কৃষি ও কৃষক
চতুর্থ অধ্যায়
বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের একই অভিজ্ঞতা হল শুরু হল কাকদ্বীপের তেভাগার লড়াই। (১৯) পঞ্চাশের মন্বন্তরে অসংখ্য চাষি মারা গেল আর যারা বেঁচে রইল তাদের অনেকের রায়ত জমি সেদিন, বাঁধা পড়েছিল জোতদারদের ঘরে। এর ফলে সদ্য জমিহারা চাষিদের ক্রোধ আরও তীব্র হয়ে উঠল। বর্গাদার খেতমজুররা লড়াই-এর সামনের সারিতে উঠে এল। সমিতির নেতৃত্বে ভাগচাষি, খেতমজুর, ছোট চাষি থেকে শুরু করে মাঝারি কৃষক সকলেই প্রায় এই আন্দোলনে সামিল হল কাকদ্বীপ সাগরের গ্রামাঞ্চলে মুষ্টিমেয় জমিদার চকদারের বিরুদ্ধে ব্যাপক কৃষক মোর্চা লক্ষ করা গেল। ১৯৪৫ সাল জুড়ে চাষিরা তেভাগা এবং ঋণ মকুবের দাবিতে এবং ঋণের দায়ে হস্তান্তরিত জমি ফেরতের আন্দোলন শুরু করে দিল। কৃষকদের বড় বড় মিছিল এলাকা পরিক্রমা করতে শুরু করলে অনেক জায়গায় কৃষকরা জমিদার কাছারিতে উৎপন্ন ধানের তিনভাগের দু’ভাগ ভাগচাষির জন্য আদায় করতে সমর্থ হল।
১৯৪৬ খ্রীষ্টাব্দে সমগ্র এলাকার চেহারা পাল্টে গেল ডিসেম্বর মাসে অনেক কাছারিতে নায়েবরা আসতে সাহস করল না – কাছারি বাড়ি ফাঁকা পড়ে রইল। সর্বত্র চাষিরা মালিকদের দেয় ধান হিসাবে তিনভাগের এক ভাগ দিতে চাইল। ছোট জোতদাররা সেদিন চাষীদের ঐক্যের কাছে নতি স্বীকার করে তেভাগার দাবিকে মেনে নিল। অপরদিকে জোতদার ইজারাদাররা শহরে পালিয়ে গিয়ে নানারকম অরাজকতার গল্প ফাঁদতে শুরু করল দৈনিক পত্র-পত্রিকায় তার বিবরণ বের হতে লাগল। সরকার আইনশৃঙ্খলার নামে পুলিশ, আধা মিলিটারি বাহিনী নিয়োগ করল। একমাত্র কাকদ্বীপ থানা এলাকায় ২১ টি পুলিশ ক্যাম্প বসানো হল। অসংখ্য ধান লুট, রাহাজানি, ডাকাতি অগ্নিসংযোগের মামলা চাষিদের বিরুদ্ধে আনা হল।
কাকদ্বীপ সাগরের কৃষক নেতাদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা নিয়ে এসে তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা হল কংসারি হালদার, অশোক বসু, হরিধন চক্রবর্তী প্রমুখের নামে ১০০/১৫০ মামলা চালু করা হল। কৃষকরা মামলার পথ ছেড়ে দিয়ে লড়াই-এর পথ ধরল নেতারা আত্মগোপন করে লড়াই চালিয়ে গেলেন। ১৯৪৭ এর শুরুতে এই আন্দোলন তীব্রতা লাভ করে এবং এ সময়ে স্টেটসম্যান পত্রিকার রিপোর্টার কাকদ্বীপ ঘুরে এসে রিপোর্ট দিচ্ছেন ১৯ শে মার্চ “৪৭ শতাব্দীর পর শতাব্দী চাষি ছিল নিশ্চুপ, আজ এক শ্লোগানের আওয়াজে সে হয়েছে সচকিত। সাথিদের নিয়ে মাঠ ভেঙে চলে। মিছিলের সামনে লাল ঝান্ডা উড়ছে- তা দেখে অনুপ্রেরণা জাগে। সবার কাঁধের ওপর রাইফেলের মতো করে ধরা আছে লাঠি।
গ্রামের নিস্তব্ধ ঝোপঝাড়ের পাশে নিজেদের মুষ্টিবদ্ধ হাত মাথার ওপর তুলে যখন সহযোগী সাথীদের ইনকিলাব কমরেড বলে অভিনন্দন জানায়- তা শুনে বুকের ভিতর কেমন একটা স্পন্দন জাগে’। এই লড়াই এক মুহূর্তে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে ভেদাভেদ দূর করে দিল রাতের অন্ধকারে শত্রুর বিরুদ্ধে আক্রমণে এগিয়ে চলেছে হিন্দু-মুসলমান একসাথে- কে বলবে কয়েকদিন আগে বাংলাদেশে এত বড় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়ে গেল। বাংলা সরকারের কাছে ডায়মন্ডহারবারের মহকুমা শাসক’৪৭ এর ৯ই মার্চ সি ২৬৬/২ আর ৩/৪৭ নম্বরের গোপন চিঠিতে জানাচ্ছেন- ‘বর্গাদাররা তাদের সমস্ত উৎপন্ন ফসল নিজেদের খামারে নিয়ে যাচ্ছে এবং জমিদারদের দিতে চাইছে ফসলের তিনভাগের এক ভাগ। জমিদাররা তা নিতে চাইছে না।(১৯)