কৃষি ও কৃষক
চতুর্থ অধ্যায়
চাষিদের ওপর জমিদার ও পুলিশের অত্যাচার নেমে আসে, শ্রীশ মণ্ডলসহ অনেকের নামে নরহত্যার কেস দিয়ে মামলা আনা হয়। দীর্ঘকাল ধরে মামলা চলে কিন্তু চাষিদের বিরুদ্ধে কাউকে সাক্ষী দেওয়ানো গেল না; পরবর্তীকালে আসামিরা বেকসুর খালাস। পেল। এই সময়ে ফলতার জ্যোতিষ রায়কে মিনাখাঁর কাছারির নায়েব জোর করে ধরে সারাদিন কাছারির বটগাছের গায়ে বেঁধে রাখে। এই ঘটনার বেশ কিছু আগে ১৯৩৫ সালের দিকে সন্দেশখালির দাউদপুরে কৃষকনেতা ডঃ ভূপেন দত্ত, নলিনীপ্রভা ঘোষ, প্রভাস রায়কে আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে রাতের অন্ধকারে দাউদপুরের জমিদার জ্যোতিষ রায়ের নায়েব গরিব চাষি উমাশংকর মাইতি ও তার পরিবারের সমস্ত লোককে হত্যা করে এবং তার বসতবাড়ি রাতের মধ্যে ভেঙে ফেলে সেখানে মাটি কেটে ধান চাষ করে।
দু-দিন পরে সন্দেশখালি থানার পুলিশ তদন্তে আসে কিন্তু উমাশংকরের হত্যাকারীর কাছারিতে রাত্রি যাপন করে ফিরে যায়। তার ঠিক পরের বছর উচিলদহের কৃষকরা পোর্ট ক্যানিং কোম্পানির দুজন পাইককে উমাশংকরের মৃত্যুর বদলা নেয়। ১৯৩৮ এ হাড়োয়ার ব্রাহ্মণচকে উচ্ছেদবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। কৃষকসভার সর্বভারতীয় নেতা ইন্দুলাল যাজ্ঞিক এখানে এসে এক বিশাল জনসভায় বক্তৃতা করেন। হাড়োয়ার এই অংশে কৃষকদের ওপর বলশেভিক পার্টির প্রভাব ছিল, তাদের পার্টি কর্মী সুধাংশু দত্ত, হরেন ব্যানার্জি প্রমুখ কৃষকদের সংগঠিত করার ব্যাপারে দায়িত্ব নেন। এ সময়ে ঝুপখালিতে কৃষক রমণী তরুবালা দারোগার রিভলবার কেড়ে নেন এবং পরবর্তীকালে এই তরুবালা আর. সি. পি. আই. পার্টির কর্মী হিসাবে সন্দেশখালি হাড়োয়ার বিভিন্ন কৃষকাঞ্চলে কৃষকদের সংগঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
উচিলদহের কৃষক আন্দোলনের নেত্রী নলিনীপ্রভা ঘোষ – এর কন্যা বীণা ঘোষ (পরবর্তীকালের উপাধি দুবে) বামনপুকুরে কৃষক রমণীদের ট্রেনিং ক্যাম্প পরিচালনা করেন পুলিশ ও জোতদারের আক্রমণের বিরুদ্ধে কীভাবে লড়াই করা যায় তার কৌশল শেখানোর জন্য এই ট্রেনিং ক্যাম্প। অশিক্ষিত মেয়েদের ট্রেনিং দেবার জন্য বাঁ পায়ে ঘাস, ডান পায়ে বিচালী বেঁধে লেফট রাইট করানো হত। এই সময়ে আলিপুরের বলরামপুরের কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা হয় খাল কাটাকে কেন্দ্র করে পুলিশি জুলুম তীব্র হয়ে ওঠে।
এই পটভূমিকায় দাঁড়িয়ে বসিরহাটের বিভিন্ন প্রান্তে কৃষকরা তেভাগা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। সরকারি রিপোর্টে জানা যাচ্ছে তেভাগা আন্দোলনের শুরুতে দু-মাসের মধ্যে ৯ জন জমিদার জোতদারের কাছারিতে গাদা ভাঙা আন্দোলনে চাষিরা সামিল হয়েছে। ১০ই মার্চ ৪৭ এর অমৃতবাজার পত্রিকায় জানা যাচ্ছে- কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান দপ্তর থেকে একটি বিবৃতিতে জানানো হয় ‘সন্দেশখালি থানার বেড়মজুর গ্রামে। পুলিশের গুলি চালনার ফলে মৃতের সংখ্যা কমপক্ষে ৭ জন, নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে ৩ জন। পাঁচ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক, আঠারো জন আহত’। হিন্দুস্থান স্টান্ডার্ড ১৯ শে মার্চ ৪৭-এ ২৪ পরগনা কৃষক সমিতির বিবৃতি থেকে জানা যাচ্ছে ২০০ সশস্ত্র পুলিশ বেড়মজুর সরবেড়িয়া মঠেরদিঘিসহ বিভিন্নস্থানে মোতায়েন করা হয়েছে। বাড়ি বাড়ি খানাতল্লাশি চালানো হচ্ছে এবং গ্রামবাসীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে’।