কৃষি ও কৃষক
চতুর্থ অধ্যায়
এক জঘন্যতম সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে এরা দরিদ্র কৃষককে ক্রীতদাসের জীবনযাপনে বাধ্য করেছিল এবং সেদিন গ্রামজীবনে এক বিভীষিকার রাজত্ব তৈরি করেছিল এর সঙ্গে ছিল নানা অর্থনৈতিক শোষণ ফলে চাষির জীবন ছিল দুর্বিষহ। বৎসরের শেষে ধান উঠলে জমির মহাজনকে দেয় ভাগ ধান তার সঙ্গে খামার ছিলনি, কাকতাড়ানি, দরোয়ানি, মাথট, বাঁধের খরচ ঈশ্বরবৃত্তি এ ধরনের নানারকমের বাজে আদায় চাষিদের কাছ থেকে জোর করে আদায় করা হত। প্রকৃতপক্ষেচাবি অনেক সময় পৌষমাসে জমিদার কাছারিতে সব কিছু শোধ করে দিয়ে ঝাটা কুলো নিয়ে শুধু হাতে ফিরে আসত। আর যদি জমিদারের সমস্ত ঋণ শোেব হয়ে যেত তা হলে সে দুর্ভাবনা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসতো কারণ জমিদার পরের মরশুমে অন্য কোন চাষিকে বেশি সেলামি নিয়ে ঐ জমি বর্গায় চাষ করার জন্য দিয়ে দিতে পারে।
ভূমিহীন বর্গাচাষির জীবনে কোন নিরাপত্তা ছিল না। এসব অত্যাচারের বিরুদ্ধে কাকদ্বীপ, সাগর, মথুরাপুরের চাষীরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলে। এ আন্দোলন ছিল সেদিন কাকদ্বীপের মানুষের ভাষায় ‘আনি সুনির বিরুদ্ধে লড়াই’। এই আন্দোলনে কাকদ্বীপের কৃষক বঙ্কিম মাইতি অতুল মাইতি-রা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিল আন্দোলনকে দমন করার জন্য পুলিশের সাহায্যে জমিদাররা তাদের পাইক বরকন্দাজ নিয়ে চাষিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। চাষিরা রাগে ফুলে উঠেছে কিন্তু অসহায়। গোপনে রাতের অন্ধকারে জমিদারের কাছারিতে আগুন লাগিয়েছে- নায়েব বরকন্দাজ খুন করেছে। কাশিনগর মৌজায় মাইতিদের দারোয়ানকে এ সময় চাষিরা খুন করে।
তৎকালের কুখ্যাত জোতদার প্রাণকৃষ্ণ কামার ও অন্যান্য জোতদারদের খামারের ধানের গাদা পুড়িয়ে দেয়। জমিদারের হয়ে সাক্ষী দেবার অপরাধে জমিদারের মোসাহেবদের ঘরে চাষিরা আগুন লাগায় রাতের অন্ধকারে সংগঠিত আন্দোলন দানা বেঁধে উঠতে না পারায় এভাবে চাষিদের প্রতিবাদ ফুটে উঠতে থাকে। এভাবে চাষিরা জমিদার জোতদার ও তার অনুচরদের আতঙ্কিত করে তোলে। মেদিনীপুরের’ ৪২ এর ভারতছাড়ো আন্দোলনের তীব্রতা সুন্দরবনের কাকদ্বীপ অঞ্চলে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এই এলাকার মানুষের সঙ্গে মেদিনীপুরের একটা সম্পর্ক ছিল কারণ এদের অনেকের আত্মীয়-স্বজনেরা মেদিনীপুরে বাস করত। ভারতছাড়ো আন্দোলনের নানা খবরে, চাষীরা উৎসাহিত হয়ে উঠে।
সরকারি অত্যাচারের রোমহর্ষক বিবরণ শুনে চাষিরা যেমন আতঙ্কিত হত ও অন্তরে ক্রোধ জমে উঠত সেই সঙ্গে জমিদার জোতদার ও ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা সৃষ্টি হয়েছিল। ‘৪২ এর আক্টোবরে কাকদ্বীপ সাগর নামখানাতে ভয়ানক জলোচ্ছ্বাস দেখা দেয় এবং দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকার নদীতে বন্যা দেখা দেয়। দুর্গাপূজার সময়ে এই বন্যায় মানুষদের প্রচণ্ড ক্ষয়ক্ষতি হল- অনেক মানুষ মারা গেল, গবাদি পশু মারা গেল এবং ঘরবাড়ি সব কিছুই নষ্ট হল- সরকারের কাছ থেকে কোন সাহায্য পেল না। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট জমিদার ইজারাদার এবং বিভিন্ন লাটের বড়লোকদের ডেকে বললেন দেশে যুদ্ধ চলছে সরকারের পক্ষে কোন সাহায্য দেওয়া সম্ভব নয়।