সেকালের যাত্রাগান
রাজায় রাজায় যখন যুদ্ধ হইত, আর সেই যুদ্ধের তালে তালে যখন বাজনা বাজিত তখন এক নিশ্বাসে চাহিয়া থাকিতাম কে হারে কে জেতে জানিবার জন্য। যুদ্ধে এক পক্ষের রাজার মৃত্যু হইলে, আমাদের বয়সী রাজার সুদর্শন ছোট্ট ছেলেটি আসিয়া যখন প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করিয়া একেবারে নাস্তানাবুদ করিয়া তুলিত, তখন মনে হইত এ জয় যেন আমাদেরই।
যাত্রার দলের কৃষ্ণ হইয়া যে ছেলেটি গান গাহিত, প্রতিদিন তাহার অভিনয় ও গান শুনিয়া তাহার সঙ্গে মনে মনে একটি বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করিতাম। শেষ গানের দিন অভিনয় করিয়া তাহারা চলিয়া যাইবে। সেদিন সেই বালকটির জন্য মনে মনে কতই ব্যথা অনুভব করিতাম। আহ। এর সঙ্গে আর তো জীবনে কখনও দেখা হইবে না।
রাত একটার সময় বলিদান হইত। এই সময় মুসলমানদের মণ্ডপঘর হইতে বাহিরে চলিয়া যাইতে হইত। তাহারা চলিয়া গেলে তাহাদের পরিত্যক্ত সামনের আসনগুলি হিন্দু শ্রোতারা আসিয়া দখল করিত। তাই তাহারা সহজে আসন ছাড়িয়া যাইতে চাহিত না। সেবার জমিদার শুনিতে পাইলেন, বলিদানের সময় বহু মুসলমান পুজার মণ্ডপঘরে রহিয়াছে। জমিদার তখন তাঁহার রূপা-বাঁধানো লাঠিখানা লইয়া মুসলমানদিগকে মারিয়া বাহির করিয়া দিলেন। কেহই ইহার প্রতিবাদ করিল না। পুজা শেষ হইলে যাহারা জমিদারের মার খাওয়ায় কিঞ্চিৎ জখম হইয়াছিল সেই ক্ষতস্থানে ধূলা লাগাইয়া পূর্বের মতোই আবার সেই চাটাইয়ের উপর বসিয়া গান শুনিতে লাগিল। ফরিদপুর জেলা ফরাজী-আন্দোলনের পটভূমি। এখানে বর্ধিষ্ণু মুসলমানেরা বাড়িতে গান-বাজনার অনুষ্ঠান তো করিতেনই না, মুসলমান হইয়া যাহারা গান-বাজনা করে তাহাদিগকেও তাঁহারা একঘরে করিয়া ছাড়িতেন। কিন্তু গান শুনিবার ক্ষুধা মানব-মনের চিরন্তন আকুতি, তাই নানা অবহেলা-অপমান সহ্য করিয়াও মুসলমানেরা হিন্দুর পূজা-পার্বণে গান শুনিয়া মনের ক্ষুধার নিবৃত্তি করিত।
চৌধুরীবাড়ির অপমানের খবর পাইয়া মুসলমান প্রধানেরা জমিদার-বাড়ির এই পূজা বয়কট করিতে বিজ্ঞাপন ছড়াইয়াছিলেন। সে-বছর দুর্গা পূজার মেলার দিনে মুসলমানেরা আর বাইচের নৌকা লইয়া আসিল না। কিন্তু গান শুনিতে আগের মতোই জমিদার-বাড়িতে আসিয়া ভিড় করিল। সমাজের নেতারা যদি নিজের সমাজে অনুরূপ গানের ব্যবস্থা করিতেন তবে এই বয়কট-আন্দোলন সফল হইতে পারিত। কিন্তু এত কথা ভাবিবার লোক তখনও আমাদের সমাজে আসে নাই। এখনও আসিয়াছে কি না সন্দেহ।
যাত্রাগানের বিরামের সময় আমি আর নেহাজদ্দীন বাহিরে আসিতাম। সামনের দোকানে দোকানে কতরকমের খাবার। শত শত লোক আসিয়া বসিয়া খাইতেছে। আমরা দু’ভাই সন্ধ্যাবেলায় বাড়ি হইতে আসিয়াছি। ভালো করিয়া খাইয়া আসিতে পারি নাই। ক্ষুধায় পেট জ্বলিতেছে। কিন্তু পকেটে পয়সা নাই। মার কাছ হইতে চাহিয়া-চিন্তিয়া একটামাত্র পয়সা আনিয়াছি। সেই এক পয়সার পান কিনিয়া দুইভাই খাইয়া আবার যাত্রার আসরে যাইয়া বসিতাম।
যাত্রা শুনিয়া পরের দিন বাড়ি যাইয়া ঘুমাইয়া পড়িতাম। দুপুরবেলা ঘুম হইতে জাগিয়া উঠিয়া দুইভাই আমি আর নেহাজদ্দীন নদীর তীরে যাইয়া যাত্রার রাজাদের মতো বক্তৃতা করিতাম। কলার ডাঁটার তরবারি বানাইয়া দুই রাজায় যুদ্ধ করিতাম। কখনও কখনও এই কৃত্রিম যুদ্ধ সত্যকার যুদ্ধে পরিণত হইত। তখন বড়রা আসিয়া আমাদিগকে নিরস্ত করিতেন।
চলবে…