রাঙাছুটুর বাপের বাড়ি
মাকে খাওয়াইয়া চোখের পানি মুছিতে মুছিতে নানি মায়ের চুলগুলি লইয়া বিনুনি বাঁধিতে বসিলেন। কত কথা আজ তাঁর মনে পড়িতেছে। আরও দুইটি মেয়ে ছিল নানির। একজনের বিবাহ হইয়াছিল বাখুণ্ডাগ্রামে আর একজনের মামরুগদা, সেই বোয়ালমারীর কাছে। তারা একে একে কবরের ঘরে যাইয়া আশ্রয় লইয়াছে। একটি ছেলে ছিল। সেও একদিন মরণের কোলে ঢলিয়া পড়িল। বুড়োবুড়ির অন্ধের চক্ষু একমাত্র এই মেয়েটি। মেয়ের একার সংসার। শ্বাশুড়ি নাই-ননদি নাই। নাইয়র আনিয়া কিছুদিন যে মেয়েকে বুকের কাছে রাখিবেন তারও উপায় নাই। মেয়ের সংসার দেখে কে?
কাঁদিতে কাঁদিতে মা নানার হাট হইতে আনিয়া দেওয়া নতুন কাপড়খানা পরিলেন। কপালে সিঁদুর দিয়া, চোখে কাজল পরিয়া মা যখন দাঁড়াইলেন মাকে বিসর্জনের প্রতিমার মতো দেখাইতেছিল। পাড়ার বন্ধু ফেলি, আছিরন এদের একান্তে ডাকিয়া আনিয়া মা বলিলেন, “দেখ বোন! আমি চলিয়া গেলে আমার মায়ের বড় কষ্ট হইবে। তোরা আসিয়া মার কাছে বসিবি।”
তারা কাঁদিয়া বলে, “রাঙাছুটুলো, তোমার মাকে যে আমরা প্রবোধ দিব সে কথা সত্য; কিন্তু তোমার জন্য আমরা যখন কাঁদিব আমাদের প্রবোধ দিবে কে?” মা তাহাদের জড়াইয়া ধরিয়া কাঁদেন। তাহারাও কাঁদিয়া বুক ভাসায়।
সোয়ারি বেহারারা তাড়া দেয়। অনেক দূরের পথ যাইতে হইবে। বেলা পড়ন্ত। শিগগির সোয়ারি ঘিরিবার কাপড় দেন। কাপড়ের ভাঁজ খুলিয়া সোয়ারি ঘিরিবার সঙ্গে সঙ্গে এই দুঃখময় ঘটনাটিকে যেন বেহারারা সোয়ারির গায়ে চিত্রিত করিয়া দেয়। নানা ভাঙা-গলায় বলেন, “রাঙাছুটু! আর দেরি করিও না। সোয়ারিতে যাইয়া ওঠ।” মা প্রথমে নানাকে সালাম করেন। নানা দোয়া করেন, “কোলভরা ছেলেমেয়ে লইয়া স্বামীর ঘর উজলা করিও। মিষ্টি কথা দিয়া পাড়া প্রতিবেশীদের খুশি করিও। অতিথি-মোসাফির আসিলে যত্ন করিও। সব সময় স্বামীকে খুশি রাখিতে চেষ্টা করিও।’
মা চোখের পানিতে নানার পা ভিজাইতে ভিজাইতে বলেন, “বাজান। আমাকে দেখিতে কিন্তু গোবিন্দপুর যাইবেন। আমি পথের দিকে চাহিয়া থাকিব। আমার একটা ভাই থাকিলেও মাঝে মাঝে দেখিতে যাইত। সেই ভাই-এর কাজও আপনাকে করিতে হইবে।”
গামছায় চোখ মুছিতে মুছিতে নানা বলেন, “নিশ্চয়ই যাইব। অবসর পাইলেই তোমাকে দেখিতে যাইব।”
নানির পায়ে দুই হাত রাখিয়া মা সালাম করেন। নানি আর দোয়া করিবার ভাষা পান না। কেবল কাঁদেন। মা নানিকে বলেন, “মা। বর্ষায় নতুন পানি আসিলে বা’জানকে পাঠাইও আমাকে আনিবার জন্য। আমি বলিয়া-কহিয়া বর্ষাকালে আবার আসিব।”
চলবে…