০১:২৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৫৩)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:০৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৯ অক্টোবর ২০২৪
  • 10

রাঙাছুটুর বাপের বাড়ি

একথায় কি বুড়ির ভাই-এর শোকের অবসান হয়? সেই কতকাল আগে কোথায় বুড়ির বিবাহ হইয়াছিল তাহা আজ আবছার মতো মনে ভাসে। তারপর জীবনের সুদীর্ঘ ৭০ বৎসর ভাই-এর বাড়িতে আসিয়া বুড়ি নতুন করিয়া সংসার পাতিয়াছেন। ভাই-এর সুখ-দুঃখের সঙ্গে নিজের জীবনকে মিলাইয়া লইয়াছেন। আজ সেই ভাইকে তিনি ভুলিবেন কেমন করিয়া? কত কথা আজ বুড়ির মনে পড়ে। একবার ভাই তালগাছের ডোঙায় চড়িয়া বর্ষার দিনে কোথায় বেড়াইতে গিয়াছিল, হঠাৎ তালগাছের ডোঙা উল্টাইয়া ভাই পড়িয়া যায়। প্রায় সারাদিন একটি লগি ধরিয়া ভাই সেই সাঁতার পানিতে দাঁড়াইয়া ছিল। কাহারা সেই পথে যাইতে বাঁশের লগিটা নড়িতে দেখিয়া ভাইকে নৌকায় উঠাইয়া বাঁচাইয়া তোলে। সেদিন তো ভাই মরিল না। ফরিদপুর শহরের এত সুনাম। ডাক্তার-বৈদ্যেরা মরা মানুষ জ্যান্ত করিতে পারে। তবে বুড়ির ভাইকে তাহারা রোগ হইতে সারাইতে পারিল না কেন? কবে বুড়ির ছেলে ফজর মরিয়া গিয়াছে। তাহার কথা আজ নূতন করিয়া বুড়ির মনে পড়ে। বুড়িকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা কেহ খুঁজিয়া পায় না।

তবুও কিছুদিন কাঁদিয়া-কাটিয়া বুড়ির শোক কিছুটা প্রশমিত হইল। ঠিক হইল বুড়ি আর তাম্বুলখানা ফিরিয়া যাইবেন না। যে-কয়দিন বাঁচিয়া থাকেন আমাদের বাড়িতেই থাকিবেন।

কিন্তু এক পরিবেশের ভিতর হইতে অপর পরিবেশে আসিয়া বুড়ি কিছুতেই নিজেকে মানাইয়া চলিতে পারিতেছিলেন না। সেই আমগাছগুলি, সেই নারকেল গাছ দুটি, এরা তো বুড়ির সঙ্গে সঙ্গে আসে নাই। পাড়ার সেই বউঝিরা, বুড়ির সুখ-দুঃখে কত আপনার হইত। এদেশের বউঝিরা তো তেমন করিয়া আপনজন হইয়া উঠিল না। তা ছাড়া আমরা কয়েক ভাই মিলিয়া বুড়িকে একেবারে অতিষ্ঠ করিয়া তুলিতাম। বুড়ি কোনো জিনিস রান্না করিলে আমরা খাইয়া ভালো বলিতাম না। আর বৃদ্ধ বয়সে তিনি কি আগের মতো রাঁধিতে পারিতেন? আমার বড় ভাই বুড়িকে আরও জ্বালাতন করিতে লাগিলেন। বুড়ি থালাবাসন মাজিয়া দিলে সেই থালাবাসনে তিনি খাইতেন না। তাম্বুলখানার নির্জন বাড়িতে বহুদিন কাটাইয়া বুড়ি ছেলেপেলের গণ্ডগোল পছন্দ করিতেন না। আমাদের বিরুদ্ধে প্রায়ই মায়ের কাছে নালিশ করিতেন। তাহাতে আমরা আরও বুড়িকে অতিষ্ঠ করিয়া তুলিতাম।

এরপরে একদিন বুড়ি মাকে ডাকিয়া বলিলেন, “রাঙাছুট! তুমি কিছু মনে করিও না। আমি আবার তাম্বুলখানা ফিরিয়া যাইব।” মা আর কি মনে করিবেন? বিদায়ের দিন বুড়ি সেই লাঠিখানা হাতে লইয়া সকালবেলা তাম্বুলখানার পথে রওয়ানা হইলেন। যাইবার আগে ভাই-এর কবরের সেই কঠিন মাটি চোখের পানিতে ভিজাইয়া দিয়া গেলেন। কিন্তু আমাদের বালককালের নিষ্ঠুর মন সেই চোখের পানিতে ভিজিল না।

 

চলবে…

২০২৫ সালে ফিলিপাইনের ১২টি প্রধান অবকাঠামো প্রকল্প: রিয়েল এস্টেটের রূপান্তর

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৫৩)

১১:০০:০৩ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৯ অক্টোবর ২০২৪

রাঙাছুটুর বাপের বাড়ি

একথায় কি বুড়ির ভাই-এর শোকের অবসান হয়? সেই কতকাল আগে কোথায় বুড়ির বিবাহ হইয়াছিল তাহা আজ আবছার মতো মনে ভাসে। তারপর জীবনের সুদীর্ঘ ৭০ বৎসর ভাই-এর বাড়িতে আসিয়া বুড়ি নতুন করিয়া সংসার পাতিয়াছেন। ভাই-এর সুখ-দুঃখের সঙ্গে নিজের জীবনকে মিলাইয়া লইয়াছেন। আজ সেই ভাইকে তিনি ভুলিবেন কেমন করিয়া? কত কথা আজ বুড়ির মনে পড়ে। একবার ভাই তালগাছের ডোঙায় চড়িয়া বর্ষার দিনে কোথায় বেড়াইতে গিয়াছিল, হঠাৎ তালগাছের ডোঙা উল্টাইয়া ভাই পড়িয়া যায়। প্রায় সারাদিন একটি লগি ধরিয়া ভাই সেই সাঁতার পানিতে দাঁড়াইয়া ছিল। কাহারা সেই পথে যাইতে বাঁশের লগিটা নড়িতে দেখিয়া ভাইকে নৌকায় উঠাইয়া বাঁচাইয়া তোলে। সেদিন তো ভাই মরিল না। ফরিদপুর শহরের এত সুনাম। ডাক্তার-বৈদ্যেরা মরা মানুষ জ্যান্ত করিতে পারে। তবে বুড়ির ভাইকে তাহারা রোগ হইতে সারাইতে পারিল না কেন? কবে বুড়ির ছেলে ফজর মরিয়া গিয়াছে। তাহার কথা আজ নূতন করিয়া বুড়ির মনে পড়ে। বুড়িকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা কেহ খুঁজিয়া পায় না।

তবুও কিছুদিন কাঁদিয়া-কাটিয়া বুড়ির শোক কিছুটা প্রশমিত হইল। ঠিক হইল বুড়ি আর তাম্বুলখানা ফিরিয়া যাইবেন না। যে-কয়দিন বাঁচিয়া থাকেন আমাদের বাড়িতেই থাকিবেন।

কিন্তু এক পরিবেশের ভিতর হইতে অপর পরিবেশে আসিয়া বুড়ি কিছুতেই নিজেকে মানাইয়া চলিতে পারিতেছিলেন না। সেই আমগাছগুলি, সেই নারকেল গাছ দুটি, এরা তো বুড়ির সঙ্গে সঙ্গে আসে নাই। পাড়ার সেই বউঝিরা, বুড়ির সুখ-দুঃখে কত আপনার হইত। এদেশের বউঝিরা তো তেমন করিয়া আপনজন হইয়া উঠিল না। তা ছাড়া আমরা কয়েক ভাই মিলিয়া বুড়িকে একেবারে অতিষ্ঠ করিয়া তুলিতাম। বুড়ি কোনো জিনিস রান্না করিলে আমরা খাইয়া ভালো বলিতাম না। আর বৃদ্ধ বয়সে তিনি কি আগের মতো রাঁধিতে পারিতেন? আমার বড় ভাই বুড়িকে আরও জ্বালাতন করিতে লাগিলেন। বুড়ি থালাবাসন মাজিয়া দিলে সেই থালাবাসনে তিনি খাইতেন না। তাম্বুলখানার নির্জন বাড়িতে বহুদিন কাটাইয়া বুড়ি ছেলেপেলের গণ্ডগোল পছন্দ করিতেন না। আমাদের বিরুদ্ধে প্রায়ই মায়ের কাছে নালিশ করিতেন। তাহাতে আমরা আরও বুড়িকে অতিষ্ঠ করিয়া তুলিতাম।

এরপরে একদিন বুড়ি মাকে ডাকিয়া বলিলেন, “রাঙাছুট! তুমি কিছু মনে করিও না। আমি আবার তাম্বুলখানা ফিরিয়া যাইব।” মা আর কি মনে করিবেন? বিদায়ের দিন বুড়ি সেই লাঠিখানা হাতে লইয়া সকালবেলা তাম্বুলখানার পথে রওয়ানা হইলেন। যাইবার আগে ভাই-এর কবরের সেই কঠিন মাটি চোখের পানিতে ভিজাইয়া দিয়া গেলেন। কিন্তু আমাদের বালককালের নিষ্ঠুর মন সেই চোখের পানিতে ভিজিল না।

 

চলবে…