০৭:১৮ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৩৯)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০৩:৫২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪
  • 20

রাঙাছুটুর বাপের বাড়ি

আম কুড়ানো শেষ করিয়া পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে বনে-বনান্তরে ঘুরিয়া বেড়াই। বাঁশের কঞ্চির দুই ধারের দুই গিরা কাটিয়া লই। সেই নলের দুই মুখে দুইটি বুনো ফল গুঁজিয়া দিয়া এক মুখের ফল অপর মুখে ঠেলিয়া দেই। ফট্ করিয়া শব্দ হইয়া অপর মুখের ফলটি ছিটকাইয়া যায়। এ কি কম আনন্দের কথা। যখন-তখন অজানিতে কারও কানের কাছে যাইয়া ফক্কা বাজাই। সে চমকিয়া উঠে। সে কি কম মজা। তারপর তল্লা-বাঁশ কাটিয়া বাঁশি বানাইবার ব্যর্থ চেষ্টা। তীর-ধনুক বানাইয়া পাখিদের পিছে ধাওয়া করা-ইহা তো বাহ্য। সবচাইতে রোমাঞ্চকর কাজ সজারুর বাসা খুঁজিয়া সেখান হইতে সজারুর কাঁটা লইয়া আসা। সজারু টের পাইলে আর রক্ষা নাই। ঘন বেতের ঝাড়ে বেথুল ঝুলিতেছে।
আমাদের চরের দেশে বেথুলের গাছ নাই। বেথুল খাইতে কি সুন্দর টক। খোসা ছাড়াইয়া চালমাপা সেরের মধ্যে পুরিয়া কিছু লবণ ছাড়িয়া দাও। তারপর সেরের মুখ গামছা দিয়া ঢাকিয়া বেশ খানিকটা ঝাঁকাইয়া লইয়া খাইয়া দেখ। এমন সামগ্রী কোথাও খাইয়াছ কি কোনোদিন? কিন্তু যা-বেতের কাঁটা। গাছের আগায় বেতের শিষগুলি লকলক করিতেছে। সামনে গেলেই কাপড়চোপড়ে বিধিয়া যাইয়া তোমাকে বনের মধ্যে জড়াইয়া ধরিবে। আর বাড়ি ফিরিতে পারিবে না। ডাকিয়া যে লোকজন জড় করিবে, এই গভীর জঙ্গলে কে কার কথা শোনে? তবু সেই বেথুল আমাদের আনা চাই। ছালা দিয়া গা ঢাকিয়া চোরের মতো মাটির কাছ দিয়া যাইতে হইবে। বেথুল খাওয়ার চাইতে বেথুল তোলার মধ্যেই তো সবচাইতে আনন্দ। আর এত উত্তেজনা আর কোনোকিছুতেই নাই।
রাঙাছুটু বাড়ি আসিয়াছে। শহরের দেশে তার শ্বশুরবাড়ি। সেখানে রোজ তাহারা চিনি সন্দেশ খায়। সেখান হইতে কত কেচ্ছা-কাহিনী লইয়া আসিয়াছে। ফেলি কোথায় গেলি? গরীবুল্লা মাতবরের মেয়ে সাজু কই? আসমানীকে ডাক, খোসমানিকে ডাক। রাঙাছুট বাপের বাড়ি আসিয়াছে। আজ দুপুরে গরীবুল্লা মাতবরের পুকুরঘাটে ঘটা করিয়া নাওয়া হইবে। রাঙাছুটুর কাছে তার শ্বশুর-বাড়ির সব কথা শুনিতে হইবে।
আমাদের বাড়িতে মা কোনোদিন গাঙের ঘাটে নাইতে যান না। এ-বাড়ির ও-বাড়ির মেয়েরা আমাদের বাড়ি বেড়াইতে আসে। মা কারও বাড়ি যান না। মোল্লাবাড়ির বন্ধুর বাড়ির বার হওয়া মানা। মা কিন্তু এখানে আসিয়া এসব কিছুই মানেন না। কাউকে দেখিয়া মাথায় ঘোমটাটিও টানেন না। গাঁয়ের সবাই তাঁর চেনা। দুপুর না হইতেই মায়ের সখীরা নানাবাড়ি ভরিয়া ফেলে। তারপর দল বাঁধিয়া যায় গরীবুল্লা মাতবরের পুকুরে। কাঠের উপর কাঠ ফেলিয়া ঘাটলা তৈরি হইয়াছে। তাহা কত কালের শ্যাওলা জমিয়া পিছল হইয়া আছে। খুব সাবধানে নামিতে হইবে। ও রাঙাছুটু। পড়িয়া যাইবি। আয়, তোকে ধরি। মাকে আজ সবাই খাতির করে, সমীহ করে। আমাদের বাড়িতে মায়ের এত আদর নাই কেন?
কতরকম কথাই না মেয়েরা বলে। জোরে জোরে কিছু বলিয়া হাসিয়া গড়াইয়া পড়ে-কেউ কারও কানেকানে কি বলিয়া তাকে ধাক্কা দিয়া পানির মধ্যে ফেলিয়া দেয়। আমি তাদের এত হাসি-তামাশার কারণ বুঝিতে পারি না। মার আঁচল ধরিয়া বলি, মা। চল বাড়ি যাই। মা আরও অনেকক্ষণ গল্প করিয়া তবে বাড়ি ফেরেন। প্রত্যেকের কাঁখে একটি করিয়া ভরা কলসি। চলিতে চলিতে কলসির পানি ঝলকাইয়া ওঠে-পায়ে ঝুমুর ঝুমুর কাঁসার খাড়ু বাজে।

 

চলবে…

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৩৯)

১১:০৩:৫২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪

রাঙাছুটুর বাপের বাড়ি

আম কুড়ানো শেষ করিয়া পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে বনে-বনান্তরে ঘুরিয়া বেড়াই। বাঁশের কঞ্চির দুই ধারের দুই গিরা কাটিয়া লই। সেই নলের দুই মুখে দুইটি বুনো ফল গুঁজিয়া দিয়া এক মুখের ফল অপর মুখে ঠেলিয়া দেই। ফট্ করিয়া শব্দ হইয়া অপর মুখের ফলটি ছিটকাইয়া যায়। এ কি কম আনন্দের কথা। যখন-তখন অজানিতে কারও কানের কাছে যাইয়া ফক্কা বাজাই। সে চমকিয়া উঠে। সে কি কম মজা। তারপর তল্লা-বাঁশ কাটিয়া বাঁশি বানাইবার ব্যর্থ চেষ্টা। তীর-ধনুক বানাইয়া পাখিদের পিছে ধাওয়া করা-ইহা তো বাহ্য। সবচাইতে রোমাঞ্চকর কাজ সজারুর বাসা খুঁজিয়া সেখান হইতে সজারুর কাঁটা লইয়া আসা। সজারু টের পাইলে আর রক্ষা নাই। ঘন বেতের ঝাড়ে বেথুল ঝুলিতেছে।
আমাদের চরের দেশে বেথুলের গাছ নাই। বেথুল খাইতে কি সুন্দর টক। খোসা ছাড়াইয়া চালমাপা সেরের মধ্যে পুরিয়া কিছু লবণ ছাড়িয়া দাও। তারপর সেরের মুখ গামছা দিয়া ঢাকিয়া বেশ খানিকটা ঝাঁকাইয়া লইয়া খাইয়া দেখ। এমন সামগ্রী কোথাও খাইয়াছ কি কোনোদিন? কিন্তু যা-বেতের কাঁটা। গাছের আগায় বেতের শিষগুলি লকলক করিতেছে। সামনে গেলেই কাপড়চোপড়ে বিধিয়া যাইয়া তোমাকে বনের মধ্যে জড়াইয়া ধরিবে। আর বাড়ি ফিরিতে পারিবে না। ডাকিয়া যে লোকজন জড় করিবে, এই গভীর জঙ্গলে কে কার কথা শোনে? তবু সেই বেথুল আমাদের আনা চাই। ছালা দিয়া গা ঢাকিয়া চোরের মতো মাটির কাছ দিয়া যাইতে হইবে। বেথুল খাওয়ার চাইতে বেথুল তোলার মধ্যেই তো সবচাইতে আনন্দ। আর এত উত্তেজনা আর কোনোকিছুতেই নাই।
রাঙাছুটু বাড়ি আসিয়াছে। শহরের দেশে তার শ্বশুরবাড়ি। সেখানে রোজ তাহারা চিনি সন্দেশ খায়। সেখান হইতে কত কেচ্ছা-কাহিনী লইয়া আসিয়াছে। ফেলি কোথায় গেলি? গরীবুল্লা মাতবরের মেয়ে সাজু কই? আসমানীকে ডাক, খোসমানিকে ডাক। রাঙাছুট বাপের বাড়ি আসিয়াছে। আজ দুপুরে গরীবুল্লা মাতবরের পুকুরঘাটে ঘটা করিয়া নাওয়া হইবে। রাঙাছুটুর কাছে তার শ্বশুর-বাড়ির সব কথা শুনিতে হইবে।
আমাদের বাড়িতে মা কোনোদিন গাঙের ঘাটে নাইতে যান না। এ-বাড়ির ও-বাড়ির মেয়েরা আমাদের বাড়ি বেড়াইতে আসে। মা কারও বাড়ি যান না। মোল্লাবাড়ির বন্ধুর বাড়ির বার হওয়া মানা। মা কিন্তু এখানে আসিয়া এসব কিছুই মানেন না। কাউকে দেখিয়া মাথায় ঘোমটাটিও টানেন না। গাঁয়ের সবাই তাঁর চেনা। দুপুর না হইতেই মায়ের সখীরা নানাবাড়ি ভরিয়া ফেলে। তারপর দল বাঁধিয়া যায় গরীবুল্লা মাতবরের পুকুরে। কাঠের উপর কাঠ ফেলিয়া ঘাটলা তৈরি হইয়াছে। তাহা কত কালের শ্যাওলা জমিয়া পিছল হইয়া আছে। খুব সাবধানে নামিতে হইবে। ও রাঙাছুটু। পড়িয়া যাইবি। আয়, তোকে ধরি। মাকে আজ সবাই খাতির করে, সমীহ করে। আমাদের বাড়িতে মায়ের এত আদর নাই কেন?
কতরকম কথাই না মেয়েরা বলে। জোরে জোরে কিছু বলিয়া হাসিয়া গড়াইয়া পড়ে-কেউ কারও কানেকানে কি বলিয়া তাকে ধাক্কা দিয়া পানির মধ্যে ফেলিয়া দেয়। আমি তাদের এত হাসি-তামাশার কারণ বুঝিতে পারি না। মার আঁচল ধরিয়া বলি, মা। চল বাড়ি যাই। মা আরও অনেকক্ষণ গল্প করিয়া তবে বাড়ি ফেরেন। প্রত্যেকের কাঁখে একটি করিয়া ভরা কলসি। চলিতে চলিতে কলসির পানি ঝলকাইয়া ওঠে-পায়ে ঝুমুর ঝুমুর কাঁসার খাড়ু বাজে।

 

চলবে…