রাঙাছুটুর বাপের বাড়ি
সেই ঢ্যাপের খই-এর মোয়া খাইতে খাইতে নানির কত আদরের কথা মনে পড়িয়াছে। সেবার নানাবাড়ি গেলাম। বোধহয় জ্যৈষ্ঠমাসে। নানি কত আদর করিয়া আমাদের গ্রহণ করিলেন। মা নানিকে দেখিয়া বলিলেন, “মা। তোমার শরীর এবার বড্ড খারাপ হইয়াছে। আমাদের জন্য এটা-ওটা পিঠা বানাইয়া আর খাটিতে পারিবে না।” নানি কি তাই শোনেন।
আজ বানান পাকান পিঠা, কাল বানান চিতই পিঠা। যে যে খাবার মায়ের পছন্দ, নানি কত যত্ন করিয়া সেই সেই খাবার তৈরি করেন। তারপর রাত ভরিয়া মেয়ে আর মায়ের কথা। সে-কথা কি নানির ফুরাইতে চাহে? সকালের মোরগ যখন ডাকে তখনও জাগিয়া উঠিয়া শুনি তাঁদের কথা শেষ হয় নাই। সেই কবে আমাদের দেশ হইতে ভিখারি আসিয়াছিল। তার নিকটে নানি শুনিলেন, রাঙাছুটুর শরীর ভালো নাই। দেশের জমিতে ধান জন্মে নাই। জামাইকে কিনিয়া খাইতে হয়। নানি নানাকে বলিয়া দুইটি ঘোড়া বোঝাই ধান গোবিন্দপুর পাঠাইয়া দিলেন। এদেশ হইতে বুনো-মেয়েরা ওদেশে ভিক্ষা করিতে যায়। তাহাদের তিন তিন সের চাউল দিয়া নানি বলিয়া দিয়াছিলেন, রাঙাছুটুকে যেন দেখিয়া আসে। মা বলিলেন, “সেই বুনো-মেয়েরা আমাকে একছড়া পুঁতির মালা দিয়া আসিয়াছিল। মা! তুমি কি সুন্দর
করিয়া পুঁতির মালা গাঁথিতে পার। গলায় পরিলে যে দেখে সে-ই তারিফ করে।” শুনিয়া কত তৃপ্তিতে যেন নানির মন ভরিয়া গেল। সেকালে চিঠি লেখার প্রচলন ছিল না। ভিখারিদের সামান্য কিছু ভিক্ষা বেশি দিয়া মায়ের সঙ্গে নানির খবরাখবরের আদান-প্রদান হইত। আমাদের গাঁয়ের পাশে শোভারামপুরে ছিল তিন-চারজন ভিখারিণী। তাহাদের বলিয়া-কহিয়া মাঝে মাঝে মা নানাবাড়ির দেশে খবর পাঠাইতেন। তাহারা যখন ফিরিয়া আসিত কি আগ্রহে মা তাহাদের কাছে নানা প্রশ্ন করিয়া তাঁর মা-বাপের খবর শুনিতেন। শুধু কি নানা-নানির কথা। নানাবাড়ির নারকেল গাছে কিরকম ডাব ধরিয়াছে? সিঁদুরে-আমের গাছে কিরূপ মুকুল ধরিয়াছে? ফেলিরা কেমন আছে, মাতবরের মেয়ে আমার কথা কিছু জিজ্ঞাসা করিল নাকি? এমনি প্রশ্নের পর প্রশ্ন করিয়া মা তাঁর বাপের বাড়ির সবকিছুকে যেন পটে আঁকিয়া লইতেন।
সেদিন নানি যাইবেন পিঠার জন্য চাউল কুটিতে। মা কত বারণ করিলেন, “তোমার শরীর খারাপ। কিছুতেই তুমি এত চাউল কুটিতে পারিবে না।” নানি কি বারণ শোনেন? মা তখন বলিলেন, “মা! তুমি তবে আলাও। আমি ঢেঁকিতে পার দিয়া দেই। নইলে কিছুতেই তোমাকে ঢেঁকির উপর যাইতে দিব না।” অনেক বাদ-প্রতিবাদের পরে নানি পিঠার গুঁড়া আলাইতে রাজি হইলেন। দুপুরবেলা চাউল কোটা আরম্ভ করিয়া প্রায় সন্ধ্যা হইয়া আসিল। আর সামান্য কয়টা চাউল আছে। কয়েক পার দিলেই গুঁড়া হইয়া যাইবে। এমন সময় অসাবধানে ঢেঁকির একটি পার নানির হাতের একটি আঙুলে লাগিয়া আঙুলটি ছেঁচিয়া গেল। পাছে মা দুঃখ পান, নানি সেই হাতের ব্যথায় একটুও আহা-উহু করিলেন না।
চলবে…