মণীশ রায়
আন্দোলন মানেই তৃষার কাছে বুকের ভেতর দাউ-দাউ এক উত্তেজনার নাম। নিরন্তর মিছিল, মিটিং, শ্লোগানের সম্মোহন আর রক্তগরম জ্বালাময়ী বক্তৃতার ক্রমাগত অগ্ন্যুৎপাত। বন্ধুরা, ভাইয়েরা, বিপ্লবী জনতা, সংগ্রামী সাথীরা কতোরকম যে সম্বোধন। সব মিলিয়ে উন্মাতাল এক পরিবেশ। গাছ-পাহাড়-বাড়িঘর ভাসানো এক পাহাড়ি ঢল যেন বা। সমতলকে শত্রু ভেবে তছনছ করে ধেয়ে আসা এক ধোঁয়ার কুন্ডলী। কোনকিছু আয়ত্বে নেই, থাকে না কোনদিন।
তৃষা হকের আম্মা রাজিয়া সুলতানা মেয়ের এসব ব্যাপারে বড়ই বিরক্ত খানিকটা ক্ষুব্ধও বটে। তিনি চান মেয়েটা রাজনীতির কূটকচাল থেকে বেরিয়ে ধর্মকর্মে মনোযোগ দিক, বিয়ে-থা করে সংসারী হউক, চাকরি-বাকরির খোঁজ- খবর নিয়ে আয়-রোজগারের একটা প্রশস্ত রাস্তা বের করুক। এখনকার সময়ে সমাজ-সংসারের চোখে যা কিছু সাবলীল-স্বাভাবিক, কন্যার জন্য তিনি মা হয়ে তা-ই চান। তা-ই তো তাঁকে মানায়!
কিন্তু কে শোনে কার কথা? তাঁর তিন ছেলে-মেয়ের ভেতর তৃষা জ্যেষ্ঠ হলেও নিরীহ এই মা-কে সে-ই যখন-তখন দুর্ভাবনার গর্তে ফেলতে চায়। জগতের ভাব-গতিক কিছুই জানতে-বুঝতে চায় না। মনের আনন্দে ঘন বনের ঝর্ণা হয়ে আপন গতিতে ছুটে চলেছে সামনের দিকে। দিগ্বিদিক কোন জ্ঞানই নেই। অথচ ভার্সিটি থেকে এমএ করে গতবছরই তৃষা বেরিয়ে গেছে। তবু এখনও ডাক পেলে ছুটে যায় ভার্সিটি-এলাকার সব প্রতিবাদ-সংগ্রামে। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো এক উন্মদনা।
এগুলো কি এখন ওকে মানায়? নিজের মনে গজগজ করেন রাজিয়া সুলতানা। একবেলা নামাজ কাজা হলে যে মায়ের রাতের ঘুম হারাম হয়ে পড়ে, তার পেটের সন্তান এমন উড়নচণ্ডী হবে তা তিনি ভাবতেও পারেননি। মোবাইলে উম্মে কুলসুম ঝুমকি যেইমাত্র ‘আপা শাহবাগ জমে গেছে। গানে-শ্লোগানে একাকার। শুধু তুমি নেই। তাড়াতাড়ি চলে আসো আপা’ জানাল, ওমনি মাতাল হয়ে পড়ে তৃষা হকের অস্তিত্ব। শরীরের পরতে পরতে ছড়িয়ে পড়ে দামাল এক অনুভব। একবিন্দু অপেক্ষা না করে পাখি হয়ে উড়ে যেতে ইচ্ছে করে শাহবাগের বলক ওঠা আন্দোলনের মাঝখানে। বুকের ভেতর তুমুল আবেগের আতিশয্যে কে যেন কথা কয়ে ওঠে, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা!’ মাথায় সামান্য চিরুনি চালিয়ে আর মুখে থোক থোক পাওডার ছড়িয়ে ঝোলার ভেতর সব ঠিকঠাক রয়েছে কিনা পরখ করতে করতে বেরিয়ে পড়ে তৃষা। কোনদিকে তাকানোর সময় নেই তার। রাজিয়া সুলতানা পিছন থেকে যত ‘হোঁচট খাইয়া পড়বি তো মাইয়া’ বলেন, মেয়ে তত দ্রুত ছুটতে থাকে সামনের দিকে। মুখে বলে,’ পড়ুম না আম্মা। পইড়া যাওনের ধাত আমার না।’
সকাল সকাল ওর আব্বারও বেরনোর সময়। তৈরি হয়ে তিনিও নবাবপুরে নিজের হার্ডওয়ারের দোকানে গিয়ে বসবেন।
চোখের সামনে মেয়ের এই হন্তদন্ত অবস্থা দেখে প্রশ্ন করেন,’ কোথায় যাচ্ছো আম্মা?’ ‘শাহবাগ।’
‘ওইখানে তুমি কি করবা? তুমি না বের অয়া আইছো পড়ালেখা শেষ কইরা? অহন কি কাম?’ দুই বোন আর এক ভাইয়ের ভেতর সে বড়। তাই বাপের আহলাদ খানিকটা বেশি। ‘বের অইলেই কি সব দায়িত্ব চলে যায় আব্বা? আপনি এসব বুঝবেন না। ‘বলে মুচকি একখানা হাসি দিয়ে সে হনহন করে সিড়ি ভেঙে নিচে নামতে থাকে।
আসলাম সাহেব মুখে কিছু বললেন না বটে তবে মেয়ের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে কপালে কুঞ্চন দেখা দিল। চেহারায়ও সেই ছাপ পড়ল। কালো মুখ করে রাজিয়াকে বললেন,’ মাইয়াডা যে কি লইয়া মাইতা রইছে, আল্লাহ জানেন।’ বলে তিনি বেরিয়ে পড়লেন।
স্বামী বাইরে বেরুচ্ছেন বলে কথা বাড়ালেন না রাজিয়া। অন্যসময় হলে মেয়ের বিয়ের কথা বলে খোটা দিতে ছাড়তেন না; ‘তোমার মাইয়ার বয়সে আমি দুই বাইচ্চার মা অইয়া গেছি, কুমিল্লার অত বড় শ্বশুরবাড়ি সামলাইছি ‘ বলে শুরু করতেই আসলাম সাহেব তাঁর বাধা উত্তর বিয়া না বইতে চাইলে আমি কি করতাম? বিয়ার আলাপ তো কম আনলাম না। পছন্দই অয় না তোমার মাইয়ার, আমি কি করুম?’ বলে স্ত্রীকে মাঝপথে থামিয়ে দিতেন। তা সত্বেও, সমস্ত রাগ গিয়ে স্বামীর উপরই পড়ে রাজিয়ার। তুলনায় নিজের আব্বা লাকসামের ভুষিমালের পাইকারি ব্যবসায়ী পরান মুন্সিকে কেন যেন এসময় তুখোড় বুদ্ধিমান লাগে তাঁর। নইলে ওদের চার বোনকে আঠারোর আগে ব্যবসায়ি জামাই দেখে ধরে-বেঁধে কিভাবে বিয়ে দিয়ে দিলেন? ভাবলে গর্বে ভরে ওঠে রাজিয়ার অন্তর। লোহা কাঠের মতো দেখতে নিরস-নির্বিকার আব্বার মুখখানি প্রায়ই ভাসে চোখের সামনে।
তৃষা পাড়ার রাস্তায় পা দিতেই টুম্পাকে পেয়ে গেল। একই মহল্লার বাসিন্দা। তৃষাদের নিজেদের বাড়ি হলেও টুম্পারা ভাড়া-বাসায় থাকে। ওর মতো সে-ও ভার্সিটির দিকে ছুটছে। অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী সে। ওকে দেখামাত্র খলবল করে ওঠে টুম্পা।
‘আপা ভার্সিটিতে যাচ্ছেন? শাহবাগের আন্দোলনে নিশ্চয়ই, না?’
‘হ্যা। তুমি?’
‘একটা ক্লাস আছে আপা। ক্লাস শেষ করে আসব শাহবাগে। আপনার শ্লোগানে গলা মিলাতে চাই।’
‘চল। এমনিতেই দেরি হয়ে যাচ্ছে।’ তাড়া দেয় তৃষা।
ওরা দুজন খিলগাঁর ফ্লাইওভারের নিচে এসে দাঁড়ায়। এই রুটে বেশ কটি ছাল-চামড়া ওঠা বাস নানা পথ ঘুরে গন্তব্যে পৌঁছার আগে শাহবাগকে স্পর্শ করে যায়। কমলাপুর-মতিঝিল-গুলিস্তান ভ্রমণ করে প্রেসক্লাবের সামনে দিয়ে হেলে-দুলে বাসগুলো শাহবাগে থামে। সকালের দিকে ভিড় হয় প্রচণ্ড। গাদাগাদি চাপাচাপি করে বাসে নিজেদের ঠাঁই করে নিতে হয়। মহিলাদের জন্য যে-কটি সীট সংরক্ষিত থাকে সেগুলো এসময় দামড়া পুরুষগুলোর দখলে থাকে; ভিড়ের ভেতর কে যাবে ঝগড়া বাধাতে?
ফেরদৌসী আকতার টুম্পার আব্বা নেই। ভাইদের অভাবী সংসারে মেধাকে উপজীব্য করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাইছে মেয়েটি। একই সঙ্গে স্বাধীনচেতা ও ভীরু স্বভাবের মেয়ে। প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে রয়েছে গাঢ় বন্ধুত্ব। কিন্তু সমাজ, সংস্কার আর কট্টর বিশ্বাসের একরোখা দুরন্ত স্রোতের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে এপথে এগিয়ে চলা যে কত কঠিন তা এদ্দিনে হাড়ে-হাড়ে ওর জানা হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে তৃষার কাছে টুম্পা সেকথা স্বীকার করে দীর্ঘশ্বাস চাপে। হতাশা মেশা গলায় বলে, আপা, এত চাপে থেকে নিজের শখ-স্বকীয়তা ধরে রাখা খুব মুশকিল। খুব মুশকিল আপা!’
‘দেশের বাইরে চলে যাও? পুরো জীবন পড়ে রয়েছে।’ হালকা গলায় পথ বাতলে দেয় জুনিয়রকে।
‘আপা যে কি বলেন? টাকা দেবে কে? ভাই-ভাবীদের অনুগ্রহ নিয়ে স্কলারশীপে ভার্সিটিতে পড়তে পারছি। তাই কতো।’ মেয়েটির চেহারা কালো হয়ে যায় অজানা যন্ত্রণায়। তৃষার দুধে-ভাতে বড় হওয়া জীবন; টুম্পার নিত্যদিনের এসব দুঃখ-গাথা ওর বোঝার কথা নয়। তবু সে অনেকখানি চেষ্টা করে টুম্পাকে বোঝার। পরম মমতা ও ভালবাসা মিশে থাকে সেই চেষ্টায়।
বাস-স্টেশনে দাঁড়িয়ে নানা কথা মনে হচ্ছিল তৃষার। এসময় ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে একটি বাস এসে দাঁড়াল ওদের সামনে। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল বাস ঘিরে হুমড়ি খাওয়া বাদুড়ঝোলা কাণ্ডজ্ঞানশূন্য মানুষের উদভ্রান্ত হুটোপুটি। এক বিন্দু জায়গা নেই কোথাও। তারপরও কণ্ডাক্টরের পীড়াপীড়ি। ‘চইলা আসেন আপা। ভিতরে জাগা আছে। উঠলেই জাগা অইবো। ঠ্যালার নাম বাবা।’ বলে জোর করে ঘাড় ধরে ওদের ঢুকিয়ে দিতে চায় বাসের পেটে। টুম্পা বলে, আপা একটু অপেক্ষা করি আরেকটা বাসের জন্য?
‘তা ঠিক।’ বলে তৃষা চুপ হয়ে গেল। ওর ভ্যানিটি ব্যাগে মোট দুশো টাকার মতো রয়েছে। চাইলে সিএনজি কিংবা রিক্সা নিতে পারে। কিন্তু টুম্পাকে পেয়ে আজ বড় ইচ্ছে করছে বাসে চড়তে। কথা বলতে বলতে যাওয়া যাবে। সেই কবে বাসে চড়েছে, মনেই পড়ে না। হাতের মুঠোয় নির্ভেজাল এ্যাডভেঞ্চারের এ সুযোগ কে ছাড়ে?
পনেরো-বিশ মিনিট বাদে দ্বিতীয় যে বাসটি ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল, সেটির অবস্থা আরো টাল-মাটাল। মানুষের ভারে একদিকে কাত হয়ে পথ চলছে। মনে হচ্ছে যে কোন সময় হেলে পড়বে একদিকে। কিন্তু উপায় নেই। ঠেসেঠুসে যে করেই হউক নিজের জায়গা করে নিতে হবে এর ভুড়ির ভেতর। নইলে সারাদিনেও আর যাওয়া হয়ে উঠবে না। এখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে হবে ইট-পাথরের মতো।
অভ্যস্ত টুম্পা প্রথমেই হ্যান্ডেল ধরে বাসের পা-দানিতে ডান পা দিল। পা রাখার মতো কয়েক ইঞ্চি জায়গা বের করে কাতর কণ্ঠে বলে ওঠে, আপা, পা দেন। নইলে জিন্দিগিতেও উঠতে পারবেন না বাসে।’
তৃষার টাউন-বাসে চড়ার খুব একটা অভ্যেস নেই। সচরাচর রিক্সা-সিএনজি করেই সে ভার্সিটিতে যাওয়া-আসা করে। বিশেষ তাড়হুড়ো থাকলে উব্যার-এর শরণ নেয়। টুম্পাকে পেয়ে আচমকা বাসে চড়ার ইচ্ছেটা আজ মাথায় চেপে বসে। এখন চোখের সামনে বাসে ওঠার তুমুল হুড়োহুড়ি লক্ষ্য করে তৃষা খানিকটা দমে যায়। কী করবে বুঝতে পারে না। ‘আপা, তাড়াতাড়ি করেন?’ পুনরায় টুম্পার চিৎকারে সম্বিৎ ফিরে পায় তৃষা। কিছুটা সন্ত্রস্ত ও উদ্যমী হয়ে এক পা বাসের চিপা পা-দানিতে দিয়ে, অন্য হাতে হ্যান্ডেল ধরে একসময় ঠিকই বাসে সে দাঁড়িয়ে গেল। একটি
পা তখনও ঝুলে রয়েছে পাদানির বাইরে। পায়ের চটি যেকোন সময় রাস্তায় ভূপাতিত হবার সম্ভাবনা রয়েছে অথবা সামান্য চাপ খেলে চলন্ত বাস থেকেই পড়ে যেতে পারে সে নিজে। এমনি গা হিম করা অবস্থান ওর।
ধীরে ধীরে অভ্যস্ত বাসযাত্রীর মতো ‘ভাইয়া প্লিজ, একটু জায়গা দেন না’ জাতীয় অনুরোধ-উপরোধের বন্যা বইয়ে, ভিড়ের ভেতর নিজেকে সেঁধিয়ে, একপা-দুপা করে এগিয়ে দরজা থেকে মূল পাটাতনে এসে পা রাখল তৃষা। শরীর কাঁপছে রীতিমতো। আপাতত দূর্ঘটনার হাত থেকে বেঁচে গেছে ভেবে সে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে দমবন্ধ হাঁসফাস ভিড়ের ভেতর। তৃষার চোখের সামনে মেয়েদের যে কটি সংরক্ষিত আসন রয়েছে, সবগুলোয় বসে রয়েছে বেঢপ চেহারার ফালতু টাইপের কিছু পুরুষমানুষ। দেখার পর এদের কোন অনুরোধ জানাতে ইচ্ছেই হয় না। টুম্পা টের পেয়ে ফিসফিস করে বলে উঠল, আপা এদের জায়গা ছাড়ার অনুরোধ করে কোন লাভ নেই। ওরা জেনে-বুঝেই এখানে এসে জায়গা দখল করে বসেছে। ইচ্ছে করে ঝগড়া বাধাবে। উল্টা-পাল্টা সব কথা বলবে। খুব দেখা আছে। বদমায়েশ সবগুলো।’
অগত্যা তেলচটচটে, ছেঁড়া, ময়লা ও দুর্গন্ধে ভরা সীট-কভারে ঢাকা মরচে পড়া লোহা আঁকড়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে তৃষা ও টুম্পা। বাসটি এক-একটি স্টেশনে থামছে আর দুদ্দাড় করে কাউকে নামতে না দিয়ে লোকজন বাসে উঠে পড়ছে। একইভাবে কিছু লোক বাসের ভেতর থেকে কাউকে কনুই মেরে, কারো শরীরে গুঁতো দিয়ে ঝগড়া করতে করতে দরজার দিকে এগোতে চাইছে। মাঝখান থেকে তৃষা-টুম্পা দুজন ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো সব সহ্য করে অসহায়ভাবে দোল খেতে থাকে ডানে-বাঁয়ে।
এসব নিয়ে বাসের ভেতর যখন ওরা ব্যতিব্যস্ত, শরীর-মন জুড়ে যখন একধরনের ঘিনঘিনে অনুভব, তখনই মনে হল, কোন একটি কর্কশ হাত এসে পিঠে পড়েছে তৃষার। হাতটি ধীরে ধীরে সন্তর্পণে নিচের দিকে নামছে। একসময় এমন এক জায়গায় এসে কুৎসিত হাতটি স্থির হল যে তৃষা চরম বিতৃষ্ণায় গা-ঝাড়া দিয়ে উঠল। পিছনে তাকিয়ে সে দেখার চেষ্টা করল দুর্বৃত্তটিকে। হতবাক হয়ে গেল লোকটিকে দেখে। ওর আব্বার বয়সী এক পুরুষ। রীতমতো ভদ্রলোক। চোখাচোখি হতেই তৃষা দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। লজ্জা ও ঘৃণায় রি-রি করে উঠল শরীর-মন সব। লোকটির ঘর্মাক্ত মুখের পরতে পরতে অশ্লীল হাসির ছটা চোখের সামনে চেহারাটি যেন উল্কি-কাটা কদর্য এক ছবি হয়ে গেঁথে রইল মনে। অথচ চোখাচোখির পর লোকটি বেমালুম বদলে গেল; নোংরা হাতটি থামিয়ে এমন ভাব করল যে সে কিছুই জানে না। যেন ঘুমের ভেতর হেঁটে বেড়িয়েছে এতক্ষণ। মুখ দিয়ে গিজগিজ করা অন্যদের ধমক দিয়ে বলে উঠল, আরে ভাই, একটু সরে দাঁড়ান না। দেখতে পাচ্ছেন না মহিলা? ঘরে কি মা-বোন নাই?’ টুম্পা ওর হাত চেপে ধরল। ফিসফিস করে বলে উঠল,’ আপা বাসের পরিস্থিতি খারাপ। নেমে যাবো?’ ‘এ অবস্থায় ভিড় ঠেলে নামতে পারব আমরা? তুমি তো এ পথে রেগুলার যাওয়া আসা কর। তোমার কি মত?’ ‘আমারও একই মত। এতো ভিড় ঠেলে নামা কঠিন হবে আপা।’
বলতে না বলতে ‘উঃ’ বলে টুম্পা চাপা গলায় চেঁচিয়ে উঠল। তৃষা ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকাল। টুম্পার চোখে চিকচিক করছে জল। মুখে-চোখে কাতর এক অভিব্যক্তি। হয়তো শরীরের কোন অঙ্গে প্রচণ্ড চাপ খেয়েছে মেয়েটা। তৃষার মনে হল এক্ষুণি নেমে যাবে বাস থেকে। কিন্তু এমন ঠাসাঠাসি ভিড়ের ভেতর থেকে আধা ইঞ্চিও সরার উপায় নেই। অগত্যা অসহায় এক আর্তি ফুটে ওঠে ওর চোখেমুখে।
যাত্রী বোঝাই বাসটি এক-একটি স্থানে থামছে আর কিছু সুযোগসন্ধানী পুরুষ ইচ্ছে করে নামার সময় ওদের দুজনকে বস্তার মতো শরীরের যেখানে-সেখানে চেপে যাচ্ছে। পরক্ষণে অন্যদল যারা বাসের ভেতর নতুন করে ঢুকছে , তাদের কেউ কেউ এমন অসভ্যভাবে ওদের দিকে তাকাচ্ছে যে মনে হবে ওরা রেড-লাইট এরিয়ার বাসিন্দা; সুযোগ পেলে ওই লোকগুলো হয়তো এখানেই ওদের রেপ করে ফেলত, এমনিতরো কসাই-চাহনি ওদের চোখে! এতোটা মানসিক চাপ নিতে পারছে না তৃষার মন বারবার নেতিয়ে পড়ছে অবসাদে। ভাদ্রমাসের কড়া রোদ বাইরে। টিনের বাসটি আগুনের গোলা হয়ে রয়েছে সেই তাপে। বাতাসে প্রচুর জলকণা। ঘামে সমস্ত শরীর ভিজে জবজবে। গরমের অসহ্য তাপে মনে হচ্ছে, শরীর বুঝি এক্ষুণি দাউ দাউ করে জ্বলে উঠবে।
সামান্য প্রশান্তির আশায় তৃষা চোখ বন্ধ করে শাহবাগের কথা ভাবে। কী বলবে সেখানে? ‘কোনকালে একা হয় নিকো জয়ী পুরুষের তরবারি?’ ‘তোমরা আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতি দেব?’ ‘এই হোক অঙ্গীকার / নারী নির্যাতন নয় আর? ‘ ‘নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করি / সমতার সমাজ গড়ে তুলি?’ ‘বদলে দেবার সময় এখন /গ্রাম-শহরের নারীর জীবন?’ সব মুখস্থ তৃষার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে বলতে পারে নারীমুক্তি অথবা তাঁদের প্রতি অত্যাচার-নির্যাতন-নিগ্রহ কিংবা বৈষম্য নিয়ে। বস্তুকারখানার নারীদের বেতন বৈষম্য নিয়ে এ আয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলোও সোচ্চার হয়েছে তাদের দাবির সঙ্গে। তৃষা সেখানেই যাচ্ছে পুরনো টানে।
টুম্পা এসময় সামনের একটি সীট দেখিয়ে বলে উঠল, আপা এ লোকটা বোধ হয় নেমে যাবে। বসবেন?’
‘তোমার সঙ্গেই থাকব। বসলে দুজন একসঙ্গেই বসব।’
‘সেটা বোধ হয় সম্ভব হবে না আপা।’
‘তাহলে চুপ করে দাঁড়িয়েই থাকো।’
তৃষা আবার টের পেল কেউ ওর পৃষ্ঠদেশে শরীর ঘষছে। চটজলদি সে ফিরে তাকায়। দেখতে পায়, লুঙ্গি-গেঞ্জি পরা উদভ্রান্ত এক কিশোর ওর গা-ঘেঁষে দাঁড়ানো। সে-ই মৈথুনের স্বাদ নিতে চাইছে ওর গায়ের সঙ্গে গা ঘেঁষে। প্রচণ্ড ঘৃণায় ফের রিরি করে উঠল শরীর। মনে হল ঘুরে দাঁড়িয়ে কষে একটা চড় বসাতে। কিন্তু সামাজিক অবস্থা ও আভিজাত্যবোধ ওকে বাঁধা দেয়। ফিসফিস করে বলে, সবাই তোমাকেই খারাপ বলবে। পোকার মতো তোমার সাজানো-গুছানো চরিত্রটি খেয়ে দেবে। বুঝলা?’ অগত্যা টুম্পাকে নিয়ে বাস ছেড়ে মাঝ রাস্তায় নেমে পড়ে তৃষা। বুক ভরে নিশ্বাস নেয় দুজন। তৃষা বলে, বাসে এগুলো হয়? কেউ কিছু বলে না?’
আপনি তো রিক্সায় যান ভার্সিটিতে। তাই টের পাননা। সমাজটা আপা নষ্ট হয়ে গেছে। বাসায় ফিরে গোসল করতে ‘
হয়। এমনি ঘিনঘিনে লাগে।’
‘পিটানো যায় না?’
‘কজনকে পিটাবেন আপা? আপনি নিজে পেরেছেন পিটাতে, বলেন?’
তৃষা এ প্রশ্নে চুপ হয়ে যায়। সে নিজেও তো প্রতিবাদ করতে পারেনি। এ দায় তাহলে কার?
ওরা একটা রিক্সায় চেপে ক্যাম্পাসে চলে এল। টুম্পা বিদায় নিয়ে চলে গেল ক্লাসে। যাওয়ার আগে বলল,’ ক্লাস শেষ করে চলে আসব আপা।
তৃষা শাহবাগের মোড়ে এসে দাঁড়ায়। জাদুঘরের সামনে খুব জমে গেছে প্রতিবাদ সভা। ঝুমকি চেঁচিয়ে বলছে,’ তুমি কে? আমি কে’ সবাই তারস্বরে উত্তর দিচ্ছে, মায়ের দল, বোনের দল।’
‘তোমার আমার অঙ্গীকার’ এবার শ্লোগান দিচ্ছে তৃষা, সবাই গলা মিলাচ্ছে, পুরুষ নারী একাকার।’ ফের ‘তুমি কে, আমি কে?’ প্রশ্ন করতেই গলা হাঁকাচ্ছে সবাই, কন্যা, জায়া, জননী। কন্যা, জায়া জননী।
‘তোমার আমার অঙ্গীকার’ শ্লোগান দিচ্ছে তৃষা, সবাই বলছে, বেতন বৈষম্য নেই আর।’
‘তোমার আমার অঙ্গীকার, নারী হবে মা সবার।’
একসময় তৃষা থামে। চা পানের জন্য ফুটপাথে গিয়ে দাঁড়ায়।
ঝুমকি একেবারে গদগদ। মুখে বলে, আপা তুমি আসায় খুব জমে গেছে সভা।’
‘তাই?’
‘তুমি আবার অরণী আপার মতো বিয়ে করে কানাডায় চলে যাবে নাতো?’
‘এ প্রশ্ন তো আমারও তোদের প্রতি। তোরা যাবি নাতো?’
‘প্রশ্নই আসে না। এদেশকে বাসযোগ্য করে তবে ছাড়বো। নারীরা যেন ঢাকার রাস্তায় রাত বারোটা পর্যন্ত নির্বিঘ্নে আনন্দে হেঁটে বেড়াতে পারে, সেই চেষ্টা করব। ঠিক না আপা? সবাই আমেরিকা কানাডা অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেলে কে ঠিক করবে এদেশটাকে আপা?’ বেশ আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠে ঝুমকির কণ্ঠ। ও নিজে বেতার-টিভিতে নজরুল গীতি গায়। সরকারি কর্মকর্তার কন্যা। কিন্তু কোন দেমাগ নেই। খুবই অমায়িক ও উচ্ছল স্বভাব ওর। ফের ঝুমকি প্রশ্ন করে,’ এদেশে থাকবে তো আপা?’
একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তৃষা উত্তর দেয়,’ বলতে পারি না ভাই। নারীর ভাগ্য পদ্মপাতার জল।’ বলে খিল খিল করে হেসে ওঠে সে। ঝুমকি কৌতুক ভেবে সে হাসিতে যোগ দেয়।
সহসা অদূরে দুজন পুরুষকে চোখে পড়ে তৃষার। ঠ্যালাগাড়ির উপর হাঁটু গেড়ে বসা। পরনে লুঙ্গি আর গেঞ্জি। ঘাম জবজবে পুরনো জামগাছের গুড়ির মতো চেহারা-সুরত বয়স খুব একটা বেশি হবে বলে মনে হল না। জাবর কাটার মতো গুড়-রুটি চিবোচ্ছে আর অশ্লীল এক দৃষ্টি তাক করে রেখেছে ওদের দিকে। তৃষার বোঝার ভুল হলে হতেও পারে। কিন্তু ওদের দিকে তাকাতেই ওর শরীর গুলিয়ে ওঠে। সহসা বাসের কথা মনে পড়ে গেল। দু-পা এগিয়ে ওদের দুগালে জুতা বসিয়ে দিতে ইচ্ছে হল। বেশিরভাগ পুরুষের শরীরগুলোই কি এরকম পুঁতিগন্ধময় অশ্লীল কামের নর্দমা? ভালোবাসা-স্নেহ-মমতাগুলো কি শুধুই চোখের কাজল, ধুলেই শেষ? পরক্ষণে নিজেকে সামলে নেয় তৃষা। রাজিয়া সুলতানার ভুরু-কোঁচকানো মহাবিরক্ত চেহারাটি ঘনঘন ভাসে চোখের সামনে,’ বয়স পইড়া গেলে তরে বিয়া করবো কোন্ বেডায়, এ্যা।’
অগত্যা রেগে গিয়েও নিজেকে শেষ পর্যন্ত মানিয়ে নেবার চেষ্টা করে তৃষা। বুকের ভেতর ঠিকই থেকে যায় পরাজিতের নিষ্ফলা এক কষ্ট, বুক চিরে অকারণে যা বেরিয়ে পড়তে চায় বাইরে। কি ভেবে অদ্ভুত অচেনা গ্রাফিতির মতো সহসা ঝুমকিকে বিড়বিড় করে তৃষা বলে ওঠে, চলে যা ঝুমকি। পালিয়ে চলে যা। নইলে মরে যাবি।
ঝুমকি শুনতে পায় না। শুধু অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে তুখোড় প্রতিবাদী এ আপার দিকে। সে ভাবে তৃষা আপার মাথায় নিশ্চয় নতুন কোন শ্লোগানের ছন্দ ঝংকার তুলছে। আপার আনমনা উদাসীনতা নিশ্চয়ই নতুন কোন শ্লোগানের জন্ম দেবে।
সেটা কি ‘লড়াই, লড়াই, লড়াই চাই/ লড়াই করে বাঁচতে চাই’ জাতীয় উদ্দীপক কোন নতুন শ্লোগান?