তৃতীয় অধ্যায়
ইতিমধ্যে জিনিসপত্রের মূল্য বেড়েছে-কৃষিজাত অন্য ফসলের দামও সেই সাথে বেড়েছে কিন্তু নীলগাছের দাম ৪ বান্ডিল ১ টাকা তাই বজায় থাকল। ছোটলাট তার রিপোর্টে এ বিষয়ে বলেছিলেন নীল সংকট চরমে ওঠার সব থেকে বড় কারণ হল সাম্প্রতিক মূল্যবৃদ্ধি। সব কৃষিজাত জিনিসের দাম গত তিন বছর দ্বিগুণ বেড়েছে-কৃষি শ্রমিকদের মজুরি, গোরু রাখার খরচ বেড়ে চলেছে কিন্তু নীলের কোন দাম বাড়েনি। এটাই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কারণ-রায়তের কাছে নীলচাষের খারাপ দিকগুলি আরও বেশি প্রকট হয়ে উঠেছে।
এর পাশাপাশি নীলকর সাহেবদের নানা ধরনের অত্যাচার মীরজাম মন্ডলের ভাষায় নীলকর সাহেব একাধারে নীলকর মহাজন জমিদার সেই সঙ্গে সে শাসক শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। আর একজন চাষি অভিযোগ করেছেন-তার ১১ বিঘা জমিকে মেপে ৭ বিঘাতে পরিণত করা হয়েছে। এ ভাবে সে যুগে চাষিকে বেশি জমিতে নীলচাষ করতে বাধ্য করা হত। চাষিদের কাছ থেকে কুঠি বাঁশ কিনেছে-তার দাম সে সময়মত পাচ্ছে না, ফসল ওঠার পর চাষিকে বাধ্য করা হত গোরুর গাড়িতে অথবা নৌকার দ্বারা কুঠিতে মাল পৌঁছে দিতে।
নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে কৃষকদের বিক্ষোভ এভাবে ধূমায়িত হচ্ছিল তা ফেটে পড়ে ১৮৫৯ খ্রীষ্টাব্দে। বারাসাতের তরুণ ম্যাজিস্ট্রেট অ্যাসলি ইডেন হাবড়া নীল কলসার্নের অন্তর্গত চৌরাশি গ্রামের কৃষকদের সঙ্গে নীলকর সাহেবদের বিরোধের ব্যাপারে রায় দিতে গিয়ে মন্তব্য করেন, চাষিরা নীল চাষ করবে কিনা তা তাদের ব্যাপার, নিজের জমিতে চাষি কি চাষ করবে সে স্বাধীনতা তার আছে।
ইতিপূর্বে বিভিন্ন এলাকায় চাষীদের বিক্ষোভ লক্ষ করা যাচ্ছিল; এই রায় সমগ্র চাষিদের মনে দারুণ উৎসাহের সৃষ্টি করে, চারিদিকে নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। নীল বিদ্রোহ শুধু মাত্র কৃষকদেরই নাড়া দেয়নি বাঙালি সমাজের ওপর তলার মানুষদের উদাসীন থাকতে দেয়নি।
সাংবাদিক হরিশচন্দ্র থেকে শুরু করে শিশির কুমার ঘোষ, নীলদর্পণের নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র, কালীপ্রসন্ন সিংহ, বঙ্কিমচন্দ্র বিদেশি মিশনারি লঙ্ সাহেব সহ সমাজের ওপর তলাকার অনেক মানুষ এই বিক্ষোভের আবর্তে জড়িয়ে পড়লেন। লড়াই ছড়িয়ে পড়ল বাংলাদেশ থেকে ভারতে এমনকি ইংলন্ডেও তার রেশ পৌঁছে গিয়েছিল।