১২:৫৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

বেলিস্টেট ও স্যাটেলাইট বা জোন স্টেটগুলোর অর্থনৈতিক কূটনীতি 

  • Sarakhon Report
  • ০৭:৪৮:১৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪
  • 12

স্বদেশ রায়

“ মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ তার দেশকে বিপুল অর্থনৈতিক সহায়তা করার জন্যে ভারতকে অকুণ্ঠ ধন্যবাদ জানিয়েছেন”। ( বিবিসি, বাংলা অনলাইন, ৮ অক্টোবর)

মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ ভারত সফরে এসে দ্বিতীয় দিনে সে দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পরে তাঁর দেশের আর্থিক দুরবস্তা কাটানোর জন্যে ভারতীয় সাহায্য নিশ্চিত হবার পরে উপরোক্ত ওই ধন্যবাদ জানান।

মি. মুইজ কোন ধরনের প্রচারের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিলেন এবং ক্ষমতায় আসার পর পরই তিনি কী কূটনীতি গ্রহন করার চেষ্টা করেছিলেন তা এ মুহূর্তে সকলেই জানেন। কিন্তু যে মহূর্তে তাঁর দেশের মাত্র দেড় মাসের আমদানী ব্যয় মেটানোর সমর্থ আছে এবং দেশের দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে -সে সময়ে তাঁর রাষ্ট্র যে বড় রাষ্ট্র অর্থাৎ ভারতের জোন স্টেট   সেখানেই চলে এসেছেন, অর্থনৈতিক ভাবে তাঁর দেশকে উদ্ধার করার জন্যে।

মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট একথাও বলেছেন, এছাড়া তাঁর দ্বিতীয় কোন পথ নেই। তার প্রথম কারণ আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের সাহায্য প্রার্থীর সংখ্যা এত বেশি- তাছাড়া তাদের প্রায়োরিটিও নির্ভর করে নানান সমীকরণে ( যা এখানে উল্লেখ করতে গেলে লেখার বিষয়বস্তু থেকে ভিন্ন দিকে চলে যাবে) তাই মি. মুইজ আইএম্এফ এর পিছে ঘোরেননি। তাছাড়া মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট দেখতে পাচ্ছেন, শ্রীলংকার গোটাবায়ে সরকার অর্থনৈতিকভাবে ব্যর্থ হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হলে সেখানে শান্তভাবে সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কোন ব্যবসা, বানিজ্য, স্থাপনা বা কোন রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় কোন কিছু ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি। বরং একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিক দেশের দ্বায়িত্ব নিয়ে, পার্লামেন্ট বজায় রেখেও আইএমএফ এর সাহায্য নিয়ে দেশ চালালেও- দেশের সাধারণ মানুষকে খাবার দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। মাত্র মাস দুয়েক আগের বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের এশিয়া বিভাগের একটা নিউজ ছিলো, যা সারাক্ষণেও ছাপা হয়- তীব্র ঝড় বৃষ্টির মধ্যে শ্রীলংকার কয়েকজন সাধারণ পুরুষ ও নারীকে একটি গির্জার দিকে দৌঁড়াতে দেখা যায়। তাদের কাছে গিয়ে রিপোর্টার জানতে পারেন তারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গির্জায় পৌঁছাতে চায়। কারণ গির্জায় এক বেলা খাবার দেয়। আর এটাই তাদের সারা দিনের খাবার। তাদের যেমন কোন আয় করার সুযোগ নেই,  তেমনি এ মুহূর্তে তাদের খাবার কেনার কোন সমর্থও নেই।

শ্রীলংকার সাধারণ মানুষ তাদের এই কষ্ট পাওয়াকে অভিজ্ঞ রাজনীতিক রনিল বিক্রমসিং-এর ব্যর্থতা হিসেবে ধরে নিয়ে নির্বাচনে তাকে তিন নাম্বারে নামিয়ে এনেছে। এবং সে দেশের অন্যতম পরিবার কেন্দ্রিক রাজনীতির উত্তরাধিকার সাজিদ প্রেমদাসা নির্বাচনে প্রথম দিকে এগিয়ে থাকলেও- দ্বিতীয় রাউন্ড এর গণনায় ও সে দেশের ভোটের পদ্ধতিগত হিসেবের ফলে,  অতি কম পরিচিত বামপন্থী রাজনীতিক প্রেসিডেন্ট হয়েছেন।

বামপন্থী হলেও তিনি তাঁর জোনের বড় রাষ্ট্র ভারতেই তাঁর প্রধানমন্ত্রীকে প্রথম সফরে পাঠাচ্ছেন। তারও মূল উদ্দেশ্য জোনাল রাষ্ট্র হিসেবে আঞ্চলিক বড় রাষ্ট্রের অর্থনীতির সঙ্গে নিজেকে জোড়া। কারণ, দুই বছরের বেশি সময়ে তারা বুঝে গেছে আইএমএফ সাময়িক বেইল আউট করতে পারে কিন্তু দেশের মানুষকে খাবার দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার অর্থনৈতিক কূটনীতি ভিন্ন।

যেমন সাউথ ইস্ট এশিয়ার দেশগুলোর অধিকাংশের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক ভালো। এবং অনেকগুলো দেশে এখনও আমেরিকান সেনা উপস্থিতি রয়েছে ও অনেকের সঙ্গে তাদের নানান সামরিক চুক্তিও আছে। অন্যদিকে এই দেশগুলোর অনেকের সঙ্গে চায়নার সামরিক বা সমুদ্র সীমা নিয়ে এক ধরনের উত্তেজনা আছে।  তারপরেও দেখা যায় এই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কারো কারো আকার বড় হলেও তারা তাদের জোনের সব থেকে বড় অর্থনৈতিক শক্তি চায়নার সঙ্গে ভিন্ন অর্থনৈতিক কূটনীতি মেইনটেইন করে। যা মূলত তাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ও মানুষের দুর্ভোগ কমানোর স্বার্থে। এমনকি তারা এই সম্পর্ক কোন কোন ক্ষেত্রে এশিয়ার তৃতীয় বড় অর্থনীতি ভারতের সঙ্গেও বজায় রাখে। এমনকি লাওসে এ সময়ে যে আসিয়ান সামিট হতে যাচ্ছে সেখানে চায়নার প্রতিনিধি’র পাশাপাশি আমেরিকার ফরেণ সেক্রেটারি ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীও থাকছেন।

ঠিক একইভাবে আরব সাগরীয় উপকূলের দেশগুলোতে আমেরিকা ও চায়নার বিনিয়োগ যতই বেশি হোক না কেন সাগর পথে তাদের কাছের দেশ ভারতের সঙ্গে সব সময় তারা ভিন্ন সম্পর্ক মেইনটেইন করে। আর সেটা অর্থনৈতিক কূটনীতির মধ্যে পড়ে। ভারতের যেমন তাদের তেল প্রয়োজন তেমনি তাদের প্রয়োজন ভারতের ফুডগ্রেইন ও দক্ষ মানবসম্পদ। কারণ সেন্ট্রাল এশিয়ার উৎপাদিত খাদ্য সব সময়ই মিডলইস্ট এর জন্যে যথেষ্ট হয়ে ওঠে না।

মি. মইজু পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত। তারপরও তিনি ধর্ম ও প্রতিবেশি বড় রাষ্ট্র বিরোধীতা- এই দুই সস্তা উপাদান রাজনীতির সঙ্গে মিলিয়েছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে খুব দ্রুতই বাস্তবতায় এসে দাঁড়িয়েছেন। এবং তাঁর দেশের মানুষকে বাঁচানোর জন্যে তিনি মানি সোয়াপ নীতি অর্থাৎ ভারত ও মালদ্বীপের মুদ্রার সরাসরি বিনিময়কে চালু করলেন। এমনকি নিজ দেশের ডলার বাঁচানোর জন্যে ভারতীয় রুপাইয়া কার্ডও সে দেশে চালু করার চুক্তি করলেন।

পাকিস্তান আকারে বড় রাষ্ট্র হলেও ভারতের আংশিক বেলিস্টেট। তাছাড়া পাকিস্তানের অন্য যে সীমান্ত সেখানে বানিজ্য’র পথ ও উপাদান কম। বরং পাকিস্তানের বেশি বানিজ্য ও অর্থনৈতিক সুযোগ ভারতের সঙ্গে। যে কারণে তরুণ ও আধুনিক বেনজির ক্ষমতায় এসেই ভারত সফরে আসার পরে প্রথম দুই দেশ কেউ কারো বিরুদ্ধে পারমানবিক শক্তি ব্যবহার করবে না এই চুক্তি করেছিলেন। পাশাপাশি অর্থনৈতিক কূটনীতিতে জোর দেন। কিন্তু পাকিস্তানের ধর্মীয় শক্তি ও অনান্য শক্তির কারণে বেনজির ক্ষমতায় যেমন টিকতে পারেননি কোন বারই বেশি সময়- তেমনি শেষ অবধি তাকে জীবন দিতে হয়েছে। রাজীব, অটল বিহারী বাজপেয়ি, পারভেজ মোশারফ ও মোদি অর্থনৈতিক কূটনীতির দিকে জোর দেবার চেষ্টা করেন। কিন্তু কেউ সফল হননি। যে কারণে ভারতের পশ্চিম সীমান্ত বন্ধই বলা চলে।

কোভিডের আগে যখন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সূচক বেশ উঁচূতে ছিলো, সে সময়ে চায়নায় বসে পাকিস্তানি এক সাংবাদিক বন্ধু বলেছিলেন, তাদের দেশের অর্থনীতি বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে পড়ার বড় একটা কারণ ভারতের সঙ্গে তাদের অর্থনৈতিক বৈরি সম্পর্ক। ভারতের নীতি যদি তাদের পূর্ব বর্ড়ার ও পশ্চিম বর্ডার নিয়ে এক হতো তাহলে পাকিস্তানের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য এমন আকাঁশ ছুঁয়ে যেতো না। প্রসঙ্গটাকে ভিন্ন দিকে ঠেলে দেবার জন্যে বলেছিলাম,  আসলে সার্ক একটিভ থাকলে ভালো হতো। প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাচ্ছি বুঝে তিনি হেসে হাত চেপে ধরে বলেন, ফোরাম আর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক কি এক বিষয়- ফ্রেন্ড?  আর প্রসঙ্গ বাড়ায়নি।

আবার বেলিস্টেট ও স্যাটেলাইট বা জোনস্টেটগুলোর প্রতি তার সংলগ্ন বা জোনের বড় স্টেটগুলোরও একটা দায়ও থাকে। যেমন মিয়ানমারে যে অস্থিতিশীলতা চলছে সেখান থেকে মিয়ানমারকে বের করে আনার বড় দায় সে দেশের মানুষের। তবে চায়না ও ভারতেরও একটা দায় আছে। এমনকি তাদের নিজের প্রয়োজনে ও আঞ্চলিক অর্থনীতির স্বার্থেও এ কাজ তাদের করা প্রযোজন।

মিয়ানমার মূলত সামরিক শাসক শাসিত একটি দেশ। সেখানে ছাত্ররা একবার আন্দোলন করে গণতন্ত্র আনতে গিয়ে ব্যর্থ হয়।  পরে ছাত্র ও ধর্মীয় গোষ্টি মিলে এক পর্যায়ে এক ধরনের গণতন্ত্র আনে। এবং শান্তির নোবেল লরিয়েট সূচি গণতান্ত্রিক নেতা হিসেবে সেখানে ক্ষমতার কিছুটা ভাগ পান। কিন্তু সূচি ক্ষমতা নেবার পর থেকেই দ্রুত ব্যর্থ হতে থাকেন। এবং সেখানে সামরিক শাসকরা যে নৃগোষ্টিগত সমস্যাকে অনেকটা দৈত্যকে বোতলে পুরে রাখার মতো করে রেখেছিলো- সেই বোতলের মুখ অনভজ্ঞিতার কারণে খুলে ফেলেন সূচি। যাহোক, সূচি এখন সে দেশের রাজনীতিতে আর কোন বিষয় নেই। দেশটি এখন গৃহযুদ্ধ কবলিত। পৃথিবীর অনেক শক্তি সে দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপগুলোকে সহায়তা করছে। এবং এভাবে চলতে থাকলে আরো বাড়বে বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ; এমনকি সন্ত্রাসীগ্রুপও। যা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে তাতে খুব শীঘ্র যদি “ আরসা”র মত জঙ্গী সংগঠনগুলো আরো শক্তিশালী হয় তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। তার ফলে ভারত ও বাংলাদেশ সীমান্তে আবারও যদি সেখানকার বাদবাকী রোহিঙ্গাদের যাত্রা করতে হয় তাও খুব বেশি আশ্চর্য হবার কিছু নয়। বরং পরিস্থিতি সেদিকেই যাচ্ছে বলেই প্রতিটি ঘটনা ঈংগিত দিচ্ছে।

তাই চায়না ও ভারত যেমন তাদের নিজেদের স্বার্থে তাদের সীমানা সমস্যা ও বানিজ্য সমস্যা মিটিয়ে নিচ্ছে- তেমনি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে  তাদের জন্যে মিয়ানমারের সামিরিক শাসককে শক্তিশালী করে স্থিতিশীল মিয়ানমার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কারণ পাশের বাড়িতে আগুন লাগলে কিছু না হোক নিজের ছাঁদে প্রতিদিন জল ঢেলে তো একটা সময় নষ্ট করতে হয়।

 

লেখক:রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World.

বেলিস্টেট ও স্যাটেলাইট বা জোন স্টেটগুলোর অর্থনৈতিক কূটনীতি 

০৭:৪৮:১৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪

স্বদেশ রায়

“ মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ তার দেশকে বিপুল অর্থনৈতিক সহায়তা করার জন্যে ভারতকে অকুণ্ঠ ধন্যবাদ জানিয়েছেন”। ( বিবিসি, বাংলা অনলাইন, ৮ অক্টোবর)

মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ ভারত সফরে এসে দ্বিতীয় দিনে সে দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পরে তাঁর দেশের আর্থিক দুরবস্তা কাটানোর জন্যে ভারতীয় সাহায্য নিশ্চিত হবার পরে উপরোক্ত ওই ধন্যবাদ জানান।

মি. মুইজ কোন ধরনের প্রচারের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছিলেন এবং ক্ষমতায় আসার পর পরই তিনি কী কূটনীতি গ্রহন করার চেষ্টা করেছিলেন তা এ মুহূর্তে সকলেই জানেন। কিন্তু যে মহূর্তে তাঁর দেশের মাত্র দেড় মাসের আমদানী ব্যয় মেটানোর সমর্থ আছে এবং দেশের দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে -সে সময়ে তাঁর রাষ্ট্র যে বড় রাষ্ট্র অর্থাৎ ভারতের জোন স্টেট   সেখানেই চলে এসেছেন, অর্থনৈতিক ভাবে তাঁর দেশকে উদ্ধার করার জন্যে।

মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট একথাও বলেছেন, এছাড়া তাঁর দ্বিতীয় কোন পথ নেই। তার প্রথম কারণ আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের সাহায্য প্রার্থীর সংখ্যা এত বেশি- তাছাড়া তাদের প্রায়োরিটিও নির্ভর করে নানান সমীকরণে ( যা এখানে উল্লেখ করতে গেলে লেখার বিষয়বস্তু থেকে ভিন্ন দিকে চলে যাবে) তাই মি. মুইজ আইএম্এফ এর পিছে ঘোরেননি। তাছাড়া মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট দেখতে পাচ্ছেন, শ্রীলংকার গোটাবায়ে সরকার অর্থনৈতিকভাবে ব্যর্থ হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হলে সেখানে শান্তভাবে সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কোন ব্যবসা, বানিজ্য, স্থাপনা বা কোন রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় কোন কিছু ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি। বরং একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিক দেশের দ্বায়িত্ব নিয়ে, পার্লামেন্ট বজায় রেখেও আইএমএফ এর সাহায্য নিয়ে দেশ চালালেও- দেশের সাধারণ মানুষকে খাবার দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। মাত্র মাস দুয়েক আগের বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের এশিয়া বিভাগের একটা নিউজ ছিলো, যা সারাক্ষণেও ছাপা হয়- তীব্র ঝড় বৃষ্টির মধ্যে শ্রীলংকার কয়েকজন সাধারণ পুরুষ ও নারীকে একটি গির্জার দিকে দৌঁড়াতে দেখা যায়। তাদের কাছে গিয়ে রিপোর্টার জানতে পারেন তারা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গির্জায় পৌঁছাতে চায়। কারণ গির্জায় এক বেলা খাবার দেয়। আর এটাই তাদের সারা দিনের খাবার। তাদের যেমন কোন আয় করার সুযোগ নেই,  তেমনি এ মুহূর্তে তাদের খাবার কেনার কোন সমর্থও নেই।

শ্রীলংকার সাধারণ মানুষ তাদের এই কষ্ট পাওয়াকে অভিজ্ঞ রাজনীতিক রনিল বিক্রমসিং-এর ব্যর্থতা হিসেবে ধরে নিয়ে নির্বাচনে তাকে তিন নাম্বারে নামিয়ে এনেছে। এবং সে দেশের অন্যতম পরিবার কেন্দ্রিক রাজনীতির উত্তরাধিকার সাজিদ প্রেমদাসা নির্বাচনে প্রথম দিকে এগিয়ে থাকলেও- দ্বিতীয় রাউন্ড এর গণনায় ও সে দেশের ভোটের পদ্ধতিগত হিসেবের ফলে,  অতি কম পরিচিত বামপন্থী রাজনীতিক প্রেসিডেন্ট হয়েছেন।

বামপন্থী হলেও তিনি তাঁর জোনের বড় রাষ্ট্র ভারতেই তাঁর প্রধানমন্ত্রীকে প্রথম সফরে পাঠাচ্ছেন। তারও মূল উদ্দেশ্য জোনাল রাষ্ট্র হিসেবে আঞ্চলিক বড় রাষ্ট্রের অর্থনীতির সঙ্গে নিজেকে জোড়া। কারণ, দুই বছরের বেশি সময়ে তারা বুঝে গেছে আইএমএফ সাময়িক বেইল আউট করতে পারে কিন্তু দেশের মানুষকে খাবার দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার অর্থনৈতিক কূটনীতি ভিন্ন।

যেমন সাউথ ইস্ট এশিয়ার দেশগুলোর অধিকাংশের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক ভালো। এবং অনেকগুলো দেশে এখনও আমেরিকান সেনা উপস্থিতি রয়েছে ও অনেকের সঙ্গে তাদের নানান সামরিক চুক্তিও আছে। অন্যদিকে এই দেশগুলোর অনেকের সঙ্গে চায়নার সামরিক বা সমুদ্র সীমা নিয়ে এক ধরনের উত্তেজনা আছে।  তারপরেও দেখা যায় এই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে কারো কারো আকার বড় হলেও তারা তাদের জোনের সব থেকে বড় অর্থনৈতিক শক্তি চায়নার সঙ্গে ভিন্ন অর্থনৈতিক কূটনীতি মেইনটেইন করে। যা মূলত তাদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ও মানুষের দুর্ভোগ কমানোর স্বার্থে। এমনকি তারা এই সম্পর্ক কোন কোন ক্ষেত্রে এশিয়ার তৃতীয় বড় অর্থনীতি ভারতের সঙ্গেও বজায় রাখে। এমনকি লাওসে এ সময়ে যে আসিয়ান সামিট হতে যাচ্ছে সেখানে চায়নার প্রতিনিধি’র পাশাপাশি আমেরিকার ফরেণ সেক্রেটারি ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীও থাকছেন।

ঠিক একইভাবে আরব সাগরীয় উপকূলের দেশগুলোতে আমেরিকা ও চায়নার বিনিয়োগ যতই বেশি হোক না কেন সাগর পথে তাদের কাছের দেশ ভারতের সঙ্গে সব সময় তারা ভিন্ন সম্পর্ক মেইনটেইন করে। আর সেটা অর্থনৈতিক কূটনীতির মধ্যে পড়ে। ভারতের যেমন তাদের তেল প্রয়োজন তেমনি তাদের প্রয়োজন ভারতের ফুডগ্রেইন ও দক্ষ মানবসম্পদ। কারণ সেন্ট্রাল এশিয়ার উৎপাদিত খাদ্য সব সময়ই মিডলইস্ট এর জন্যে যথেষ্ট হয়ে ওঠে না।

মি. মইজু পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত। তারপরও তিনি ধর্ম ও প্রতিবেশি বড় রাষ্ট্র বিরোধীতা- এই দুই সস্তা উপাদান রাজনীতির সঙ্গে মিলিয়েছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে খুব দ্রুতই বাস্তবতায় এসে দাঁড়িয়েছেন। এবং তাঁর দেশের মানুষকে বাঁচানোর জন্যে তিনি মানি সোয়াপ নীতি অর্থাৎ ভারত ও মালদ্বীপের মুদ্রার সরাসরি বিনিময়কে চালু করলেন। এমনকি নিজ দেশের ডলার বাঁচানোর জন্যে ভারতীয় রুপাইয়া কার্ডও সে দেশে চালু করার চুক্তি করলেন।

পাকিস্তান আকারে বড় রাষ্ট্র হলেও ভারতের আংশিক বেলিস্টেট। তাছাড়া পাকিস্তানের অন্য যে সীমান্ত সেখানে বানিজ্য’র পথ ও উপাদান কম। বরং পাকিস্তানের বেশি বানিজ্য ও অর্থনৈতিক সুযোগ ভারতের সঙ্গে। যে কারণে তরুণ ও আধুনিক বেনজির ক্ষমতায় এসেই ভারত সফরে আসার পরে প্রথম দুই দেশ কেউ কারো বিরুদ্ধে পারমানবিক শক্তি ব্যবহার করবে না এই চুক্তি করেছিলেন। পাশাপাশি অর্থনৈতিক কূটনীতিতে জোর দেন। কিন্তু পাকিস্তানের ধর্মীয় শক্তি ও অনান্য শক্তির কারণে বেনজির ক্ষমতায় যেমন টিকতে পারেননি কোন বারই বেশি সময়- তেমনি শেষ অবধি তাকে জীবন দিতে হয়েছে। রাজীব, অটল বিহারী বাজপেয়ি, পারভেজ মোশারফ ও মোদি অর্থনৈতিক কূটনীতির দিকে জোর দেবার চেষ্টা করেন। কিন্তু কেউ সফল হননি। যে কারণে ভারতের পশ্চিম সীমান্ত বন্ধই বলা চলে।

কোভিডের আগে যখন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সূচক বেশ উঁচূতে ছিলো, সে সময়ে চায়নায় বসে পাকিস্তানি এক সাংবাদিক বন্ধু বলেছিলেন, তাদের দেশের অর্থনীতি বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে পড়ার বড় একটা কারণ ভারতের সঙ্গে তাদের অর্থনৈতিক বৈরি সম্পর্ক। ভারতের নীতি যদি তাদের পূর্ব বর্ড়ার ও পশ্চিম বর্ডার নিয়ে এক হতো তাহলে পাকিস্তানের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য এমন আকাঁশ ছুঁয়ে যেতো না। প্রসঙ্গটাকে ভিন্ন দিকে ঠেলে দেবার জন্যে বলেছিলাম,  আসলে সার্ক একটিভ থাকলে ভালো হতো। প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাচ্ছি বুঝে তিনি হেসে হাত চেপে ধরে বলেন, ফোরাম আর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক কি এক বিষয়- ফ্রেন্ড?  আর প্রসঙ্গ বাড়ায়নি।

আবার বেলিস্টেট ও স্যাটেলাইট বা জোনস্টেটগুলোর প্রতি তার সংলগ্ন বা জোনের বড় স্টেটগুলোরও একটা দায়ও থাকে। যেমন মিয়ানমারে যে অস্থিতিশীলতা চলছে সেখান থেকে মিয়ানমারকে বের করে আনার বড় দায় সে দেশের মানুষের। তবে চায়না ও ভারতেরও একটা দায় আছে। এমনকি তাদের নিজের প্রয়োজনে ও আঞ্চলিক অর্থনীতির স্বার্থেও এ কাজ তাদের করা প্রযোজন।

মিয়ানমার মূলত সামরিক শাসক শাসিত একটি দেশ। সেখানে ছাত্ররা একবার আন্দোলন করে গণতন্ত্র আনতে গিয়ে ব্যর্থ হয়।  পরে ছাত্র ও ধর্মীয় গোষ্টি মিলে এক পর্যায়ে এক ধরনের গণতন্ত্র আনে। এবং শান্তির নোবেল লরিয়েট সূচি গণতান্ত্রিক নেতা হিসেবে সেখানে ক্ষমতার কিছুটা ভাগ পান। কিন্তু সূচি ক্ষমতা নেবার পর থেকেই দ্রুত ব্যর্থ হতে থাকেন। এবং সেখানে সামরিক শাসকরা যে নৃগোষ্টিগত সমস্যাকে অনেকটা দৈত্যকে বোতলে পুরে রাখার মতো করে রেখেছিলো- সেই বোতলের মুখ অনভজ্ঞিতার কারণে খুলে ফেলেন সূচি। যাহোক, সূচি এখন সে দেশের রাজনীতিতে আর কোন বিষয় নেই। দেশটি এখন গৃহযুদ্ধ কবলিত। পৃথিবীর অনেক শক্তি সে দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপগুলোকে সহায়তা করছে। এবং এভাবে চলতে থাকলে আরো বাড়বে বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ; এমনকি সন্ত্রাসীগ্রুপও। যা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে তাতে খুব শীঘ্র যদি “ আরসা”র মত জঙ্গী সংগঠনগুলো আরো শক্তিশালী হয় তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। তার ফলে ভারত ও বাংলাদেশ সীমান্তে আবারও যদি সেখানকার বাদবাকী রোহিঙ্গাদের যাত্রা করতে হয় তাও খুব বেশি আশ্চর্য হবার কিছু নয়। বরং পরিস্থিতি সেদিকেই যাচ্ছে বলেই প্রতিটি ঘটনা ঈংগিত দিচ্ছে।

তাই চায়না ও ভারত যেমন তাদের নিজেদের স্বার্থে তাদের সীমানা সমস্যা ও বানিজ্য সমস্যা মিটিয়ে নিচ্ছে- তেমনি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে  তাদের জন্যে মিয়ানমারের সামিরিক শাসককে শক্তিশালী করে স্থিতিশীল মিয়ানমার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কারণ পাশের বাড়িতে আগুন লাগলে কিছু না হোক নিজের ছাঁদে প্রতিদিন জল ঢেলে তো একটা সময় নষ্ট করতে হয়।

 

লেখক:রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World.