গাছে আম পাকিয়া পাকিয়া রাঙা হইয়া আছে। সেই আমের মতো রাঙা টুকটুকে বউটি বাঁশের কোটা দিয়া আম পাড়িতেছে। সে-বাড়ির গাছে হাজার হাজার কাঁঠাল ধরিয়াছে। এ যেন ওদের ছেলেমেয়েগুলি গাছের ডালে ডালে ঝুলিতেছে। এ-গাঁও ছাড়িয়া আসিলাম তাম্বুলখানা গ্রামে। ওই তো মোকিমের বাড়ির বড় বড় তালগাছ দুইটি দেখা যায়। বরোইদের পানের বর ডাইনে ফেলিয়া মিঞাজানের বাড়ির সামনে দিয়া ফেলিদের বাড়ি-তারপর ওই তো নানাবাড়ির নারকেল গাছ। বাতাসে শোঁশোঁ করিতেছে। নানি দাঁড়াইয়া আছেন পথের মধ্যে।
কতক্ষণ যে এইভাবে দাঁড়াইয়া আছেন কে জানে। ভুলি যাইয়া নামিল উঠানের মধ্যে। নানি ডুলির কাপড় উঠাইয়া মাকে নামাইয়া আনিলেন। মা নামিয়া নানির পায়ের ধুলা লইতে নানি মাকে ধরিয়া বারান্দার উপর আনিয়া বসাইলেন। তারপর পাখার বাতাস করিতে করিতে কত কথা। মায়ের মাথার চুলগুলি আলগা করিয়া দেখেন নানি। হাত দুইখানি মুঠি করিয়া বুকের মধ্যে ধরিয়া রাখেন।

চলবে…