১১:১৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

দীর্ঘ ৫৪ বছর পরে ১৯৭১

  • Sarakhon Report
  • ০৮:০৬:১৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৯ ডিসেম্বর ২০২৪
  • 18

স্বদেশ রায়

এ বছরই মে মাসের দিকে পশ্চিমবঙ্গে সেদিন আকাশটা বেশ মেঘলা ছিলো। সারাদিনের যে কাজ ছিলো তা সকাল দশটায় মিটে গেলে, হঠাৎ মনে পড়ে বন্ধু জসীমের কথা। একাত্তরের বন্ধু। সমবয়সী।শরনার্থী জীবনেও সেদিন বন্ধু জুটেছিলো। আর তা এমন বন্ধু যে ছাতা না থাকায় তাদের নিজেদের বাগান থেকে তালপাতা কেটে তারই ছায়ায় বৃষ্টির পানিতে আমাকে বাঁচিয়ে আমাদের ডেরায় পৌঁছে দিয়ে যেতো।

ওই দিন সকালের কাজগুলো দশটার ভেতর শেষ হয়ে যায়। রাতে মিডল ইস্ট এর রাজনীতি নিয়ে লেখালেখি করে এমন একজন তরুণ গবেষক সাংবাদিক ও আরো একজন গবেষকের দেখা করার কথা ছিলো। কিন্তু মেঘলা আকাশটা সব কিছু পালটে দিলো।ওদেরকে ফোন করে পরের দিন সময় দিয়ে- গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি ১৯৭১ এর শরনার্থী শিবিরের বেশ কয়েকটি স্থান এখন কেমন হয়েছে তাই দেখতে।

যেমন এখন কালে ভদ্রে কোলকাতায় গেলে সল্ট লেকে যেতে হয় সাংবাদিক মানস ঘোষ দাদা ও পার্থ চট্টোপধ্যায় দাদার সঙ্গে দেখা করার জন্যে। দুজনেই ১৯৭১ সালে আমাদের রনাঙ্গনের সংবাদ কভার করেছেন। মানস ঘোষ করেছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার দিন থেকে আর পার্থ চট্টোপধ্যায় এসেছিলেন ১৬ ডিসেম্বরের পরে। দুজনেই তাদের স্মৃতি নিয়ে বই লিখেছেন। মানস ঘোষ এর বইটি প্রথমে ইংরেজিতে বের হয়, পরে বাংলায়।

ওই সল্ট লেকে যাবার পথে মাঝে মাঝে মনে পড়ে একাত্তরে এখানে কেনেডি এসেছিলেন। এই সল্ট লেকের কাঁদা পার হয়ে বাস ধরে ৩ ডিসেম্বর কোলকাতায় ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণ শুনতে গিয়েছিলাম বাবার সঙ্গে।

লাল পেড়ে সাদা শাড়ীতে ইন্দিরা গান্ধীকে সেদিন কেমন যেন একটি শক্তিদাত্রী মায়ের মতো মনে হয়েছিলো। আবার রামকৃষ্ণ পরমহংসের সহধর্মীনি যাকেও সকলে “ মা সারদা”  দেবী বলেই জানেন তার মতোই ধীর স্থির মনে হয়েছিলো।

ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণ শুনতে শুনতেই বাবা স্বগোক্তি করেছিলেন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ আসন্ন। বাবা ফরোয়ার্ড ব্লক করতেন। সুভাষ বোস তার নেতা ছিলেন। তাই মনে হতো বাবা সবকিছু’র ভেতর যুদ্ধের গন্ধ পান- যুদ্ধ দিয়েই সমাধান চান।

বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ইন্দিরা গান্ধি তো তাঁর ভাষনে পাকিস্তান আক্রমন করার কথা কিছু বললেন না। তাহলে যুদ্ধ আসন্ন কেন? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, তাঁর ভাষনের গোটা সময়টা তিনি তার দেশবাসীকে একটি আসন্ন যুদ্ধের জন্যে চূড়ান্ত প্রস্তুত করলেন।তার ভাষনের সবটুকুই তো ছিলো যুদ্ধের সময় একটি জাতিকে কতটা কষ্ট করতে হয়।

আসলে ওই চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্যে ১৯৭১ এর এপ্রিল মাস থেকে জুলাই অবধি সত্য ঘটনার পাশাপাশি কত প্রোপাগান্ডাও দেখেছি। সেই বুকে মাইন বেধে রওশনারা নামক ছাত্রী ট্যাঙ্কের সামনে ঝাপ দেয়া থেকে শুরু করে – টিক্কা খানের মাথা কেটে মুক্তিযোদ্ধারা হাতে করে নিয়ে যাচ্ছে- তার ছবি অবধি। এখন মিডিয়ার একজন হয়ে বুঝি প্রোপাগান্ডা সব সময়ই যুদ্ধের প্রস্তুতির একটা অংশ। এ সব দেশই করে। বড় কোন যুদ্ধে যাবার আগে,  চূড়ান্ত যুদ্ধে যাবার আগে মিডিয়ার প্রোপাগান্ডা পার্ট অব ওয়ার। এর থেকে ধরেই নিতে হয় এই সফট পাওয়ারের পরে হার্ড পাওয়ার আসবে।

যাহোক সল্ট লেক এখন আর লবন হ্রদ নয়। তাই সেখানে গিয়েও যেমন খুঁজে পাইনা ১৯৭১ এর সেই শরনার্থী শিবিরের ছায়াগুলো- তেমনি মে মাসের ওই মেঘলা দিনে বের হয়ে বরাসাত, বারুইপুর, সরবেড়ে, বশিরহাট, টাকি এ সব জায়গাগুলোতে কোথাও খুঁজে পায়নি ১৯৭১ এর সেই শরণার্থী শিবিরের ছায়াগুলো। তবে খুঁজে পেয়েছিলাম অনেক পরিচিত মানুষ। যারা এখন অনেক বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। আর সেই দুর্দিনের বন্ধুদের বেশিভাগই- এখন রিটায়ার্ড লাইফ লীড করছে।

এক বন্ধুকে সরবেড়েতে খুঁজে পেলাম। সে মসজিদ থেকে বের হয়ে এসে যেন ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো আমাকে দেখে।জড়িয়ে ধরে বলে নাম না বললে কোন মতে তোকে চিনতে পারতাম না। ওদের জমি, একটি বাজার ও একটি স্কুল ঘর নিয়ে ওখানে বেশ কিছু শরনার্থী থাকতো। ছোট একটা শিবির ছিলো। জসীম দেখালো তাদের জমির পাশে সে একটা পাকা মসজিদ করেছে। ৭১ এ ওদের ছনের ঘর ছিলো -এখন দোতালা বিল্ডিং করেছে। ওর মেয়ে ও জামাই মিষ্টি সহ অনেক খাবার নিয়ে এলো। মিষ্টিগুলো সবই ওই কাছের বাজারটিরই ছিলো। ওই বাজারটি এখন বিল্ডিং ভরা হলেও ১৯৭১ এ ছিলো সবই ছনের ঘরের। দুটো মাত্র টিনের ঘর ছিলো। ওদের দেয়া মিষ্টি একটি মুখে দিতে গিয়ে মনে পড়লো- ১৯৭১ এ  এই বাজারে খালি গায়ে শরনার্থী শিশুরা ওই মিষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকতো। তাদের অনেকেরই কঙ্কালসার দেহ। তখন মনে হতে থাকে ওই শিশুদের কত মৃতদেহ এখানে নদী ও জলে মিশে আছে।

ওদের ওখান থেকে দ্রুত বের হয়ে যখন টাকির দিকে চলেছি তখন মনে পড়ে সেই ৭ ডিসেম্বরের কথা। আমরা কয়েকজন মিলে সেদিন এই বর্ডারে চলে এসেছিলাম। ভারতীয় শিখ সৈন্যদের একটি দল তখন সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। কি বুঝে হঠাৎই  জীপ থামিয়ে এক তরুণ অফিসার নামেন। আমাদের দেখে হাসি মুখে ইংরেজিতে বলেনে, তোমরা কবে দেশে ফিরে যাবে? বলেছিলাম, যাদের বাড়ি যশোর তাদের অনেকেই আগামী কাল যাচ্ছে। কারণ যশোর মুক্ত হয়ে গেছে। আর ভারতও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তরুণ অফিসার আমাদের দুই তিনজনকে এক সঙ্গে জড়িয়ে ধরেন। এবং এর পর কী মনে করে তার হাত থেকে স্টীলের বালাটি খুলে আমার হাতে পরিয়ে দিতে গিযে হেসে দেন। কারণ তখন শরীর ছিলো লিকলিকে এবং কিশোরী মেয়ের মতো সরু হাত। বালা সহজে হাত থেকে খসে পড়ে। আমার পাশে কুশল নামে একটা ছেলে ছিলো ও বেশ হৃষ্টপুষ্ট। তাই বালাটি ওর হাতে পরিয়ে দেই। বুঝতে পারি ওই বালা দেয়া ছিলো সেদিন ভারতীয়দের সঙ্গে বাংলাদেশের বাঙালির রাখি বন্ধন। লাল সুতো না থাকায় শিখ প্রথা অনুযায়ী যে শিখ বীররা সব সময় হাতে লোহার বালা পরে। কখনও খোলে না। সেই বালা খুলে রাখিবন্ধন করেছিলেন সেদিন তরুণ সেই অফিসার। কুশলের সঙ্গে শেষ দেখা হয় ১৯৭৩ সালে- তখনও তার হাতে সেই বালাটি ছিলো।

টাকির রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে একটু নদীর দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মনে হলো ১৯৭১ এর ৭ ডিসেম্বর রাতে আমরা গোল হয়ে বসে অল ইন্ডিয়া রেডিও শুনেছিলাম। প্রোগামটি ছিলো মিউজিকের সঙ্গে সঙ্গে লাইভ শোনানো ভারতীয় মিত্র বাহিনীর নেতৃত্বে কীভাবে যৌথ বাহিনী যশোর জয় করার পরে যশোর খুলনার রোড ধরে খুলনার দিকে, ঢাকার দিকে এগিয়ে চলছে। ট্যাঙ্কের চাকার শব্দ সহ অনেক কিছুই- আর তার সঙ্গে সঙ্গে ছিলো ধারাভাষ্য।

ততক্ষণে শুধু সীমান্তবর্তী জেলা যশোর নয় একের পর এক সীমান্তবর্তী জেলার পতন ঘটছে। তার খবরও বিবিসি, অলইন্ডিয়া রেডিও থেকে পাচ্ছি। এর বেশ পরে সাংবাদিকতায় এসে- সাবেক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সম্পাদক হিরম্ময় কারলেকার দাদার সঙ্গে পরিচয় হবার পরে জানতে পারি, সেনাবাহিনীর ওই ট্যাঙ্কের ওপর তিনি বসেছিলেন। তার অনেক ছবিও তিনি দেখান।  এবং প্রত্যক্ষ করেন কীভাবে একের পর এক যুদ্ধ করে সেদিন ভারত- বাংলাদেশে মৈত্রী বাহিনী এগিয়ে চলেছিলো। এই এগিয়ে চলার পথে বেশ কয়েকটি যুদ্ধও হয়।  সেই সব যুদ্ধে বড় বড় গোলার আঘাতে পড়ে যাওয়া গাছ গুলো ১৯৭২ এ ফিরে এসে দেখেছি। ১৯৭৬-৭৭ সালেও অনেক গাছের গায়ে গুলির দাগ ছিলো।

সারাদিন শুধু নয় রাত একটা অবধি ঘুরে তিনটার সময় কোলকাতায় ফিরি। আর ওই অন্ধকারে গাড়িতে বসে মনে হচ্ছিলো ১৯৭১ আগরতলার কথা। যে দেশের মোট জনসংখ্যার থেকে বাংলাদেশী শরণার্থীর সংখ্যা বেশি হয়ে গিয়েছিলো। আগরতলা গেলে এখন আর ভালো লাগে না। কারণ কেবলই মনে পড়ে সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্য’র কথা। নিজের বেড রুম অবধি তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের শরনার্থীদের জন্যে। বাংলাদেশ কেমন যেন তার আত্মার বিষয় হয়ে গিয়েছিলো। প্রায়ই অনিল দা ও বৌদি আসতেন ঢাকায়। ডা: জাফরুল্লাহ ভাই বা আমাদের আরেক বন্ধু মিতিদের উত্তরার বাড়িতে তিনি উঠতেন ৮০ ও নববই এর দশকে। দিনে একবার তার সঙ্গে আমাকে দেখা করতে হতো। শেষ মনে হয় এসেছিলেন ২০০১ এ। তখন একদিন গুলশানে একটি কিশোরের চালানো বেপোরায়া গাড়িতে এক্সিডেন্ট করে আমার হাতের ফ্রাকচার নিয়ে আমি বাসায় শুয়ে আছি। রিমি’র কাছে ও ডা. জাফরউল্লাহ ভাই এর কাছে এ খবর জানতে পারে তিনি তক্ষুনি বৌদিকে নিয়ে বাসায় চলে আসেন। বাস্তবে বাংলাদেশও বাংলাদেশের মানুষ যেন তার কাছে অন্য একটা বিষয় ছিলো।

বেশ রাতে যখন বারুইপুরে ১৯৭১ সালে যে জায়গাগুলোতে শরণার্থী ক্যাম্প হয়েছিলো তার একটা জায়গায় এসে গাড়ি থামালাম- তখন মনের ভেতর আর ১৯৭১ এর বারুইপুরের ক্যাম্প নেই। বরং মেঘালয় ও আসামের ক্যাম্পগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। আর বারুইপুরের রাস্তা থেকে একটু দূরের গাছগুলোকে তখন যেন মনে হচ্ছে মেঘালয় ও আসামের পাহাড়ের সেই গাছ গুলো -যে গাছগুলো ১৯৭১ সালে শুকুন ভরে গিয়েছিলো। কারণ এত শরণার্থীর মৃত্দেহ সেদিন কোথা থেকে যেন শকুনদের খবর দিয়ে নিয়ে এসেছিলো।

তারপরে আবার গাড়িতে বসে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে গেলো প্রায় বছর দশেক আগে শিলচরের একটি রাতে কথা। এক গবেষক ছোট বোন ও আমি অনেক রাত অবধি ঘুরেছিলাম শিলচরের ছোট্ট বাজারটিতে। ও কেবলই জানতে চাইছিলো আমার কাছে একাত্তরের সেই দিনগুলোর কথা। আর আমি আলো আধারিতে খুজছিলামা সেই সব মানুষগুলো যারা নিজেদের বাড়ি থেকে ভাত, ডাল, সবজি রান্না করে নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে থাকতো হায়নার হাত থেকে বেঁচে যারা সেখানে পৌঁছাচ্ছে- তিন চার দিন বা এক সপ্তাহ কোন কিছু না খেয়ে- তাদেরকে খাবার দেবার জন্যে।

আমার অনেক দেশী ও বিদেশী বন্ধু ও ছোট ভাই, বোনরা বলেছে, তারা আমাকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে এভাবে ১৯৭১ এর ওপর অনেকগুলো ডকুমেন্টারি করতে চায়। আসলে যা উপলিব্দর ও কষ্টের তাকে অনেক সময় মন থেকে বের করা যায় না। আবার যে আনন্দ মানুষকে আত্মহারা করে তাও অন্য কারো সঙ্গে শেয়ার করা যায় না। যেমন ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ এর আনন্দ। সেদিন বিশ্ববুকে নবজাতক রাষ্ট্রকে ভারতীয় পার্লামেন্টে স্বীকিৃতি দিলে সেই খবর রেডিওতে পেয়ে যে আনন্দ পেয়েছিলাম। তা ভাগ করার নয়, এমনকি উপলব্দি করার যোগ্যও নই।

আবার স্বাধীনতার ৫৪ বছরে এসে সেই স্বীকৃতি দেবার দিনটি, সেই মৈত্রী দিবস যখন ভারত নীরবে নিভৃতে বাংলাদেশ পালন করে- তখন যদি কোন দীর্ঘশ্বাস কেউ ফেলে, তাও প্রকাশের ভাষা না খোঁজাই ভালো। তারপরেও চিরসত্য শুধু নয়, সূর্যের মতো সত্য হলো- ইতিহাসের কোন প্রকৃত মাইলস্টোনকে কখনও মাটি চাপা দেয়া যায় না।

লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World.  

দীর্ঘ ৫৪ বছর পরে ১৯৭১

০৮:০৬:১৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ৯ ডিসেম্বর ২০২৪

স্বদেশ রায়

এ বছরই মে মাসের দিকে পশ্চিমবঙ্গে সেদিন আকাশটা বেশ মেঘলা ছিলো। সারাদিনের যে কাজ ছিলো তা সকাল দশটায় মিটে গেলে, হঠাৎ মনে পড়ে বন্ধু জসীমের কথা। একাত্তরের বন্ধু। সমবয়সী।শরনার্থী জীবনেও সেদিন বন্ধু জুটেছিলো। আর তা এমন বন্ধু যে ছাতা না থাকায় তাদের নিজেদের বাগান থেকে তালপাতা কেটে তারই ছায়ায় বৃষ্টির পানিতে আমাকে বাঁচিয়ে আমাদের ডেরায় পৌঁছে দিয়ে যেতো।

ওই দিন সকালের কাজগুলো দশটার ভেতর শেষ হয়ে যায়। রাতে মিডল ইস্ট এর রাজনীতি নিয়ে লেখালেখি করে এমন একজন তরুণ গবেষক সাংবাদিক ও আরো একজন গবেষকের দেখা করার কথা ছিলো। কিন্তু মেঘলা আকাশটা সব কিছু পালটে দিলো।ওদেরকে ফোন করে পরের দিন সময় দিয়ে- গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি ১৯৭১ এর শরনার্থী শিবিরের বেশ কয়েকটি স্থান এখন কেমন হয়েছে তাই দেখতে।

যেমন এখন কালে ভদ্রে কোলকাতায় গেলে সল্ট লেকে যেতে হয় সাংবাদিক মানস ঘোষ দাদা ও পার্থ চট্টোপধ্যায় দাদার সঙ্গে দেখা করার জন্যে। দুজনেই ১৯৭১ সালে আমাদের রনাঙ্গনের সংবাদ কভার করেছেন। মানস ঘোষ করেছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার দিন থেকে আর পার্থ চট্টোপধ্যায় এসেছিলেন ১৬ ডিসেম্বরের পরে। দুজনেই তাদের স্মৃতি নিয়ে বই লিখেছেন। মানস ঘোষ এর বইটি প্রথমে ইংরেজিতে বের হয়, পরে বাংলায়।

ওই সল্ট লেকে যাবার পথে মাঝে মাঝে মনে পড়ে একাত্তরে এখানে কেনেডি এসেছিলেন। এই সল্ট লেকের কাঁদা পার হয়ে বাস ধরে ৩ ডিসেম্বর কোলকাতায় ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণ শুনতে গিয়েছিলাম বাবার সঙ্গে।

লাল পেড়ে সাদা শাড়ীতে ইন্দিরা গান্ধীকে সেদিন কেমন যেন একটি শক্তিদাত্রী মায়ের মতো মনে হয়েছিলো। আবার রামকৃষ্ণ পরমহংসের সহধর্মীনি যাকেও সকলে “ মা সারদা”  দেবী বলেই জানেন তার মতোই ধীর স্থির মনে হয়েছিলো।

ইন্দিরা গান্ধীর ভাষণ শুনতে শুনতেই বাবা স্বগোক্তি করেছিলেন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ আসন্ন। বাবা ফরোয়ার্ড ব্লক করতেন। সুভাষ বোস তার নেতা ছিলেন। তাই মনে হতো বাবা সবকিছু’র ভেতর যুদ্ধের গন্ধ পান- যুদ্ধ দিয়েই সমাধান চান।

বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ইন্দিরা গান্ধি তো তাঁর ভাষনে পাকিস্তান আক্রমন করার কথা কিছু বললেন না। তাহলে যুদ্ধ আসন্ন কেন? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, তাঁর ভাষনের গোটা সময়টা তিনি তার দেশবাসীকে একটি আসন্ন যুদ্ধের জন্যে চূড়ান্ত প্রস্তুত করলেন।তার ভাষনের সবটুকুই তো ছিলো যুদ্ধের সময় একটি জাতিকে কতটা কষ্ট করতে হয়।

আসলে ওই চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্যে ১৯৭১ এর এপ্রিল মাস থেকে জুলাই অবধি সত্য ঘটনার পাশাপাশি কত প্রোপাগান্ডাও দেখেছি। সেই বুকে মাইন বেধে রওশনারা নামক ছাত্রী ট্যাঙ্কের সামনে ঝাপ দেয়া থেকে শুরু করে – টিক্কা খানের মাথা কেটে মুক্তিযোদ্ধারা হাতে করে নিয়ে যাচ্ছে- তার ছবি অবধি। এখন মিডিয়ার একজন হয়ে বুঝি প্রোপাগান্ডা সব সময়ই যুদ্ধের প্রস্তুতির একটা অংশ। এ সব দেশই করে। বড় কোন যুদ্ধে যাবার আগে,  চূড়ান্ত যুদ্ধে যাবার আগে মিডিয়ার প্রোপাগান্ডা পার্ট অব ওয়ার। এর থেকে ধরেই নিতে হয় এই সফট পাওয়ারের পরে হার্ড পাওয়ার আসবে।

যাহোক সল্ট লেক এখন আর লবন হ্রদ নয়। তাই সেখানে গিয়েও যেমন খুঁজে পাইনা ১৯৭১ এর সেই শরনার্থী শিবিরের ছায়াগুলো- তেমনি মে মাসের ওই মেঘলা দিনে বের হয়ে বরাসাত, বারুইপুর, সরবেড়ে, বশিরহাট, টাকি এ সব জায়গাগুলোতে কোথাও খুঁজে পায়নি ১৯৭১ এর সেই শরণার্থী শিবিরের ছায়াগুলো। তবে খুঁজে পেয়েছিলাম অনেক পরিচিত মানুষ। যারা এখন অনেক বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। আর সেই দুর্দিনের বন্ধুদের বেশিভাগই- এখন রিটায়ার্ড লাইফ লীড করছে।

এক বন্ধুকে সরবেড়েতে খুঁজে পেলাম। সে মসজিদ থেকে বের হয়ে এসে যেন ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো আমাকে দেখে।জড়িয়ে ধরে বলে নাম না বললে কোন মতে তোকে চিনতে পারতাম না। ওদের জমি, একটি বাজার ও একটি স্কুল ঘর নিয়ে ওখানে বেশ কিছু শরনার্থী থাকতো। ছোট একটা শিবির ছিলো। জসীম দেখালো তাদের জমির পাশে সে একটা পাকা মসজিদ করেছে। ৭১ এ ওদের ছনের ঘর ছিলো -এখন দোতালা বিল্ডিং করেছে। ওর মেয়ে ও জামাই মিষ্টি সহ অনেক খাবার নিয়ে এলো। মিষ্টিগুলো সবই ওই কাছের বাজারটিরই ছিলো। ওই বাজারটি এখন বিল্ডিং ভরা হলেও ১৯৭১ এ ছিলো সবই ছনের ঘরের। দুটো মাত্র টিনের ঘর ছিলো। ওদের দেয়া মিষ্টি একটি মুখে দিতে গিয়ে মনে পড়লো- ১৯৭১ এ  এই বাজারে খালি গায়ে শরনার্থী শিশুরা ওই মিষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকতো। তাদের অনেকেরই কঙ্কালসার দেহ। তখন মনে হতে থাকে ওই শিশুদের কত মৃতদেহ এখানে নদী ও জলে মিশে আছে।

ওদের ওখান থেকে দ্রুত বের হয়ে যখন টাকির দিকে চলেছি তখন মনে পড়ে সেই ৭ ডিসেম্বরের কথা। আমরা কয়েকজন মিলে সেদিন এই বর্ডারে চলে এসেছিলাম। ভারতীয় শিখ সৈন্যদের একটি দল তখন সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন। কি বুঝে হঠাৎই  জীপ থামিয়ে এক তরুণ অফিসার নামেন। আমাদের দেখে হাসি মুখে ইংরেজিতে বলেনে, তোমরা কবে দেশে ফিরে যাবে? বলেছিলাম, যাদের বাড়ি যশোর তাদের অনেকেই আগামী কাল যাচ্ছে। কারণ যশোর মুক্ত হয়ে গেছে। আর ভারতও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তরুণ অফিসার আমাদের দুই তিনজনকে এক সঙ্গে জড়িয়ে ধরেন। এবং এর পর কী মনে করে তার হাত থেকে স্টীলের বালাটি খুলে আমার হাতে পরিয়ে দিতে গিযে হেসে দেন। কারণ তখন শরীর ছিলো লিকলিকে এবং কিশোরী মেয়ের মতো সরু হাত। বালা সহজে হাত থেকে খসে পড়ে। আমার পাশে কুশল নামে একটা ছেলে ছিলো ও বেশ হৃষ্টপুষ্ট। তাই বালাটি ওর হাতে পরিয়ে দেই। বুঝতে পারি ওই বালা দেয়া ছিলো সেদিন ভারতীয়দের সঙ্গে বাংলাদেশের বাঙালির রাখি বন্ধন। লাল সুতো না থাকায় শিখ প্রথা অনুযায়ী যে শিখ বীররা সব সময় হাতে লোহার বালা পরে। কখনও খোলে না। সেই বালা খুলে রাখিবন্ধন করেছিলেন সেদিন তরুণ সেই অফিসার। কুশলের সঙ্গে শেষ দেখা হয় ১৯৭৩ সালে- তখনও তার হাতে সেই বালাটি ছিলো।

টাকির রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে একটু নদীর দিকে এগিয়ে যেতে যেতে মনে হলো ১৯৭১ এর ৭ ডিসেম্বর রাতে আমরা গোল হয়ে বসে অল ইন্ডিয়া রেডিও শুনেছিলাম। প্রোগামটি ছিলো মিউজিকের সঙ্গে সঙ্গে লাইভ শোনানো ভারতীয় মিত্র বাহিনীর নেতৃত্বে কীভাবে যৌথ বাহিনী যশোর জয় করার পরে যশোর খুলনার রোড ধরে খুলনার দিকে, ঢাকার দিকে এগিয়ে চলছে। ট্যাঙ্কের চাকার শব্দ সহ অনেক কিছুই- আর তার সঙ্গে সঙ্গে ছিলো ধারাভাষ্য।

ততক্ষণে শুধু সীমান্তবর্তী জেলা যশোর নয় একের পর এক সীমান্তবর্তী জেলার পতন ঘটছে। তার খবরও বিবিসি, অলইন্ডিয়া রেডিও থেকে পাচ্ছি। এর বেশ পরে সাংবাদিকতায় এসে- সাবেক ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস সম্পাদক হিরম্ময় কারলেকার দাদার সঙ্গে পরিচয় হবার পরে জানতে পারি, সেনাবাহিনীর ওই ট্যাঙ্কের ওপর তিনি বসেছিলেন। তার অনেক ছবিও তিনি দেখান।  এবং প্রত্যক্ষ করেন কীভাবে একের পর এক যুদ্ধ করে সেদিন ভারত- বাংলাদেশে মৈত্রী বাহিনী এগিয়ে চলেছিলো। এই এগিয়ে চলার পথে বেশ কয়েকটি যুদ্ধও হয়।  সেই সব যুদ্ধে বড় বড় গোলার আঘাতে পড়ে যাওয়া গাছ গুলো ১৯৭২ এ ফিরে এসে দেখেছি। ১৯৭৬-৭৭ সালেও অনেক গাছের গায়ে গুলির দাগ ছিলো।

সারাদিন শুধু নয় রাত একটা অবধি ঘুরে তিনটার সময় কোলকাতায় ফিরি। আর ওই অন্ধকারে গাড়িতে বসে মনে হচ্ছিলো ১৯৭১ আগরতলার কথা। যে দেশের মোট জনসংখ্যার থেকে বাংলাদেশী শরণার্থীর সংখ্যা বেশি হয়ে গিয়েছিলো। আগরতলা গেলে এখন আর ভালো লাগে না। কারণ কেবলই মনে পড়ে সাংবাদিক অনিল ভট্টাচার্য’র কথা। নিজের বেড রুম অবধি তিনি ছেড়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের শরনার্থীদের জন্যে। বাংলাদেশ কেমন যেন তার আত্মার বিষয় হয়ে গিয়েছিলো। প্রায়ই অনিল দা ও বৌদি আসতেন ঢাকায়। ডা: জাফরুল্লাহ ভাই বা আমাদের আরেক বন্ধু মিতিদের উত্তরার বাড়িতে তিনি উঠতেন ৮০ ও নববই এর দশকে। দিনে একবার তার সঙ্গে আমাকে দেখা করতে হতো। শেষ মনে হয় এসেছিলেন ২০০১ এ। তখন একদিন গুলশানে একটি কিশোরের চালানো বেপোরায়া গাড়িতে এক্সিডেন্ট করে আমার হাতের ফ্রাকচার নিয়ে আমি বাসায় শুয়ে আছি। রিমি’র কাছে ও ডা. জাফরউল্লাহ ভাই এর কাছে এ খবর জানতে পারে তিনি তক্ষুনি বৌদিকে নিয়ে বাসায় চলে আসেন। বাস্তবে বাংলাদেশও বাংলাদেশের মানুষ যেন তার কাছে অন্য একটা বিষয় ছিলো।

বেশ রাতে যখন বারুইপুরে ১৯৭১ সালে যে জায়গাগুলোতে শরণার্থী ক্যাম্প হয়েছিলো তার একটা জায়গায় এসে গাড়ি থামালাম- তখন মনের ভেতর আর ১৯৭১ এর বারুইপুরের ক্যাম্প নেই। বরং মেঘালয় ও আসামের ক্যাম্পগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। আর বারুইপুরের রাস্তা থেকে একটু দূরের গাছগুলোকে তখন যেন মনে হচ্ছে মেঘালয় ও আসামের পাহাড়ের সেই গাছ গুলো -যে গাছগুলো ১৯৭১ সালে শুকুন ভরে গিয়েছিলো। কারণ এত শরণার্থীর মৃত্দেহ সেদিন কোথা থেকে যেন শকুনদের খবর দিয়ে নিয়ে এসেছিলো।

তারপরে আবার গাড়িতে বসে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে গেলো প্রায় বছর দশেক আগে শিলচরের একটি রাতে কথা। এক গবেষক ছোট বোন ও আমি অনেক রাত অবধি ঘুরেছিলাম শিলচরের ছোট্ট বাজারটিতে। ও কেবলই জানতে চাইছিলো আমার কাছে একাত্তরের সেই দিনগুলোর কথা। আর আমি আলো আধারিতে খুজছিলামা সেই সব মানুষগুলো যারা নিজেদের বাড়ি থেকে ভাত, ডাল, সবজি রান্না করে নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে থাকতো হায়নার হাত থেকে বেঁচে যারা সেখানে পৌঁছাচ্ছে- তিন চার দিন বা এক সপ্তাহ কোন কিছু না খেয়ে- তাদেরকে খাবার দেবার জন্যে।

আমার অনেক দেশী ও বিদেশী বন্ধু ও ছোট ভাই, বোনরা বলেছে, তারা আমাকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে এভাবে ১৯৭১ এর ওপর অনেকগুলো ডকুমেন্টারি করতে চায়। আসলে যা উপলিব্দর ও কষ্টের তাকে অনেক সময় মন থেকে বের করা যায় না। আবার যে আনন্দ মানুষকে আত্মহারা করে তাও অন্য কারো সঙ্গে শেয়ার করা যায় না। যেমন ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ এর আনন্দ। সেদিন বিশ্ববুকে নবজাতক রাষ্ট্রকে ভারতীয় পার্লামেন্টে স্বীকিৃতি দিলে সেই খবর রেডিওতে পেয়ে যে আনন্দ পেয়েছিলাম। তা ভাগ করার নয়, এমনকি উপলব্দি করার যোগ্যও নই।

আবার স্বাধীনতার ৫৪ বছরে এসে সেই স্বীকৃতি দেবার দিনটি, সেই মৈত্রী দিবস যখন ভারত নীরবে নিভৃতে বাংলাদেশ পালন করে- তখন যদি কোন দীর্ঘশ্বাস কেউ ফেলে, তাও প্রকাশের ভাষা না খোঁজাই ভালো। তারপরেও চিরসত্য শুধু নয়, সূর্যের মতো সত্য হলো- ইতিহাসের কোন প্রকৃত মাইলস্টোনকে কখনও মাটি চাপা দেয়া যায় না।

লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World.