কবিগান
বাড়ি ফিরিয়া কবিগান গাহিয়া বাড়ির সকলকে বিরক্ত করিয়া তুলিলাম। পরদিন সকালে নদীর তীরে যাইয়া নাচিয়া নাচিয়া আবার কবিগান অভ্যাস করিতে লাগিলাম। এইভাবে সাত-আট দিন সমানে আমার কবিগানের রিহার্সাল চলিল।
তাঁতিপাড়ার রহিম মল্লিকের কথা আগে কিছু বলিয়াছি। গ্রাম-সম্পর্কে তাহাকে চাচা বলিয়া ডাকি। সে কিছুটা মনোক্তি করিয়া কবিগান গাহিতে পারিত। একদিন সকালে যাইয়া চাচাকে ধরিলাম, “চাচা! তোমার সঙ্গে আমি কবিগানের পাল্লা করিব।” চাচা তাঁত চালাইতেছিল। চাচি নানা রঙের সুতা চরকায় ভরিয়া উঠানে গাড়া কাঠিগুলিতে তেনা কাড়াইতেছিল। চাচির সৌন্দর্যের কথা গ্রামগুলিতে প্রবাদের মতো ছিল। চাচা চাচিকে ডাকিয়া বলিল, “আমাগো বাড়ির উনি শুনিবে নাকি? আজ চাচা-ভাজতের কবির লড়াই হইবে।”
চাচি একপাশে দাঁড়াইয়া খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।
কিন্তু চাচার তাঁত চালানো কি সহজে থামে? প্রায় ঘণ্টা দুই বসিয়া রহিলাম। তাঁতের মধ্যে মাকুটি যেমন এদিক-ওদিক ঘুরিতেছিল তেমনি আমার মনের মধ্যে করিতেছিল। অনেকক্ষণ পর চাচা তাঁত ছাড়িয়া উঠানে আসিয়া দাঁড়াইয়া আমাকে প্রথম পালা গাহিতে বলিল। আমি যম-রাজা হইয়া চাচাকে সতীর পক্ষ বানাইয়া কিছুটা ছড়া গাহিয়া তাহাকে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে আহ্বান করিলাম। চাচা উঠিয়া সতীর পক্ষ না লইয়া আমার অনাগত শাশুড়িকে লইয়া নানারকম ঠাট্টা-বিদ্রূপ করিয়া তাহার পালা শেষ করিল। তখন আমি কোমর বাঁধিয়া আমার সেই না-আসা শাশুড়িকে সমর্থন করিয়া পদ রচনা করিতে লাগিলাম। তারপর চাচার শাশুড়ির রূপের বর্ণনা আরম্ভ করিলাম। তার নাক ছিল মহিষ কাটার খাঁড়ার মতো। মশায় লাথি দিয়া বোঁচা করিয়া দিয়াছে। কান দুইটি ভাঙা কুলার মতো। সেই কানে ভাঙা কোদালের নোলক পরিয়া গজারি খামের মতো পা ফেলিয়া সেই সুন্দরী যখন ধাপুর ধুপুর করিয়া হাঁটে তখন উঠানের মাটি কাঁপিয়া উঠে। ইত্যাকার বর্ণনা শুনিয়া চাচি হাসিয়া কুটিকুটি হইতেছিল। আমাদের উপস্থিত বর্ণনা মাঝে মাঝে শ্লীল-অশ্লীলের মাত্রা ছাড়াইয়া যাইতেছিল।
কিন্তু গ্রামদেশে কে অতটা গণ্য করে। দুই-এক পালা গাহিয়াই চাচা স্নান করিতে চলিল।
আমার কিন্তু গান গাহিয়া তৃপ্তি হইল না। সারাদিনও যদি এরূপ পাল্লা করিয়া গান গাহিতাম
তবুও হয়তো আমার মনের সাধ মিটিত না। ইহার পরে ছোট গাঙের পুলের এপারে নদীর ঘাটে বহু জায়গায় চাচার সঙ্গে পাল্লা করিয়াছি। সমস্ত পাল্লারই বিষয়বস্তু ছিল যার যার শাশুড়ি। শোভারামপুরে সুতোরপাড়ায় একজন বৃদ্ধ লোক ছিল। আমার মতো তারও কবিগান গাওয়ার শখ। একদিন সুতোরপাড়ায় যাইয়া তাহাকে ধরিলাম কবিগানের পাল্লা করিতে। আমাদের পাল্লা শুনিবার জন্য গাঁয়ের বহুলোক আসিয়া জড় হইল। গান শেষ হইলে একজন বৃদ্ধলোক বলিল, “এই ছেলেটি বাঁচিয়া থাকিলে একজন বড় কবিয়াল হইবে।”
তখন আমার কিইবা বয়স। বোধহয় সাত-আট বৎসর। কিন্তু বৃদ্ধের এই ভবিষ্যদ্বাণী সার্থক করিবার জন্য প্রাণপণে কবিগান আয়ত্ত করিতে লাগিলাম। পার্শ্ববর্তী হিন্দুপাড়ায় যখন যেখানেই কবিগান হয়, খবর পাইলেই আমি সেখানে যাইয়া উপস্থিত হই। কবিগান আরম্ভ হইত রাত এগারোটা বারোটায়। তার পরদিন বেলা দেড়টা-দুইটা পর্যন্ত গান চলিত। আজকাল আগেকার মতো সেইরূপ কবিগান শুনি না। আগে প্রত্যেক কবির দলে আট-দশজন করিয়া দোহার থাকিত। তাহারা কখনও দাঁড়াইয়া কখনও নিলডাউন হইয়া কানে আঙুল দিয়া প্রতিপক্ষের উত্তর প্রতি-উত্তর অবলম্বন করিয়া যে-গান গাহিত তাহাকেই সত্যিকার কবিগান বলে। এই গানের সুরের মধ্যে কীর্তনের সঙ্গে বাউল, ভাটিয়ালি ইত্যাদি সুরের মিশ্রণ ছিল বলিয়া উহা জনগণের হৃদয়গ্রাহী হইত। প্রত্যেকটি গানে আবার চিতান পরচিতান প্রভৃতি নানা পর্যায় ছিল। এইসব গান যাহারা রচনা করিত বা গাহিত, কবির দলে তাহাদেরই সম্মান ছিল বেশি। উপস্থিত বোল বলিয়া যাহারা ছড়া রচনা করিত তাহাদের সম্মান তত ছিল না। তাহারা ছড়াদার নামে পরিচিত ছিল। আজকাল কবির দলের গানগুলি একমাত্র ছড়াসর্বস্ব হইয়া উঠিয়াছে।
আগেকার দিনে কোনো কোনো গানের দলে তিন-চারজন স্ত্রীলোক গায়িকা থাকিত। রাত্রি ভোর হইলে তাহারা যখন কণ্ঠে কণ্ঠ মিলাইয়া বিলম্বিত লয়ের ভোর-গানগুলি গাহিত তখন শ্রোতাদের সকলেরই চক্ষু অশ্রুভারাক্রান্ত হইত।
“কালো কোকিল তুই ডাকিস নারে আর।
নিশি প্রভাত কালেতে প্রাণনাথ নাই যার ঘরেতে
কি করিয়া বলরে কোকিল জীবন রহিবে রাধার।”
চলবে…
Sarakhon Report 



















