স্বদেশ রায়
কাল এক বন্ধু ফোনে মতামত জানতে চাইলো, “ বেগম রোকেয়াকে ধারণ করতে পারছি না কেন, সমস্যা কোথায়, তোমার কী মনে হয়” ?
এত বড় প্রশ্নের উত্তর দেয়া আমার মতো অতি সাধারণ সাংবাদিকের সম্ভব নয়। আবুজাফর শামসুদ্দিন এর মত যারা সমাজ বিজ্ঞানী ও সাংবাদিক একইসঙ্গে- তারা দিতে পারতেন।
তবে সাধারণ বোধে তাকে উত্তর দিলাম, আমার সব সময়ই মনে হয়, বাঙালির মনোজাগতিক চর্চার পাত্রটি খুবই ছোট। তাছাড়া বাঙালির কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন বাঙালি শঠতা পছন্দ করে, প্রতারণা পছন্দ করে, পরনিন্দা, পরচর্চা পছন্দ করে। তাই বাঙালি তার স্বভাবের বাইরে বৃহৎ আকারের কোন কিছু ধারণ করতে পারে না।
বাঙালি রামমোহন, বিদ্যাসাগর, লালন, রবীন্দ্রনাথ, চিত্ত রঞ্জন দাশ, বেগম রোকেয়া, সুভাস বোস, কাজী নজরুল ইসলাম, সৈয়দ মুজতবা আলী, কাজী আব্দুল ওদুদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদের কাউকে সত্য অর্থে ধারণ করতে পারেনি। বাঙালির বড় অংশ এদেরকে সঠিকভাবে জানে না। এমনকি এদের নিয়ে এমন কথাবার্তা অনেকে বলে যা অন্য কোন জাতি’র এ মাপের মানুষকে নিয়ে বললে সে দেশের বারবনিতায়ও সহ্য করে না। যার সুন্দর উদাহরণ পাই মান্টোর গল্পে, বৃটিশ বারবনিতাকে নিয়ে আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে তার কাস্টমার সব কিছু “ফাক” বলতে বলতে যখন বলে “ ফাক শেকসপিয়র” বারবনিতা তার কাস্টমারকে লাথি মেরে ফেলে দেয়। আর এর বদলে আমরা রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বেগম রোকেয়া সহ যে কোন বাঙালি আইকনকে নিয়ে আলোচনা বা চর্চার বদলে কুবাক্য বললে তা নিয়ে আমোদিত হই। এমনকি যারা বলে তাদের বুদ্ধিবৃত্তির তারিফ করে হাত তালি দেই। বাঙালি তার বড় কে ছোট করে সব সময় একটি বিকৃত আনন্দ ভোগ করে।যেমন কোলকাতাতে আমার এক পরিচিত জনের সঙ্গে বাংলা সিনেমা নিয়ে আলাপ করতে করতে সে বলে, বাংলা চলচ্চিত্রকে একটি গন্ডির মধ্যে আটকে দিয়ে গেছেন সত্যজিত রায়। সঙ্গে সঙ্গে প্রসঙ্গ পালটে গিয়েছিলাম। কারণ, সেও বাঙালি, সেও তার নিজের আইকনের মুর্তি ভাঙ্গতে পছণ্দ করবে। বাস্তবে একজন খর্বাকৃতি মানুষ কখনও দীর্ঘ মুর্তিকে সহ্য করতে পারে না। এর সঙ্গে একটি বিশেষ প্রাণীকে ও ল্যাম্প পোস্ট জড়িয়ে একটা উদাহরণ দেয়া যায়- কিন্তু এই বয়সে এগুলো বলা মানায় না। কারণ, এখন তো অন্তত এটুকু বুঝি প্রাণীর সমস্যাটা তার স্বভাবে আর যারা মানুষ তাদের জন্যে উপলব্দিতে, প্রজ্ঞায়।
বাস্তবে এসত্য উপলব্দির। বেগম রোকেয়া, কাজী নজরুল ইসলাম বা রবীন্দ্রনাথ কিন্তু শুধু মাত্র মানুষের সন্তান হিসেবে জম্ম নিয়েছিলেন বলেই এ মাপের মানুষ হননি। এঁরা সকলে নিজেকে সৃষ্টি করেছিলেন, চর্যা ও বোধের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। এদের প্রত্যেকের জীবন নিয়ে পড়াশোনা করলে সত্যিই বিস্মিত হতে হয়, একটি মানুষকে মানুষ হবার জন্যে কতটা কতটা বোধের চর্চা করতে হয়। আর তার জন্য তাকে কতটা নিলোর্ভ হতে হয়। এবং মানুষকে আলোর পথে নিয়ে যাবার জন্যে নিজের জীবনকে কত দিক থেকে বিলিয়ে দিতে হয়।
পৃথিবীর কোন জাতিই তার নারী সমাজকে পিছে রেখে এগুতে পারেনি। বেগম রোকেয়া যাকে বলেছেন, সমাজের দুটো চাকা- একটি নারী ও একটি পুরুষ। এক চাকাতে যেমন গাড়ি চলে না তেমনি সমাজও এক চাকাতে চলতে পারে না।
বাঙালি শুধু নয়, সারা পৃথিবীতে এখনও সত্যি অর্থে মানব সমাজের এই দুই চাকাকে সচল করা হয়নি। ফরাসি দার্শনিক ও নারী মুক্তি আন্দোলনের লেখক সিমন দ্য বোভেয়ারের ২৮ বছর আগে বেগম রোকেয়া একটি পশ্চাদপদ বাঙালি সমাজে জম্মেও সিমনের থেকেও আরো বেশি স্বচ্ছ চিন্তার ভেতর দিয়ে নারী মুক্তিকে তিনি দেখেছেন। আর তার প্রভাব যে এ সমাজে পড়েনি তা নয়। আমাদের জীবদশ্মায় আমরা যখন সওগাত সম্পাদক নাসিরুদ্দিন বা কবি বেগম সুফিয়া কামালের পায়ের নিচে বসার সুযোগ পেয়েছি- তখন বুঝতে পেরেছি, বেগম রোকেয়া কীভাবে একটি সমাজকে পরিবর্তন করেছিলেন। এমনকি বেগম রোকেয়ার নারী মুক্তি আন্দোলন কোন বিশেষ ধর্মের নারীর জন্যেও ছিলো না- ছিলো গোটা পৃথিবীর নারী মুক্তির জন্য। যে কারণে আজ ই্উরোপ তাকে গ্রহন করেছে। আমরাও ছোট বেলা থেকেই অধিকাংশ বাঙালি পরিবারের ব্যক্তিগত লাইব্রেরীতে শুধু তার বই দেখিনি- দেখেছি বাঙালি মণিষাদের সঙ্গে তাঁর ছবি টাঙানো বাড়িতে বাড়িতে। তাকে নিয়ে ধর্মীয় বিচারেও ভাগ করতে দেখেনি। যেমন ধর্মীয় বিচারে ভাগ করে না রবীন্দ্রনাথ, নজরুলকে।
তবে আজ যে বেগম রোকেয়াকে এভাবে অসম্মানিত করা হচ্ছে এটা কিন্তু এ মুহূর্তের কোন প্রতিক্রিয়া নয়। সমাজের এই পরিবর্তনটা বেশ আগেই শুরু হয়েছে। বছর পাঁচেক আগে এক বড় ভাইয়ের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে গিয়ে কেন যেন মনে হয় নারী শ্রমিকের সংখ্যা কম। তখন বেশ কয়েকজন নারী গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির মালিকের কাছে খোঁজ নিয়ে জানি- আগে গার্মেন্টসে যে বেশি সংখ্যক শ্রমিক নারী ছিলো তা এখন নেই। এখন পুরুষের সংখ্যা বেশি। দুই দিন আগে দেশের একটি প্রতিষ্ঠিত গবেষণা প্রতিষ্ঠানের রিপোর্টে দেখলাম, গার্মেন্টেসে আনুপাতিক হারে নারী শ্রমিক কমে গেছে। তার কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করেছে, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীগুলো আধুনিক মেশিন নির্ভর হওয়াতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা কমছে। কারণ, নারীদের থেকে পুরুষরা মেশিন নির্ভর কাজে ভালো।
তাদের এই রিপোর্টটি প্রকাশ হয়েছিলো রোকেয়ার জম্মদিন বা বেগম রোকেয়া দিবসের আগে। সেদিনই রিপোর্টের এই অংশটুকু পড়েই মনে হয়েছিলো এ সমাজ থেকে বেগম রোকেযার চিন্তা চেতনা মারা গেছে। কারণ, সম্ভবত এ বছর বা ২০২৩ এ হতে পারে- জাপানের একটি গবেষণা পত্রে পড়েছিলাম সুক্ষ্ম টেকনোলজিতে মেয়েরা পুরুষের থেকে ভালো করে। গতকাল নিউ ইয়র্ক টাইমসে একজন আর্মি অফিসারের অবসর নেবার পরে ঘড়ি তৈরির কারখানা ও ঘড়ির ফ্যাশন নিয়ে সাফল্যর ইতিহাস পড়ছিলাম। সেখানে লক্ষ্য করে দেখলাম, তার কারখানার যে ছবি দেয়া হয়েছে তার অধিকাংশ কর্মী নারী।
তাই যে তরুণরা বেগম রোকেয়াকে অপমান করেছে বা অস্বীকার করতে চাচ্ছে সমস্যাটা শুধু তাদের নয়, সমস্যাটা গোটা সমাজের। আসলে সমাজের মনোজগতের পাত্রটি ছোট হয়ে গেছে। যে কারণে গবেষকরা সহজেই মনে করছেন নারীর থেকে পুরুষরা প্রযুক্তিতে ভালো করছে বলে নারী শ্রমিক কমে গেছে। অর্থাত গবেষকরাও বন্দী হয়ে গেছেন মনোজাগতিকভাবে চিন্তার ক্ষুদ্রতার কাছে।
যেমন আনিসুজ্জামান স্যার থাকার পরে তাঁকে যখন বঙ্গবন্ধু’র জম্ম শতবার্ষিকী উদযাপন কমিটির প্রধান করা হলো না, তখন বেশ কয়েকজন ব্যক্তিগত আলাপে প্রশ্ন করে, আওয়ামী লীগ বা সরকার কেন আনিসুজ্জামান স্যারকে এ কমিটির প্রধান করলেন না? হেসে উত্তর দিয়েছিলাম, আওয়ামী লীগ ও সরকারের বুদ্ধিবৃত্তির পাত্রটি ছোট হয়ে গেছে- সেখানে আনিসুজ্জামান স্যার ধরছেন না।
বাস্তবে যে কোন ধরনের ক্ষমতা মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির পাত্র ছোট করে দেয়। এবং এটা যে এ সমাজে এই প্রথম ঘটছে তা নয়। ভারতীয় সমাজে পাঁচ থেকে সাত হাজার বছর আগে নারী ক্ষমতায়ন যেখানে ছিলো মনু পরবর্তীতে তা বদলে যায়। নারীকে নানা ভাবে বেধে ফেলা হয়। সেমেটিক সভ্যতায়ও তেমনি ঘটেছে একটি পর্যায়ে। ইউরোপীয় সভ্যতায়ও আড়াই হাজার বছর আগে যেখানে ছিলো তা এক হাজার বছর আগে ভিন্ন হয়ে যায়। তারা আবার সেটা পরিবর্তনের জন্যে এখনও সংগ্রাম করছে। চায়নিজ সভ্যতায়ও শুরুতে যা ছিলো মাঝখানে তার পাত্রটি অনেক সংকুচিত হয়ে যায়। নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে তারা এখন আবার এগিয়ে নেবার চেষ্টা করছে।
আর কখন এমনটি হয় তার একটি উপলব্দি হয়েছিলো, শাঁওলী মিত্রের নাথবতী অনাথবৎ দেখতে দেখতে। যখন রাজা যুধিষ্ঠির দ্রৌপদিকে পণ ধরেন এবং হেরে যান তার পরে- শাঁওলী মিত্রের সেই অসামান্য অভিনয় আর ডায়ালগ- “ বাবু মশায়রা এমন এক একটা কাল আসে পৃথিবীতে যখন গুনীজন সবাই নিশ্চুপ হয়ে থাকে। আর যে অত্যাচারিত সে অত্যাচারিত হয়েই যায়, হয়েই যায়, হয়েই যায়”।
আর সেই অত্যাচারিতের প্রতীক কে? তিনি নারী, যিনি খর্বাকৃতি নারী নন, সেই দ্রৌপদি। আর তাকে অত্যাচার করা হচ্ছে যে রাজার সামনে সে রাজা ধৃতরাষ্ট্র- অন্ধ, বৃদ্ধ ও রাজ্য লোভী। আর শক্তিমান নারীর প্রতীক দ্রৌপদিকে অসম্মান করছে যে তার নাম দুঃশাসন। অন্যদিকে নারীকে পণ ধরেছিলো পুরুষ তার পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিয়মের জোরে। সেদিনও দ্রৌপদি প্রশ্ন রেখেছিলেন, তাকে পণ ধরার অধিকার কে দিলো যুধিষ্ঠিরকে?
আর মহাকবি ব্যাসের কল্পনায় পৃথিবীর নির্যাতিতার প্রতীক দ্রৌপদি থেকে আজ গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিরবে কমে যাওয়ার বিপরীতে নারীকে আপন ভাগ্য জয়ী করার দূত হিসেবে পৃথিবীতে এসেছেন যারা বার বার- তাদেরই অন্যতম, তাদেরই শ্রেষ্টদের একজন বেগম রোকেয়া- তার সকল কাজে সেই সুরই ধ্বনিত হয়েছে- যা রবীন্দ্রনাথের কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছে অতি সহজে “ নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার/ কেন নাহি দিবে অধিকার/ হে বিধাতা? নত করি মাথা/ পথ প্রান্তে কেন রব জাগি প্রত্যাশার পূরণের লাগি / দৈবাগত দিনে?/ শুধু শূণ্যে চেয়ে রব? কেন নিজে নাহি লব চিনে/ সার্থকের পথ?
এই বীরত্বের বেশের নারীকে এ সমাজ ধারণ করতে চায়না বলেই কি আজ বেগম রোকেয়াকে ছেটে ফেলা হচ্ছে, তার ভাস্কর্য’র ওপর অশ্লীল কথা লেখা হচ্ছে? আর এটা কোন হঠ্যাত ঘটনা নয়- সমাজে শুরু হয়েছে বেশ আগে থেকেই। যেমন আগে থেকেই শুরু হয়েছে নীরবে গার্মেন্টস থেকে নারী শ্রমিক কমে যাওয়া। খোঁজ নিলে আরো অনেক সেক্টরে এমন মিলবে। তবুও আবার রবীন্দ্রনাথে ফিরে যেতে হয় – “ যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে. / …… তবুও বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর/ এখনি, অন্ধ, বন্ধ করো না পাখা ।
লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World.