০১:২৭ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৫১)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:০৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৪
  • 20

রাঙাছুটুর বাপের বাড়ি

নানা বলিলেন, “মা! তোমার ঘর-সংসারের কাজ তাড়াতাড়ি সারিয়া আমার কাছে আসিয়া বস! আমার যেন কেমন ভয় ভয় করিতেছে।”

মা সমস্ত কাজ ফেলিয়া নানার কাছে আসিয়া বসিয়া রহিলেন। সন্ধ্যা হয়-হয়, নানা বলিলেন, “মা! তুমি ভয় করিও না। আমার যেন চিৎকার করিয়া ডাক ছাড়িতে ইচ্ছা হইতেছে।” মা নানাকে জড়াইয়া ধরিলেন। নানা বলিলেন, “মারে। বাপের বাড়ির সমস্ত মায়া মহব্বৎ সঙ্গে লইয়া আমি চলিয়া যাইতেছি। সেদেশে যাইয়া যে কিছুদিন বুক জুড়াইবি তার কোনো ব্যবস্থাই আমি করিয়া যাইতে পারিলাম না।” আমার পিতা সামনে বসা ছিলেন। কাছে ডাকিয়া বলিলেন, “আমি মরিয়া গেলে আমার রাঙাছুটুর খবর লইতে আর কেহ তাম্বুলখানা হইতে আসিবে না। আমার বিষয়-সম্পত্তি সবই তোমরা পাইবে। তাই দিয়া আমার রাঙাছুটুকে যত্নে রাখিও। ও আমাদের বড় আদরের মেয়ে।”

আরও যেন কি বলিতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু আর বলিতে পারিলেন না। কেমন একটা মুখভঙ্গি করিয়া নানা চির-নীরব হইলেন। আমার মায়ের বুকফাটা কান্নায় আকাশ-বাতাস ধ্বনিত মথিত হইয়া উঠিল। “আর তো বাজান রাঙায়ুটুর খবর লইতে সেই তাম্বুলখানা হইতে গোবিন্দপুর আসিবেন না। আর তো চাদরের খোটে তিলের-পাটালি লইয়া আমার আদরের বাগ রাঙায়ুটুর খোঁজ লইবেন না। ও বাজান। বলিয়া যান, একধামা ধান বেশি দিয়া কার খবর লইতে আবার আমি ভিখারিকে তাম্বুলখানা পাঠাইব।”

আমাদের কুলগাছতলায় যেখানে আমার বড়বোন বস্তুকে কবর দেওয়া হইয়াছিল তারই একপাশে নানাকে কবর দেওয়া হইল। বড়ুকে নানা বড়ই ভালোবাসিতেন। মরিয়া তাঁর আদরের নাতনিকে তিনি ফিরিয়া পাইবেন কি না কে জানে।

প্রতিদিন শেষরাত্রে উঠিয়া মা কাঁদিতে বসিতেন। মায়ের কান্নায় আমাদের ঘুম ভাঙিয়া যাইত। আমার যেন কেমন অসোয়াস্তি বোধ হইত। বাজান মাকে বকিতেন। মা কিন্তু তা গ্রাহ্য করিতেন না।

সকল দুঃখেরই শেষ হয়। কিন্তু তাহার দাগ অন্তর হইতে মোছে না। সেই দাগ বুকে আঁকিয়া মাকে আবার ঘর-সংসারের কাজ দেখিতে হইল। পরবর্তীকালে মা তাঁর কোনো অন্তরঙ্গ লোক পাইলে নানার মৃত্যুকাহিনী অতি করুণ করিয়া বিনাইয়া বিনাইয়া বলিতেন। মায়ের বলার সে কি ভঙ্গি। মা যেন কথা বলিতে বলিতে ছবি আঁকিয়া যাইতেন। তারই কিছুটা এখানে লিখিয়া রাখিলাম।

চলবে…

২০২৫ সালে ফিলিপাইনের ১২টি প্রধান অবকাঠামো প্রকল্প: রিয়েল এস্টেটের রূপান্তর

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৫১)

১১:০০:০৭ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৭ অক্টোবর ২০২৪

রাঙাছুটুর বাপের বাড়ি

নানা বলিলেন, “মা! তোমার ঘর-সংসারের কাজ তাড়াতাড়ি সারিয়া আমার কাছে আসিয়া বস! আমার যেন কেমন ভয় ভয় করিতেছে।”

মা সমস্ত কাজ ফেলিয়া নানার কাছে আসিয়া বসিয়া রহিলেন। সন্ধ্যা হয়-হয়, নানা বলিলেন, “মা! তুমি ভয় করিও না। আমার যেন চিৎকার করিয়া ডাক ছাড়িতে ইচ্ছা হইতেছে।” মা নানাকে জড়াইয়া ধরিলেন। নানা বলিলেন, “মারে। বাপের বাড়ির সমস্ত মায়া মহব্বৎ সঙ্গে লইয়া আমি চলিয়া যাইতেছি। সেদেশে যাইয়া যে কিছুদিন বুক জুড়াইবি তার কোনো ব্যবস্থাই আমি করিয়া যাইতে পারিলাম না।” আমার পিতা সামনে বসা ছিলেন। কাছে ডাকিয়া বলিলেন, “আমি মরিয়া গেলে আমার রাঙাছুটুর খবর লইতে আর কেহ তাম্বুলখানা হইতে আসিবে না। আমার বিষয়-সম্পত্তি সবই তোমরা পাইবে। তাই দিয়া আমার রাঙাছুটুকে যত্নে রাখিও। ও আমাদের বড় আদরের মেয়ে।”

আরও যেন কি বলিতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু আর বলিতে পারিলেন না। কেমন একটা মুখভঙ্গি করিয়া নানা চির-নীরব হইলেন। আমার মায়ের বুকফাটা কান্নায় আকাশ-বাতাস ধ্বনিত মথিত হইয়া উঠিল। “আর তো বাজান রাঙায়ুটুর খবর লইতে সেই তাম্বুলখানা হইতে গোবিন্দপুর আসিবেন না। আর তো চাদরের খোটে তিলের-পাটালি লইয়া আমার আদরের বাগ রাঙায়ুটুর খোঁজ লইবেন না। ও বাজান। বলিয়া যান, একধামা ধান বেশি দিয়া কার খবর লইতে আবার আমি ভিখারিকে তাম্বুলখানা পাঠাইব।”

আমাদের কুলগাছতলায় যেখানে আমার বড়বোন বস্তুকে কবর দেওয়া হইয়াছিল তারই একপাশে নানাকে কবর দেওয়া হইল। বড়ুকে নানা বড়ই ভালোবাসিতেন। মরিয়া তাঁর আদরের নাতনিকে তিনি ফিরিয়া পাইবেন কি না কে জানে।

প্রতিদিন শেষরাত্রে উঠিয়া মা কাঁদিতে বসিতেন। মায়ের কান্নায় আমাদের ঘুম ভাঙিয়া যাইত। আমার যেন কেমন অসোয়াস্তি বোধ হইত। বাজান মাকে বকিতেন। মা কিন্তু তা গ্রাহ্য করিতেন না।

সকল দুঃখেরই শেষ হয়। কিন্তু তাহার দাগ অন্তর হইতে মোছে না। সেই দাগ বুকে আঁকিয়া মাকে আবার ঘর-সংসারের কাজ দেখিতে হইল। পরবর্তীকালে মা তাঁর কোনো অন্তরঙ্গ লোক পাইলে নানার মৃত্যুকাহিনী অতি করুণ করিয়া বিনাইয়া বিনাইয়া বলিতেন। মায়ের বলার সে কি ভঙ্গি। মা যেন কথা বলিতে বলিতে ছবি আঁকিয়া যাইতেন। তারই কিছুটা এখানে লিখিয়া রাখিলাম।

চলবে…