০২:৪৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

গণৎকার

  • Sarakhon Report
  • ০৭:০০:৫১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪
  • 23
আবু ইসহাক
ভাগ্য-গণনায় অনেকেই বিশ্বাস করে, কিন্তু ইলিয়াস করে না। এই অবিশ্বাস করার বিশ্বাস তার মনে জন্ম নিয়েছে বাল্যকালেই। সে তখন সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। একদিন স্কুল থেকে ফিরেই সে দেখে, তাদের পুকুরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণের তিন-নারকেলগাছের ছায়াঘেরা ত্রিভুজপ্রায় তার প্রিয় জায়গাটায় গাঁয়ের ছেলে-ছোঁকরাদের জটলা। কাছে গিয়ে আরো দেখে, হায়দার-চাচার হাত দেখছে এক অপরিচিত গণৎকার। হায়দার-চাচা কত দিন বাঁচবেন, ক’টা বিয়ে করবেন, ক’টা ছেলে আর ক’টা মেয়ে হবে ইত্যাদি কী সব বলছিল গণকঠাকুর, সে-সব আর এখন মনে নেই ইলিয়াসের। তবে চাচা যে সোয়া পাঁচ আনা গণৎকারকে দিয়েছিলেন তা তার স্পষ্ট মনে আছে।
সোয়া পাঁচ আনার তখন অনেক দাম। ১৯৩৮ সালে ঐ পয়সায় তখন চার সের বালাম চাল পাওয়া যেত, সাত সের দুধ পাওয়া যেত, দেড় সের রসগোল্লা পাওয়া যেত। আর এখন ২০০০ সালে সোয়া পাঁচ আনায় অর্থাৎ তেত্রিশ পয়সায় রসগোল্লার সিকি গোল্লাও পাওয়া যায় না।
ইলিয়াসের বয়সী একটা ছেলে গণকঠাকুরের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়।
-পাঁচ পয়সা বার কর। পয়সা ছাড়া আমি হাত দেখি না। গণকঠাকুর বলে। পাঁচ পয়সা দিতেই সে তার হাত দেখতে শুরু করে। পাঁচ পয়সার বদলে সে বেশি কিছু বলে না। ছেলেটার দু’-একটা নসিবের কথা বলার পর সে বলে, তোর পেটে সাতটা কৃমি আছে। মাঝে মাঝে পেটব্যথা করে, তা-ই না? -হঁ করে।
পাঁচ পয়সা করে দর্শনী নিয়ে গণকঠাকুর আরো কয়েকটি ছেলের হাত দেখে। সবারই পেটে নাকি পাঁচ-সাত-দশটা করে কৃমি আছে। হাত দেখাবার লোভ ইলিয়াসও সংবরণ করতে পারে না। পাঁচটা পয়সা গণকঠাকুরকে দিয়ে সে তার হাত বাড়িয়ে দেয়, দেখুন তো, আমি পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে পারব কি না।
সে বেশ কিছুক্ষণ ইলিয়াসের হাত দেখে বলে, উঁহু, ফাস্টো হতে পারবে না। তবে ভালো নম্বর পেয়ে পাস করবে। আর তুমি একান্ন বছর বাঁচবে। পনেরো বছরের সময় তোমার ওপর শনির দৃষ্টি পড়বে। তোমার সাঙ্ঘাতিক অসুখ হবে। তুমি মরতে মরতে বেঁচে যাবে। আরো একটা ফাঁড়া আছে একুশ বছরের সময়। তারপর আর ফাঁড়া নেই।
বাকি জীবন মোটামুটি সুখে-শান্তিতে কাটবে। সে একটু থেমে ইলিয়াসের পেটের ওপর তর্জনীর গুঁতো দিয়ে আবার বলে, তোমার পেটেও পাঁচটা কৃমি আছে।
শনির দৃষ্টি আর ফাঁড়ার কথা শুনে ইলিয়াসের মনে কোনো দুশ্চিন্তাই ঠাঁই পায় না। তার দুশ্চিন্তা হলো পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে পারবে না শুনে।
ইলিয়াসের হাত দেখা হয়ে গেলে হায়দার-চাচা বলেন,- আচ্ছা ঠাকুরমশাই, এই পুকুরটায় ক’টা রুই আর ক’টা কাতলা আছে বলতে পারবেন?
-কেন পারব না।
-তবে বলুন না, ক’টা রুই আর ক’টা কাতলা আছে?
-পয়সা ফেলো, বলছি।
হায়দার-চাচা পাঁচ পয়সা দেন গনৎস্কারকে। সে পুকুরের ঘাটে নেমে পানিতে টোকা মারে কয়েক বার। আঁজলা ভরে পানি তুলে নাকের কাছে নিয়ে শোঁকে। তারপর গম্ভীর কন্ঠে বলে, ‘রুই আছে চার শ’ তেত্রিশটা, আর কাতলা আছে তিন শ’ দশটা।
ইলিয়াসের মাথায় হঠাৎ খেলে যায় একটা দুষ্ট বুদ্ধি। এক দৌড়ে সে ঘরে যায়। শিকেয় ঝুলিয়ে রাখা একটা পাকা শসা ও একটা দা নিয়ে সে ফিরে আসে। গণৎকার তখন আরেকজনের হাত দেখছে।
তার হাত দেখা শেষ হলে পাঁচ পয়সা ও শসাটা গণৎকারের দিকে বাড়িয়ে ধরে ইলিয়াস বলে, ঠাকুরমশাই, এই শসাটার মধ্যে কতগুলো দানা আছে, বলুন তো?
গনৎকার হেঁ-হেঁ-হেঁ করে হেসে বলে, বলতে পারি, তবে শসাটা আমাকে দিতে
হবে।
-না, শসাটা দিতে পারব না।
-তবে আমিও বলতে পারব না।
গনৎকার তার ঝোলা কাঁধে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে।
ইলিয়াস সবাইকে নিয়ে তাকে ঘিরে ধরে। তাদের এককথা, শশার ভেতর
কতগুলো দানা আছে বলে যেতে হবে ঠাকুরমশাই।
হায়দার-চাচা বলেন, কার পেটে ক’টা কৃমি আছে, পুকুরে ক’টা রুই-কাতলা আছে-সব বলতে পারলেন, আর শসার ভিতর কতগুলো দানা আছে, তা বলতে পারবেন না!
-পারব না কেন। আজ আর সময় নেই। আরেকদিন এসে বলব।
-না, আজই আপনাকে বলে যেতে হবে। নয় তো সবার পয়সা ফেরত দিতে হবে। বেশ জোর দিয়েই বলে ইলিয়াস।
গণৎকার শসাটা হাতে নিয়ে শসার গায়ের ওপর আঙুল চালায় কিছুক্ষণ। তারপর বেশ গম্ভীর কণ্ঠে বলে, এটার মধ্যে দু-শ’ ছাপ্পান্নটা দানা আছে।
ইলিয়াস দা দিয়ে শসাটা কাটতে যাবে, অমনি গণৎকার বাধা দিয়ে বলে, একটু দেরি করো, আমি এখনি আসছি। শসাটা আমার সামনে কেটে দানা গুণতে হবে।
গণৎকার তার ঝোলা থেকে একটা ঘটি বের করে। পুকুর থেকে সেটায় পানি ভরে সে ঝোলা কাঁধে নিয়ে পশ্চিম দিকের বাঁশবাগানের দিকে চলে যায়।
তার ফিরে আসতে অস্বাভাবিক দেরি দেখে সবাই হইচই করতে করতে বাঁশবাগানে গিয়ে তন্নতন্ন করে খোঁজে। কিন্তু গণৎকারকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
শেষে ইলিয়াস সবার সামনে শসাটা কেটে দানাগুলো গুণে ফেলে। মোট তিন শ’ একাত্তরটা দানা পাওয়া যায়। অথচ গণৎকার বলেছিল শসা। ভেতর দু-শ’ ছাপ্পান্নটা দানা আছে।
কয়েক মাস পরে ইলিয়াস বার্ষিক পরীক্ষা দেয়। গণৎকারের ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যে করে দিয়ে পরীক্ষায় সে-ই ফার্স্ট হয়েছিল।
খালিশপুর, খুলনা মার্চ, ১৯৭৫

সুপ্রিম কোর্টের রায়কে পাশ কাটানোর কৌশল খুঁজছে বিচারকরা, ফেরাতে পারবে কি USAID

গণৎকার

০৭:০০:৫১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪
আবু ইসহাক
ভাগ্য-গণনায় অনেকেই বিশ্বাস করে, কিন্তু ইলিয়াস করে না। এই অবিশ্বাস করার বিশ্বাস তার মনে জন্ম নিয়েছে বাল্যকালেই। সে তখন সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। একদিন স্কুল থেকে ফিরেই সে দেখে, তাদের পুকুরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণের তিন-নারকেলগাছের ছায়াঘেরা ত্রিভুজপ্রায় তার প্রিয় জায়গাটায় গাঁয়ের ছেলে-ছোঁকরাদের জটলা। কাছে গিয়ে আরো দেখে, হায়দার-চাচার হাত দেখছে এক অপরিচিত গণৎকার। হায়দার-চাচা কত দিন বাঁচবেন, ক’টা বিয়ে করবেন, ক’টা ছেলে আর ক’টা মেয়ে হবে ইত্যাদি কী সব বলছিল গণকঠাকুর, সে-সব আর এখন মনে নেই ইলিয়াসের। তবে চাচা যে সোয়া পাঁচ আনা গণৎকারকে দিয়েছিলেন তা তার স্পষ্ট মনে আছে।
সোয়া পাঁচ আনার তখন অনেক দাম। ১৯৩৮ সালে ঐ পয়সায় তখন চার সের বালাম চাল পাওয়া যেত, সাত সের দুধ পাওয়া যেত, দেড় সের রসগোল্লা পাওয়া যেত। আর এখন ২০০০ সালে সোয়া পাঁচ আনায় অর্থাৎ তেত্রিশ পয়সায় রসগোল্লার সিকি গোল্লাও পাওয়া যায় না।
ইলিয়াসের বয়সী একটা ছেলে গণকঠাকুরের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়।
-পাঁচ পয়সা বার কর। পয়সা ছাড়া আমি হাত দেখি না। গণকঠাকুর বলে। পাঁচ পয়সা দিতেই সে তার হাত দেখতে শুরু করে। পাঁচ পয়সার বদলে সে বেশি কিছু বলে না। ছেলেটার দু’-একটা নসিবের কথা বলার পর সে বলে, তোর পেটে সাতটা কৃমি আছে। মাঝে মাঝে পেটব্যথা করে, তা-ই না? -হঁ করে।
পাঁচ পয়সা করে দর্শনী নিয়ে গণকঠাকুর আরো কয়েকটি ছেলের হাত দেখে। সবারই পেটে নাকি পাঁচ-সাত-দশটা করে কৃমি আছে। হাত দেখাবার লোভ ইলিয়াসও সংবরণ করতে পারে না। পাঁচটা পয়সা গণকঠাকুরকে দিয়ে সে তার হাত বাড়িয়ে দেয়, দেখুন তো, আমি পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে পারব কি না।
সে বেশ কিছুক্ষণ ইলিয়াসের হাত দেখে বলে, উঁহু, ফাস্টো হতে পারবে না। তবে ভালো নম্বর পেয়ে পাস করবে। আর তুমি একান্ন বছর বাঁচবে। পনেরো বছরের সময় তোমার ওপর শনির দৃষ্টি পড়বে। তোমার সাঙ্ঘাতিক অসুখ হবে। তুমি মরতে মরতে বেঁচে যাবে। আরো একটা ফাঁড়া আছে একুশ বছরের সময়। তারপর আর ফাঁড়া নেই।
বাকি জীবন মোটামুটি সুখে-শান্তিতে কাটবে। সে একটু থেমে ইলিয়াসের পেটের ওপর তর্জনীর গুঁতো দিয়ে আবার বলে, তোমার পেটেও পাঁচটা কৃমি আছে।
শনির দৃষ্টি আর ফাঁড়ার কথা শুনে ইলিয়াসের মনে কোনো দুশ্চিন্তাই ঠাঁই পায় না। তার দুশ্চিন্তা হলো পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে পারবে না শুনে।
ইলিয়াসের হাত দেখা হয়ে গেলে হায়দার-চাচা বলেন,- আচ্ছা ঠাকুরমশাই, এই পুকুরটায় ক’টা রুই আর ক’টা কাতলা আছে বলতে পারবেন?
-কেন পারব না।
-তবে বলুন না, ক’টা রুই আর ক’টা কাতলা আছে?
-পয়সা ফেলো, বলছি।
হায়দার-চাচা পাঁচ পয়সা দেন গনৎস্কারকে। সে পুকুরের ঘাটে নেমে পানিতে টোকা মারে কয়েক বার। আঁজলা ভরে পানি তুলে নাকের কাছে নিয়ে শোঁকে। তারপর গম্ভীর কন্ঠে বলে, ‘রুই আছে চার শ’ তেত্রিশটা, আর কাতলা আছে তিন শ’ দশটা।
ইলিয়াসের মাথায় হঠাৎ খেলে যায় একটা দুষ্ট বুদ্ধি। এক দৌড়ে সে ঘরে যায়। শিকেয় ঝুলিয়ে রাখা একটা পাকা শসা ও একটা দা নিয়ে সে ফিরে আসে। গণৎকার তখন আরেকজনের হাত দেখছে।
তার হাত দেখা শেষ হলে পাঁচ পয়সা ও শসাটা গণৎকারের দিকে বাড়িয়ে ধরে ইলিয়াস বলে, ঠাকুরমশাই, এই শসাটার মধ্যে কতগুলো দানা আছে, বলুন তো?
গনৎকার হেঁ-হেঁ-হেঁ করে হেসে বলে, বলতে পারি, তবে শসাটা আমাকে দিতে
হবে।
-না, শসাটা দিতে পারব না।
-তবে আমিও বলতে পারব না।
গনৎকার তার ঝোলা কাঁধে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে।
ইলিয়াস সবাইকে নিয়ে তাকে ঘিরে ধরে। তাদের এককথা, শশার ভেতর
কতগুলো দানা আছে বলে যেতে হবে ঠাকুরমশাই।
হায়দার-চাচা বলেন, কার পেটে ক’টা কৃমি আছে, পুকুরে ক’টা রুই-কাতলা আছে-সব বলতে পারলেন, আর শসার ভিতর কতগুলো দানা আছে, তা বলতে পারবেন না!
-পারব না কেন। আজ আর সময় নেই। আরেকদিন এসে বলব।
-না, আজই আপনাকে বলে যেতে হবে। নয় তো সবার পয়সা ফেরত দিতে হবে। বেশ জোর দিয়েই বলে ইলিয়াস।
গণৎকার শসাটা হাতে নিয়ে শসার গায়ের ওপর আঙুল চালায় কিছুক্ষণ। তারপর বেশ গম্ভীর কণ্ঠে বলে, এটার মধ্যে দু-শ’ ছাপ্পান্নটা দানা আছে।
ইলিয়াস দা দিয়ে শসাটা কাটতে যাবে, অমনি গণৎকার বাধা দিয়ে বলে, একটু দেরি করো, আমি এখনি আসছি। শসাটা আমার সামনে কেটে দানা গুণতে হবে।
গণৎকার তার ঝোলা থেকে একটা ঘটি বের করে। পুকুর থেকে সেটায় পানি ভরে সে ঝোলা কাঁধে নিয়ে পশ্চিম দিকের বাঁশবাগানের দিকে চলে যায়।
তার ফিরে আসতে অস্বাভাবিক দেরি দেখে সবাই হইচই করতে করতে বাঁশবাগানে গিয়ে তন্নতন্ন করে খোঁজে। কিন্তু গণৎকারকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।
শেষে ইলিয়াস সবার সামনে শসাটা কেটে দানাগুলো গুণে ফেলে। মোট তিন শ’ একাত্তরটা দানা পাওয়া যায়। অথচ গণৎকার বলেছিল শসা। ভেতর দু-শ’ ছাপ্পান্নটা দানা আছে।
কয়েক মাস পরে ইলিয়াস বার্ষিক পরীক্ষা দেয়। গণৎকারের ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যে করে দিয়ে পরীক্ষায় সে-ই ফার্স্ট হয়েছিল।
খালিশপুর, খুলনা মার্চ, ১৯৭৫