সেকালের যাত্রাগান
ছোটবেলায় আমি আর আমার চাচাতো ভাই নেহাজদ্দীন দুইজনে মিলিয়া ফরিদপুরের চৌধুরীবাড়িতে যাত্রাগান শুনিতে যাইতাম। গান হইবার তিন-চারদিন আগে হইতেই আমাদের মধ্যে নানারকম জল্পনা-কল্পনা হইত। গানের দিন সন্ধ্যা হইতেই আমরা চৌধুরীবাড়িতে যাইয়া উপস্থিত হইতাম। চৌধুরীদের বাগানে রাশি রাশি শেফালি ফুল ফুটিয়া চারিদিকে গন্ধ ছড়াইত। জোছনা ধব-ধব রাত্রে সেই ফুলের সুবাস আসন্ন যাত্রাগানের আবেশটি যেন আমাদের বুকে ভরিয়া দিত।
চৌধুরীদের উঠানে একটি মণ্ডপঘর ছিল। তাহারই মাঝখানে যাত্রাগানের আসর বসিত।
যেদিকে প্রতিমা সেদিকে সামনের ফরাসে বসিত চৌধুরীবাড়ির ছেলেমেয়েরা। কি সুন্দর জামা কাপড় পরিয়া তাহারা আসিত। মেয়েদের গায়ে সোনার গহনা ঝলমল করিত। মনে হইত তাহারাই যেন অলঙ্কার হইয়া প্রতিমার শোভাবর্ধন করিতেছে। আসরের ডানধারে বামধারে বসিত উপস্থিত হিন্দু জনসাধারণ। যেদিকে পিছন করিয়া যাত্রার রাজা-রানীদের বসিবার জন্য চেয়ার দেওয়া হইত সেদিকে চাটাইয়ের উপর মুসলমানদের বসার জায়গা ছিল। আমি আর নেহাজদ্দীন সকলের আগে যাইয়া সেই চাটাইয়ের সামনে বসিতাম। যাত্রাগানের কোনো জায়গায় কোনো বিয়োগান্ত ঘটনা ঘটিলেই জুড়িরা উঠিয়া বিলম্বিত লয়ে গান ধরিত। যাত্রার দলের বালকেরা সোনা-রূপার কাজকরা বনাতের পোশাক পরিয়া সেই গানের দোয়ার্কি করিত। একবার শ্যামা বাগ্দীর দল চৌধুরী-বাড়িতে গান করিতে আসিল। তখনকার দিনে মাইকের প্রচলন হয় নাই। হাজার হাজার শ্রোতার সামনে গলাভরা মেডেল ঝুলাইয়া শ্যামা বাগ্দী যখন গান ধরিত তখন শ্রোতাদের মধ্যে এরূপ নীরবতা আসিত যেন সুইটি পড়িলে শোনা যায়। শক্তিশেলে আহত লক্ষ্মণকে সামনে লইয়া রামচন্দ্র যখন বিলাপ করিত, তখন শ্যামা বাগ্দী উঠিয়া গান ধরিত:
একবার দাদা বলে ডাকরে ভাই লক্ষ্মণ।
সেই গান শুনিয়া শ্রোতারা কেহই অশ্রু সংবরণ করিতে পারিত না। সেকালে শ্যামা বাগ্দীর মতো এমন ভালো কণ্ঠস্বর বোধহয় আর কাহারও ছিল না। আজ যে যাত্রাগান উঠিয়া যাইতেছে তাহার কারণ দেশের শ্রেষ্ঠ গুণীরা এখন সিনেমা, রেডিও প্রভৃতিতে যথেষ্ট উপার্জন করেন। যাত্রাগানের অধিকারীরা তাঁহাদিগকে সেরূপ টাকা দিতে পারেন না।
যাত্রাগানের আসরে আমার সবচাইতে ভালো লাগিত যেখানটিতে যুদ্ধ আরম্ভ হইত। আমি বড়ই ঘুমকাতুরে ছিলাম। নেহাজদ্দীনকে বলিয়া দিতাম, “দেখ, আমি একটু ঘুমাইয়া লই। যেখানটিতে যুদ্ধ আরম্ভ হইবে আমাকে ডাকিয়া দিস।” এই অনুরোধ সে রক্ষা করিত।
চলবে…