স্বদেশ রায়
দীর্ঘদিন ধরে প্রতি বৃহস্পতিবারে লিখি। একটা সময় ছিলো প্রতি মঙ্গলবারে লিখতাম। তারপরে আবার একটা সময় এলো প্রতি শনিবার লিখতাম। এছাড়া বার, ক্ষণ তারিখ ছাড়াও হাজার হাজারটি লিখতে হয়েছে জীবিকার তাগিদে।
কখনও কখনও লিখি- লিখতে হবে বলে আবার কখনও কখনও এলোমেলো কিছু চিন্তা মাথার মধ্যে কেমন যেন পোঁকার মতো কিলবিল করে। তখন নিজেকে সুস্থ করার জন্যে কী বোর্ডে আঙুল রাখতে হয়।
কারণ বর্তমানে নিউজ আউটলেটগুলো মাঝে মাঝে খুব এক ঘেয়েমি এনে দেয়। কিয়েভের ছবি আর যুদ্ধ, মিউল ইস্ট এর ধ্বংস স্তুপ আর যুদ্ধ’র খবর. ইন্দো প্যাসিফিকে নৌ মহড়া, সাউথ চায়না সিতে নৌ মহড়া। আবার এর মাঝে ভিয়েতনাম পার্লামেন্ট সে দেশের জেনারেল কে সরকার প্রধান মনোনীত করেছে স্থিতিশীলতা ও শিল্প বানিজ্যের স্বার্থে- আবার একই কারণে অর্থ বানিজ্যে মন দেবার জন্যে ভারত- চায়না সীমান্ত সমস্যা মিটিয়ে নিয়েছে।
এই হাজার হাজার রাষ্ট্র ও রাজনীতি কেন্দ্রিক খবরের মাঝে অনেকটা সমুদ্রে পড়া মানুষের মতো খুঁজতে হয় কোথাও কোন নতুন বই বের হয়েছে কিনা যেখানে অর্থনীতি, রাজনীতি, যুদ্ধ. এ সবের বাইরে গিয়ে আছে মানুষের কথা। যে কথার সঙ্গে নিজের মনের কিছু কথা মিলে যায়।
ঠিক পুরোপুরি রবীন্দ্রনাথের শব্দগুলো মনে নেই। ইচ্ছেও করছে না সেলফ থেকে বই টেনে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের লাইনগুলো তুলে দেই। রবীন্দ্রনাথ দেশকে ভালোবাসা নিয়ে লিখেছিলেন, এই ভালোবাসার মূলে দেশের ইতিহাসের সঙ্গে আমার তপস্যার অংশ রয়ে গেছে। আর সে জন্যই এ দেশ আমার। দেশের ইতিহাসের সঙ্গে তপস্যার অংশ, কী সে তপস্যা! বড়ই জটিল। যারা সিজারকে হত্যা করেছিলো সেই সেনেটরাও তো বলেছিলো এ তাদের তপস্যার অংশ। সিজার দেশের জন্যে যাই করুক না কেন সে একক হয়ে উঠেছে, সে স্বৈরাচার হয়ে উঠেছে। অথচ ইতিহাস পড়লে, নাটক পড়লে মনটা দোলাচলে চলে যায়- প্রশ্ন ওঠে কোন তপস্যা বড় ছিলো।
পারিবারিক কারণে হোক আর নিজের কোন আচ্ছন্নতার কারণে হোক, যখন রাম মোহন রায় সামনে আসে তখন মনে হয় তিনি লেবেরালিজমের তপস্যাকে চিনিয়েছিলেন আর যে তপস্যা দেশকে ঘিরে। যিনি প্রথম ইংরেজকে বলেছিলেন, তুমি শাসক আমি তোমার দ্বারা নির্দেশিত নিয়ম অনুযায়ী চলছি। কিন্তু দেশে শাসক গোষ্টি ও আমার মতো সাধারনের জন্যে একই আইন, একই রাস্তা হতে হবে। উদারতন্ত্রের এই তপস্যার সঙ্গে কে জড়িত বেশি? সে আমার দেশ- না, আমার নিজের মন, আমার আত্মজগত- এ এক বড় প্রশ্ন। মিমাংসা সম্ভব হয়নি আজো। এমনকি রামমোহন কি দেশকে আগে ভেবেছিলেন- না, সমাজকে আগে ভেবেছিলেন, না, সবার আগে মানুষের নিজের সংস্কারকে ভেবেছিলেন- এও এক বড় প্রশ্ন। বাস্তবে আত্মসংস্কার ছাড়া সমাজ, দেশ কোন কিছুই কি নিজের তপস্যার অংশ হয়? রবীন্দ্রনাথ শ্রী চৈতন্যদেবের অনুসারীদের একটি কীর্তনের ওপর সুর বসিয়ে, তপস্যার কঠিন পথ দেখালেন- বললেন, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল।
চল বা চলা কথাটি রবীন্দ্রনাথের বড় প্রিয় ছিলো। যা তিনি তার দেশের সভ্যতার ইতিহাস থেকে পেয়েছিলেন। বসে থাকা নয়, চল, চল। যে চলার গতি তিনি বলাকার ডানাতেও দেখেছিলেন। আবার দেখেছিলেন নদীর পাক খাওয়া জলে। মার্টিন লুথার কিংও চলতে বলেছেন। তিনিও বসে থাকাকে পছন্দ করেননি। তখন স্বভাবতই প্রশ্ন আসে তাহলে চলা কি তপস্যা? আসলে চলতে চলতে কী হয়? তপস্যার শেষ হয় না শুরু হয়! সূর্য যখন রাত শেষে আবার ওঠে তাহলে শেষ নিশ্চয়ই নেই ব্রহ্মান্ডে। তাহলে থাকে শুধু শুরু আর চলা।
চলার জন্যে গতি বড়- না, স্তব্দতা বড় সেও এসে মাঝে মাঝে ধাক্কা দেয়। রবীন্দ্রনাথ চলতে বললেও রুমি কেমন যেন স্থির হতে বলে। অবশ্য ভারতীয় সভ্যতা ও পারস্য’র সভ্যতায় খুব কোন পার্থক্য ছিলো না। শুধু চলার বাহনে যা পার্থক্য – হাতী আর ঘোড়া। অথচ তারপরে আফগান সন্তান রুমি পারস্য’র জারক রসে কেন এত স্থির হলেন? তাহলে কি রুমির তপস্যার সঙ্গে মনের মধ্যে গিয়ে বা বনের মধ্যে গিয়ে যে তপস্যা মানুষ একদা করেছিলো তার কোন মিল আছে?
তখন আবার মনে হয় যারা মন কে বা বন কে বড় করেছে তাদের তপস্যার সঙ্গে কি অন্য তপস্যার একটু হলেও ভিন্নতা নেই! থাকারই তো কথা। আবার মনে হয়, যে বলাকা পাখায় বিরাট শব্দ তুলে চলতে থাকে অন্ধকারের বুক চিরে- সেও এক সময়ে কোন না কোন শাখায় স্থির হয়ে বসে। ওই স্থিরতা তার গভীর রাতের অন্ধকার শেষ হবার অপেক্ষা না তপস্যা- সে প্রশ্নের মিমাংসা কি বলাকা খোঁজে? তারপরে ভোরের নতুন আলোর সঙ্গে সে যখন ডানা মেলে দেয় তখন কি আর তার অন্ধকারের স্তব্দতাকে মনে রাখার কোন সময় থাকে?
আবার তখন কি মনে হয় না, বলাকার কোন তপস্যার কারণে নয়- আলো পৃথিবীর নিজের গতি মেনেই এসেছিলো। বলাকা শুধু এই গতির সঙ্গে তার তপস্যাকে মিলিয়ে দিয়েছিলো বা হয়তো দেয়নি। আবার কি মনে হয় না রবীন্দ্রনাথের পঞ্চক আলোর জন্যে কত হাহুতাশ করতো অথচ দর্ভকরা যখন সব দেয়াল ভেঙ্গে আলো নিয়ে এলো সে তাদের সঙ্গে ছিলো না। আর এখানেই মনে হয় রবীন্দ্রনাথের তপস্যাই সত্য। দর্ভকদের দলে সে যেতে পারেনি ঠিকই তবে পঞ্চকের তপস্যা তো তাদের সঙ্গে ছিলো। ইতিহাসের পথ চলার সঙ্গে সে যোগ করতে পেরেছে নিজেকে।
পঞ্চক সূর্যের আলো দেখেই খুশি হয়েছিলো কারণ সে জীবনে একবারই এবং ওই প্রথম আলো পেলো। অথচ যে বার বার আলো আর অন্ধকারের মধ্য দিয়ে আসে সে সূর্যের উজ্জল আলোকে যেমন চেনে তেমনি কোজাগরি চাঁদের স্নিগ্ধ আলোতেও স্নান করতে জানে। অন্ধকার তার জন্যে সব সময়ের রাজ- প্রতাপের মতই ক্ষণকালের বায়ু।
লেখক: সাংবাদিকতায় রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত। সম্পাদক, সারাক্ষণ ও The Present World.