১১:২৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫
আমির খসরুর আসন পরিবর্তন, তার আসনে মনোনয়ন পেলেন সাঈদ নোমান এনসিপি ছাড়লেন তাসনিম জারা থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে ৭২ ঘণ্টার যুদ্ধবিরতি চুক্তি সিলেটে বিপুল পরিমাণ ভারতীয় নিষিদ্ধ বিড়িসহ যুবক গ্রেপ্তার একীভূত পাঁচ ব্যাংকের আমানত উত্তোলনে বিলম্ব, এ বছর অর্থ ছাড়ের সুযোগ নেই নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রতিবেদন: ধর্ম অবমাননার অভিযোগে হিন্দু শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যা, বাংলাদেশে সহিংসতা নিয়ে উদ্বেগ কিশোরগঞ্জের পাগলা মসজিদের দানবাক্সে মিলল ৩৫ বস্তা টাকা ও স্বর্ণালংকার ঘন কুয়াশায় ঢাকায় আটটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ঘুরিয়ে দেওয়া হলো ঢাবিতে শরিফ ওসমান হাদির কবরে ফাতেহা দিলেন তারেক রহমান ফরিদপুরে ট্রাকের ধাক্কায় অ্যাম্বুলেন্স বিধ্বস্ত, একই পরিবারের তিনজন নিহত

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৭৭)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:২০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪
  • 43

মধু পণ্ডিত

আমাদের গ্রামে হিন্দুপাড়ায় মধু পণ্ডিতের বাড়ি ছিল। ইনি ন্যায়, কাব্য, দর্শন প্রভৃতি শাস্ত্রে অগাধ পণ্ডিত ছিলেন। সেকালে বড়লোক হিন্দুদের বাড়িতে শ্রাদ্ধে বা বিবাহে পণ্ডিতদের সভা বসিত। সেখানে পণ্ডিতেরা বসিয়া নানা বিষয়ে আলোচনা করিতেন। উপস্থিত নিমন্ত্রিতেরা তাহা শুনিয়া অজস্র জ্ঞান লাভ করিত। এইসব পণ্ডিত-সভায় মধু পণ্ডিতের স্থান

ছিল সকলের অগ্রে। শ্রাদ্ধ-শান্তি, অন্নপ্রাশন প্রভৃতি অনুষ্ঠান হইতে পণ্ডিত মহাশয় যেসব দান-সামগ্রী পাইতেন তাহা দিয়া তিনি নিজের বাড়িতে একটি টোল চালাইতেন। দশ-বারোজন ছাত্র পণ্ডিত মহাশয়ের বাড়িতে আহার এবং বাসস্থান পাইয়া তাঁহার নিকটে সংস্কৃত শাস্ত্র অধ্যয়ন করিতেন। এতবড় পণ্ডিত হইয়াও তিনি ছিলেন বালকের মতো সরল, একেবারে নিরহঙ্কারী। দেশের হিন্দু-মুসলমান সকলেই তাঁহাকে ভালোবাসিত। তাঁহার গৃহের যে দেবতাকে তিনি প্রতিদিন ফুল-বেলপাতা দিয়া পূজা করিতেন সেই দেবতার মতোই তিনি গ্রামদেশের লোকদের পূজা-শ্রদ্ধা পাইতেন। স্থানীয় ঈশান স্কুলে তিনি হেড পণ্ডিতের চাকরি করিতেন। তিনি যখন স্কুলে যাইতেন সুযোগ পাইলে আমি তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে যাইতাম।

আমার মনে হইত তাঁহার সঙ্গে গেলে তাঁহার বিদ্যার কিছুটা আমি আয়ত্ত করিতে পারিব। আমি ছোট বলিয়া তিনি আমাকে অবহেলা করিতেন না। যে যে বিষয়ে আমার বালকমনে কৌতূহল জাগিত তিনি সেই বিষয় লইয়া আমার সঙ্গে আলাপ করিতেন। তাঁর সঙ্গে কোন দিন কি কি আলাপ হইত আজ এতদিন পরে মনে করিতে পারিতেছি না। শুধু একদিনের কথা মনে আছে। পণ্ডিত মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আমি বাংলায় বই লিখিতে চাই। আপনি আমাকে কিছু উপদেশ দেন। এজন্য আমাকে কি করিতে হইবে?”

তিনি হাসিয়া বলিলেন, “তুমি বাঙালির ছেলে। যাহা লিখিবে তাহাই বাংলা হইবে। এজন্য তোমাকে কোনোকিছু করিতে হইবে না। তোমার যাহা বলিবার আছে, যেমন আমার সঙ্গে কথা বলিতেছ তেমন করিয়াই লিখিবে। তাহাই হইবে তোমার সবচাইতে উৎকৃষ্ট রচনা।” পরবর্তী জীবনে পণ্ডিত মহাশয়ের এই উপদেশ আমি আমার গদ্যরচনায় প্রয়োগ করিতে চেষ্টা করিয়াছি।

পণ্ডিত মহাশয়ের মৃত্যুর পর তাঁহার টোলটি উঠিয়া গেল। টোলের ছাত্রেরা যাঁর যাঁর বাড়ি চলিয়া গেলেন। পণ্ডিত মহাশয়ের শূন্য বাড়ি হইতে ইতস্তত-বিক্ষিপ্ত হস্ত-রেখাঙ্কিত-তালপত্রগুলি কুড়াইয়া আনিয়া পাড়ার বালকেরা ইচ্ছামতো খেলাঘর সাজাইল। তাঁহার গৃহে সে-কালের লিখিত কত পুঁথিপত্রই না ছিল। সেগুলি উপযুক্ত উত্তরাধিকারীর অভাবে বালকদের খেলার সামগ্রী হইয়া চিরকালের মতো মানবসমাজের উপকারে না আসিয়া অনন্ত বিস্মৃতিগর্ভে বিলীন হইল।

চলবে…

জনপ্রিয় সংবাদ

আমির খসরুর আসন পরিবর্তন, তার আসনে মনোনয়ন পেলেন সাঈদ নোমান

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-৭৭)

১১:০০:২০ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪

মধু পণ্ডিত

আমাদের গ্রামে হিন্দুপাড়ায় মধু পণ্ডিতের বাড়ি ছিল। ইনি ন্যায়, কাব্য, দর্শন প্রভৃতি শাস্ত্রে অগাধ পণ্ডিত ছিলেন। সেকালে বড়লোক হিন্দুদের বাড়িতে শ্রাদ্ধে বা বিবাহে পণ্ডিতদের সভা বসিত। সেখানে পণ্ডিতেরা বসিয়া নানা বিষয়ে আলোচনা করিতেন। উপস্থিত নিমন্ত্রিতেরা তাহা শুনিয়া অজস্র জ্ঞান লাভ করিত। এইসব পণ্ডিত-সভায় মধু পণ্ডিতের স্থান

ছিল সকলের অগ্রে। শ্রাদ্ধ-শান্তি, অন্নপ্রাশন প্রভৃতি অনুষ্ঠান হইতে পণ্ডিত মহাশয় যেসব দান-সামগ্রী পাইতেন তাহা দিয়া তিনি নিজের বাড়িতে একটি টোল চালাইতেন। দশ-বারোজন ছাত্র পণ্ডিত মহাশয়ের বাড়িতে আহার এবং বাসস্থান পাইয়া তাঁহার নিকটে সংস্কৃত শাস্ত্র অধ্যয়ন করিতেন। এতবড় পণ্ডিত হইয়াও তিনি ছিলেন বালকের মতো সরল, একেবারে নিরহঙ্কারী। দেশের হিন্দু-মুসলমান সকলেই তাঁহাকে ভালোবাসিত। তাঁহার গৃহের যে দেবতাকে তিনি প্রতিদিন ফুল-বেলপাতা দিয়া পূজা করিতেন সেই দেবতার মতোই তিনি গ্রামদেশের লোকদের পূজা-শ্রদ্ধা পাইতেন। স্থানীয় ঈশান স্কুলে তিনি হেড পণ্ডিতের চাকরি করিতেন। তিনি যখন স্কুলে যাইতেন সুযোগ পাইলে আমি তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে যাইতাম।

আমার মনে হইত তাঁহার সঙ্গে গেলে তাঁহার বিদ্যার কিছুটা আমি আয়ত্ত করিতে পারিব। আমি ছোট বলিয়া তিনি আমাকে অবহেলা করিতেন না। যে যে বিষয়ে আমার বালকমনে কৌতূহল জাগিত তিনি সেই বিষয় লইয়া আমার সঙ্গে আলাপ করিতেন। তাঁর সঙ্গে কোন দিন কি কি আলাপ হইত আজ এতদিন পরে মনে করিতে পারিতেছি না। শুধু একদিনের কথা মনে আছে। পণ্ডিত মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করিলাম, “আমি বাংলায় বই লিখিতে চাই। আপনি আমাকে কিছু উপদেশ দেন। এজন্য আমাকে কি করিতে হইবে?”

তিনি হাসিয়া বলিলেন, “তুমি বাঙালির ছেলে। যাহা লিখিবে তাহাই বাংলা হইবে। এজন্য তোমাকে কোনোকিছু করিতে হইবে না। তোমার যাহা বলিবার আছে, যেমন আমার সঙ্গে কথা বলিতেছ তেমন করিয়াই লিখিবে। তাহাই হইবে তোমার সবচাইতে উৎকৃষ্ট রচনা।” পরবর্তী জীবনে পণ্ডিত মহাশয়ের এই উপদেশ আমি আমার গদ্যরচনায় প্রয়োগ করিতে চেষ্টা করিয়াছি।

পণ্ডিত মহাশয়ের মৃত্যুর পর তাঁহার টোলটি উঠিয়া গেল। টোলের ছাত্রেরা যাঁর যাঁর বাড়ি চলিয়া গেলেন। পণ্ডিত মহাশয়ের শূন্য বাড়ি হইতে ইতস্তত-বিক্ষিপ্ত হস্ত-রেখাঙ্কিত-তালপত্রগুলি কুড়াইয়া আনিয়া পাড়ার বালকেরা ইচ্ছামতো খেলাঘর সাজাইল। তাঁহার গৃহে সে-কালের লিখিত কত পুঁথিপত্রই না ছিল। সেগুলি উপযুক্ত উত্তরাধিকারীর অভাবে বালকদের খেলার সামগ্রী হইয়া চিরকালের মতো মানবসমাজের উপকারে না আসিয়া অনন্ত বিস্মৃতিগর্ভে বিলীন হইল।

চলবে…