০৩:২৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫
ভারতের পানি সংকটের ছায়ায় পানীয় শিল্প: রাজস্থানে জল নিয়ে বাড়ছে ঝুঁকি ও অসন্তোষ প্রাচীন ভারতে গণিতচর্চা (পর্ব-৩৪৭) আমির খসরুর আসন পরিবর্তন, তার আসনে মনোনয়ন পেলেন সাঈদ নোমান এনসিপি ছাড়লেন তাসনিম জারা থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে ৭২ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতি চুক্তি সিলেটে বিপুল পরিমাণ ভারতীয় নিষিদ্ধ বিড়িসহ যুবক গ্রেপ্তার একীভূত পাঁচ ব্যাংকের আমানত উত্তোলনে বিলম্ব, এ বছর অর্থ ছাড়ের সুযোগ নেই নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রতিবেদন: ধর্ম অবমাননার অভিযোগে হিন্দু শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যা, বাংলাদেশে সহিংসতা নিয়ে উদ্বেগ কিশোরগঞ্জের পাগলা মসজিদের দানবাক্সে মিলল ৩৫ বস্তা টাকা ও স্বর্ণালংকার ঘন কুয়াশায় ঢাকায় আটটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ঘুরিয়ে দেওয়া হলো

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৫৫)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:৫৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৪
  • 58

রাঙাছুটুর বাপের বাড়ি

কিন্তু সাপের বাঘের চাইতেও সহস্র গুণে হিংস্র ম্যালেরিয়া জ্বর আসিয়া গ্রামের প্রায় সবগুলি মানুষকে গ্রাস করিয়াছে। যাহারা বাঁচিয়া আছে তাহারাও পেটভরা প্লীহা ও হাড়-কাঁপুনি জ্বর লইয়া কোনোরকমে মরণের অপেক্ষায় বসিয়া আছে। গরীবুল্লা মাতবর কবে মরিয়া গিয়াছেন। সঙ্গে লইয়া গিয়াছেন তাঁর স্ত্রীকে, আর তাঁর সেই ফুটফুটে রাঙা মেয়ে বড়ুকে। ছেলে নেহাজদ্দী পেটভরা প্লীহা-লিভার লইয়া কোনোরকমে বাড়ির ঘরখানায় সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালায়। মোকিমের বাড়িতে কেহই জীবিত নাই। তাহার বাড়ির সামনের তালগাছ দুইটি আগের মতোই শূন্য আকাশে শাখা মেলিয়া বাতাসের সঙ্গে শোঁ শোঁ করিয়া কান্না করিতেছে। মিঞাজান কবে মরিয়া গিয়াছে। তার বউ কোথায় চলিয়া গিয়াছে। তাহাদের আদরের বিড়ালগুলির কতক আহার অভাবে মরিয়া গিয়াছে। বাকিগুলি জীর্ণশীর্ণ দেহ লইয়া ম্যাও ম্যাও শব্দে আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করিতেছে।

বরোইদের সেই পানের বর অর্ধেক ভাঙিয়া পড়িয়াছে। বরোইবাড়ির সেই সুন্দর বউঝিরা কেহই আজ বাঁচিয়া নাই। বৃদ্ধ কেশব ভদ্র এই শোক-কাহিনীর সাক্ষী হইয়া প্রতি সন্ধ্যায় গৃহকোণে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালাইয়া দিয়া এখনও নিজে যে বাঁচিয়া আছে তাহাই প্রমাণ করিতেছে।

আমার মায়ের আজ দুঃখের অন্ত নাই। এত আদরের বাপ-মা আজ কোথায় চলিয়া গিয়াছেন। নানির কবরে বসিয়া মা কত কাঁদিলেন। ফজার মা পাশে বসিয়া মায়ের চোখ আঁচল দিয়া মুছাইতে মুছাইতে নিজেও কাঁদিয়া সারা হইলেন। কয়েকদিন এ-ভিটায় ও-ভিটায় ঘুরিয়া মা বাড়ি ফিরিয়া আসিলেন। ইহার কিছুদিন পর, খবর আসিল ফজার মা বুড়ি মারা গিয়াছেন। আগে হইতেই তাঁর কাঁপাইয়া জ্বর আসিত। তাই লইয়া কোনোরকমে এক বেলা রান্না করিয়া দুই বেলা খাইতেন। সেদিন অনেক বেলা হইলেও ফজার মা ঘর হইতে বাহিরে আসিলেন না, তখন পাড়া-প্রতিবেশীরা ঘরের দরজা ভাঙিয়া দেখিল ফজার মা মরিয়া আছে। আহা, মরিবার আগে হয়তো একটু পানি পানি করিয়া বুড়ি কত চিৎকার করিয়াছিলেন। হয়তো কাউকে দেখিবার জন্য কত ডাকাডাকি করিয়াছিলেন। যখন কেহই তাঁর ডাকে আসিয়া সাড়া দেয় নাই, মৃত্যু আসিয়া তাঁহাকে লইয়া গিয়াছে। সন্তান-সন্ততিবিহীন ফজার মার জীবনের যবনিকাপাত এইভাবে হইল।

খবর পাইয়া বাজান ফরিদপুর হইতে কাফনের কাপড়, আতর, গোলাব, লোবান প্রভৃতি লইয়া বুড়িকে কবর দিয়া আসিলেন। ইহারও বহু বৎসর পরে আমি গিয়াছিলাম তাম্বুলখানা। আমার নানাবাড়ির কোনো চিহ্নই এখন নাই। শুধু সেই নারকেল গাছ দুইটি শাখা বাহু বাড়াইয়া অতীতকালের স্মৃতি নীরবে পাঠ করিতেছে। গরীবুল্লা মাতবরের সেই পুকুরের ধারে যাইয়া বসিলাম। রাশি রাশি কলমিলতায় সমস্ত পুকুরটি ছাইয়া ফেলিয়াছে। সেখানে বসিয়া পুরান-পুকুর নামে একটি কবিতা লিখিয়াছিলাম। কবিতাটি আমার ‘ধানখেত’ পুস্তকে মুদ্রিত হইয়াছে। গত বৎসর আমার মায়ের নামে নানার ভিটায় একটি টিউবওয়েল বসাইয়া দিয়া আসিলাম।

 

চলবে…

জনপ্রিয় সংবাদ

ভারতের পানি সংকটের ছায়ায় পানীয় শিল্প: রাজস্থানে জল নিয়ে বাড়ছে ঝুঁকি ও অসন্তোষ

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৫৫)

১১:০০:৫৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৪

রাঙাছুটুর বাপের বাড়ি

কিন্তু সাপের বাঘের চাইতেও সহস্র গুণে হিংস্র ম্যালেরিয়া জ্বর আসিয়া গ্রামের প্রায় সবগুলি মানুষকে গ্রাস করিয়াছে। যাহারা বাঁচিয়া আছে তাহারাও পেটভরা প্লীহা ও হাড়-কাঁপুনি জ্বর লইয়া কোনোরকমে মরণের অপেক্ষায় বসিয়া আছে। গরীবুল্লা মাতবর কবে মরিয়া গিয়াছেন। সঙ্গে লইয়া গিয়াছেন তাঁর স্ত্রীকে, আর তাঁর সেই ফুটফুটে রাঙা মেয়ে বড়ুকে। ছেলে নেহাজদ্দী পেটভরা প্লীহা-লিভার লইয়া কোনোরকমে বাড়ির ঘরখানায় সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালায়। মোকিমের বাড়িতে কেহই জীবিত নাই। তাহার বাড়ির সামনের তালগাছ দুইটি আগের মতোই শূন্য আকাশে শাখা মেলিয়া বাতাসের সঙ্গে শোঁ শোঁ করিয়া কান্না করিতেছে। মিঞাজান কবে মরিয়া গিয়াছে। তার বউ কোথায় চলিয়া গিয়াছে। তাহাদের আদরের বিড়ালগুলির কতক আহার অভাবে মরিয়া গিয়াছে। বাকিগুলি জীর্ণশীর্ণ দেহ লইয়া ম্যাও ম্যাও শব্দে আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করিতেছে।

বরোইদের সেই পানের বর অর্ধেক ভাঙিয়া পড়িয়াছে। বরোইবাড়ির সেই সুন্দর বউঝিরা কেহই আজ বাঁচিয়া নাই। বৃদ্ধ কেশব ভদ্র এই শোক-কাহিনীর সাক্ষী হইয়া প্রতি সন্ধ্যায় গৃহকোণে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালাইয়া দিয়া এখনও নিজে যে বাঁচিয়া আছে তাহাই প্রমাণ করিতেছে।

আমার মায়ের আজ দুঃখের অন্ত নাই। এত আদরের বাপ-মা আজ কোথায় চলিয়া গিয়াছেন। নানির কবরে বসিয়া মা কত কাঁদিলেন। ফজার মা পাশে বসিয়া মায়ের চোখ আঁচল দিয়া মুছাইতে মুছাইতে নিজেও কাঁদিয়া সারা হইলেন। কয়েকদিন এ-ভিটায় ও-ভিটায় ঘুরিয়া মা বাড়ি ফিরিয়া আসিলেন। ইহার কিছুদিন পর, খবর আসিল ফজার মা বুড়ি মারা গিয়াছেন। আগে হইতেই তাঁর কাঁপাইয়া জ্বর আসিত। তাই লইয়া কোনোরকমে এক বেলা রান্না করিয়া দুই বেলা খাইতেন। সেদিন অনেক বেলা হইলেও ফজার মা ঘর হইতে বাহিরে আসিলেন না, তখন পাড়া-প্রতিবেশীরা ঘরের দরজা ভাঙিয়া দেখিল ফজার মা মরিয়া আছে। আহা, মরিবার আগে হয়তো একটু পানি পানি করিয়া বুড়ি কত চিৎকার করিয়াছিলেন। হয়তো কাউকে দেখিবার জন্য কত ডাকাডাকি করিয়াছিলেন। যখন কেহই তাঁর ডাকে আসিয়া সাড়া দেয় নাই, মৃত্যু আসিয়া তাঁহাকে লইয়া গিয়াছে। সন্তান-সন্ততিবিহীন ফজার মার জীবনের যবনিকাপাত এইভাবে হইল।

খবর পাইয়া বাজান ফরিদপুর হইতে কাফনের কাপড়, আতর, গোলাব, লোবান প্রভৃতি লইয়া বুড়িকে কবর দিয়া আসিলেন। ইহারও বহু বৎসর পরে আমি গিয়াছিলাম তাম্বুলখানা। আমার নানাবাড়ির কোনো চিহ্নই এখন নাই। শুধু সেই নারকেল গাছ দুইটি শাখা বাহু বাড়াইয়া অতীতকালের স্মৃতি নীরবে পাঠ করিতেছে। গরীবুল্লা মাতবরের সেই পুকুরের ধারে যাইয়া বসিলাম। রাশি রাশি কলমিলতায় সমস্ত পুকুরটি ছাইয়া ফেলিয়াছে। সেখানে বসিয়া পুরান-পুকুর নামে একটি কবিতা লিখিয়াছিলাম। কবিতাটি আমার ‘ধানখেত’ পুস্তকে মুদ্রিত হইয়াছে। গত বৎসর আমার মায়ের নামে নানার ভিটায় একটি টিউবওয়েল বসাইয়া দিয়া আসিলাম।

 

চলবে…