কবিগান
সেটা বোধহয় ১৯৩২ সন। ওড়াকান্দির রাজেন সরকার তাঁর দুই শিষ্য বিজয় আর নিশিকান্তকে লইয়া আমার কলিকাতার মেসে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তাঁহাদের সঙ্গে আলাপ করিয়া জানিলাম তাঁহারা সদলবলে আসিয়াছেন কলিকাতায় কবিগান প্রচারের জন্য। দলের অন্যান্য গায়কেরা নৌকায় অবস্থান করিতেছে।
কলিকাতার এলবার্ট হল ভাড়া লইয়া নির্দিষ্ট তিনদিন তাঁহাদের কবিগানের ব্যবস্থা করিলাম। টিকেটের মূল্য তিনটাকা, একটাকা আর চার আনা। তারপর আমার মেসে সারাদিন চলিল তাঁহাদের গানের মহড়া। যেসব ধুয়ার সুর চটকদার এবং বিলম্বিত লয়ের করুণ সুর, সেগুলিকে দিয়া নূতন করিয়া পাল্টি রচনা করিয়া দিলাম। শহরের লোকেরা বহুক্ষণ গান শোনে না। তাই প্রত্যেক পাল্টিতে একঘণ্টা সময় নির্দেশ করিলাম। বন্দনা গাহিয়া আর এক গান বারবার গাহিয়া সময় নষ্ট না করার নির্দেশও দিলাম। কলিকাতার কাগজগুলিতে কবিগানের উপর নানা খবর ও প্রবন্ধ ছাপাইবার ব্যবস্থা করিলাম। তখনকার এসোসিয়েট প্রেসের মিঃ নিয়োগী এই ব্যাপারে আন্তরিকতাপূর্ণ সাহায্য করিয়াছিলেন। নির্দিষ্ট দিনে এলবার্ট হলে কবিগান হইল।
তেমন আশানুরূপ জনসমাগম হইল না। পূর্ণ ভট্টাচার্য নামে এক ব্যক্তি ‘আনন্দবাজার পত্রিকায়’ এক বিবৃতি দিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, কবিগানকে এই দলের লোকেরা আধুনিক রূপ দিয়া ইহার রসাত্মক দিকটিকে ক্ষুণ্ণ করিয়াছেন। সখী-সংবাদ, ভোরগান প্রভৃতি যাহা কবিগানের অলঙ্কারস্বরূপ ছিল, তাহা বর্জন করিয়া ইহারা কবিগানকে ছড়া-সর্বস্ব বানাইয়া কবিগানের আসল রূপটিই নষ্ট করিয়াছেন। ইত্যাকার সমালোচনায় পরদিন আর কবিগানে তেমন জনসমাগম হইল না। রাজেন সরকার আশাভঙ্গ হইয়া পাগলের মতো হইয়া পড়িলেন। সঙ্গী-সাথীদিগকে দেশে পাঠাইতে রাজেন সরকারকে তার বহুকালের সঙ্গী নৌকাখানিকে বিক্রয় করিয়া দিতে হইল। কত আশা লইয়াই তিনি কলিকাতা আসিয়াছিলেন। কিন্তু গ্রামদেশের মানুষ যে এখানে আসিয়া তাহার রুচি বদলাইয়াছে, আর যে তাহারা গ্রামবাংলার সেই রসধারায় ফিরিয়া যাইবে না একথা হতভাগ্য রাজেন সরকার জানিতেন না।
তিনি যথাসর্বস্ব খোয়াইয়াও কলিকাতা ছাড়িয়া গেলেন না। পাগলের মতো কেবল বলিতেন, “কলিকাতায় কবিগান প্রচার না করিয়া আর আমি দেশে ফিরিয়া যাইব না।” শুনিতে পাই এখনও তিনি নাকি কলিকাতায়ই আছেন। বৃদ্ধ হইয়া পড়িয়াছেন। আগের মতো কণ্ঠস্বর নাই। কলিকাতার আশেপাশে পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের বসতিপ্রধান স্থানে কবিগান গাহিয়া বেড়ান। আধুনিক সমাজে লোক-সংগীত প্রচারের ইতিহাস যদি কেহ লেখেন রাজেন সরকারের এই প্রচেষ্টা সেখানে একটি বড় স্থান অধিকার করিবে।
কবিগান উপলক্ষে বিজয় আর নিশিকান্তের সঙ্গে আমার বেশ বন্ধুত্ব হইয়া পড়ে। আমার ঘরে বহুবার তাহাদের সঙ্গে কবিগানের পাল্লা দিয়াছি। একবার কলিকাতা বেতারে রাজেন সরকারের সঙ্গেও পাল্লা দিয়াছিলাম। আমাদের পাল্টার বিষয়বস্তু ছিল হুঁকো আর কলকে। রাজেন সরকারের সঙ্গে তাঁহার গুরু সেকালের প্রসিদ্ধ কবিয়াল হরিবরও আসিয়াছিলেন।
তিনি তখন বৃদ্ধ হইয়াছেন। কিন্তু আসরে নামাইয়া দিলে তখনও ছড়া রচনায় তাঁহার উৎসাহের অন্ত ছিল না। করুণ রসের কোনো কাহিনী বর্ণনায় তিনি নিজে কাঁদিয়া শ্রোতাদিগকেও কাঁদাইতেন।
চলবে…