কৃষি ও কৃষক
চতুর্থ অধ্যায়
এলাকায় হাকিমি চিকিৎসক হিসাবে এর সুনাম ছিল। মুসলমান কৃষকদের মধ্যে এর খুব জনপ্রিয়তা ছিল। ইনি সরবেড়িয়া এলাকার কুখ্যাত জমিদার শ্রীনাথ সরকারের বিরুদ্ধে চাষিদের লড়াই এ নেতৃত্ব দেন। গদাধর সিং ছিলেন আদিবাসী কৃষক নেতা প্রায় ৩০০ বিঘা জমির মালিক। এলাকার আদিবাসীরা সমাজের প্রধান হিসাবে একে ভীষণ শ্রদ্ধা করত। ইনি তেভাগা আন্দোলনের সময় বয়ারমারী কৃষক সমিতির সভাপতি ছিলেন। এরই ছেলে দেবেন সিং পরবর্তীকালে কংগ্রেসের এম. এল. এ হয়েছিলেন। সাংগঠনিক বিচারে কাকদ্বীপের কৃষক আন্দোলনের তুলনায় সন্দেশখালি ক্যানিং-এর এই আন্দোলন অনেক দুর্বলতা থাকলেও মুহূর্তের মধ্যে তা বিশাল প্রভাব সৃষ্টি করল। এই অঞ্চলে কোনদিনই বিশেষ সংগঠিত আন্দোলন এর আগে ছিল না।
বিচ্ছিন্নভাবে ২৪ পরগনা জেলা কংগ্রেসের তৎকালীন সম্পাদক মুরারিশরণ চক্রবর্তী, নলিনী প্রভাদেবী, ডঃ ভূপেন দত্ত, নীহারেন্দু দত্ত মজুমদার, প্রভাস রায়, সৌমেন ঠাকুর, সুধা রায় এবং পরবর্তীকালে মনোরঞ্জন শূর, আবদ্দুল্লাহ রসুল প্রমুখ বসিরহাট মহকুমার সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং কৃষক সমিতির কথা প্রচার করতেন। ইতিপূর্বে ১৯৩৬-৩৮ এ বসিরহাটের বিভিন্ন হাটের তোলা তোলার ব্যাপারে বিরোধিতা করে চাষিরা আন্দোলন করছেন কোথাও কোথাও। কোথাও কোথাও আবার জমিদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে চাষিদের নিয়ে আন্দোলন করার চেষ্টা হয়েছে। জমিদারের হাট খাজনার ব্যাপারে অনেকস্থানে চাষিদের সংঘবদ্ধ আন্দোলনে এরা নেতৃত্ব দিয়েছেন।
সে যুগে অনেক রায়তচাষির জমি ক্রয় বিক্রয় করার অধিকার ছিল না। সে ছিল জমিদারের অনুমতিসূত্রে জমির দখলদার। তার বসতবাটি রান্নাঘর জমিদারের অনুমতিসূত্রে সে করতে পেরেছে। ফেরিঘাট থেকে শুরু করে গ্রামের হাট সব কিছুতেই জমিদার ইচ্ছামত খাজনা ধার্য করত। দুধের খটি, মাছের খটি করতে গেলে নায়েবের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হত। জমিদার নিয়োজিত খটির মালিকের কাছে, ধানের ব্যাপারির কাছে, চাষি তার উৎপাদন বিক্রয় করতে বাধ্য থাকত জমিদার তার এলাকার জলনিকাশি ব্যবস্থা এবং নদীর লোনা যাতে জমিকে প্লাবিত না করতে পারে সে ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা নিত না। এরই বিরুদ্ধে হাসনাবাদ, হিঙ্গলগঞ্জ, বারুইপুর, সোনারপুর, মহেশতলা, বজবজে কৃষকদের বিক্ষোভ ২য় মহাযুদ্ধের পূর্বে লক্ষ কর যাচ্ছিল। ১৯৩৪-৩৬ সালের দিকে খাস জমির আন্দোলন বেশ কিছু এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।
হাড়োয়ার উচিলদহ কামারগাতিতে ১৯৩৬ এ শ্রীশ মণ্ডলের নেতৃত্বে পোর্ট ক্যানিং জমিদারির বিরুদ্ধে খাস জমির লড়াই এ অঞ্চলে বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করে; এই সময়ে গোবেড়িয়া জলকর উচ্ছেদের আন্দোলনও দানা বেধে ওঠে। পোর্ট ক্যানিং জমিদারির বিরুদ্ধে চাষিরা দাবি তোলে জঙ্গল হাসিল করা জমি চাষিকে ফেরত দিতে হবে- মহাজনী ঋণের জুলুম বন্ধ করতে হবে। বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য বঙ্কিম মুখার্জি ১৯৩৮ এ ১৫ হাজার মানুষের এক বিশাল জনসভায় কৃষকদের সমর্থনে বক্তৃতা দেন। কৃষক সভার তৎপরতায় ২৪ পরগনার জেলা শাসক কার্টার তদন্ত করতে এসে মিনাখাঁতে পোর্ট ক্যানিং কোম্পানির কাছারিতে আসেন এবং কৃষক প্রতিনিধিদের বক্তব্য শুনতে চান। কয়েকহাজার চাষি প্রতিবাদ জানায় জমিদারের সামিয়ানার তলায় বসে তদন্ত করা চলবে না। কাছারির পাইক বরকন্দাজরা চাষিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং প্রচণ্ড সংঘর্ষে জমিদার পক্ষের একজন মারা যায়।