শ্রী নিখিলনাথ রায়
আমাকে পুনর্ব্বার প্রশান্তচিত্তে ক্লেভারিং, মন্দন ও ফ্রান্সিসের কথা স্মরণ করিতে বলেন। তাহার পর তিনি পাল্কীতে ঠেস দিয়া জপ করিতে থাকেন। আমি তাঁহাকে বলিলাম যে, গোলমালে আমি তাঁহার কথা বুঝিতে পারিক না; অতএব সময় হইলে, তিনি যেন কোনরূপ ইঙ্গিত করেন। তিনি বলিলেন যে, আমি হস্তদ্বারাই সঙ্কেত করিব। পরে তাঁহার হস্ত বৃদ্ধ থাকার কথা বলিলে, তিনি পা নাড়িয়া সঙ্কেত করিতে স্বীকৃত হন।
সময় উপস্থিত হইলে, আমি বধমঞ্চের নিকট তাঁহার পাল্কী লইয়া যাইতে বলিলাম; তিনি নিষেধ করিয়া পদব্রজেই অগ্রসর হইলেন। মঞ্চের সোপানের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলে, তাঁহার হস্তদ্বয় ‘একখানি রুমাল দিয়া আবদ্ধ করা হইল। পরে তাঁহার মুখ আচ্ছাদন করার আবশ্যক হইলে, তিনি আমাদিগকে তাহা করিতে নিষেধ করিলেন। আমি একজন ব্রাহ্মণ সিপাহীকে আদেশ করিলে, মহারাজ তাঁহার একটি ভৃত্যকে আদেশ দিলেন। ভৃত্যটি তখন তাঁহার পদতলে লুণ্ঠিত হইয়া কাঁদিতেছিল। মহারাজ ঋজুভাবে দণ্ডায়মান হইয়া মঞ্চোপরি উঠিলেন।
আমি তাঁহার প্রশান্ত বদনে কোনরূপ ভাব-বিকৃতি দেখিলাম না। পরে আমি নিজে স্থির থাকিতে না পারিয়া, স্বীয় শিবিকামধ্যে পলায়ন করিলাম। শিবিকার বসিতে বসিতে মঞ্চাপসারণের শব্দ শুনিলাম। কিছুক্ষণ পরে শান্ত হইলে, দেখিলাম, মহারাজের হস্তদ্বয় যেরূপভাবে প্রথমে বদ্ধ ছিল, সেই রূপ ভাবেই অবস্থিত আছে এবং তাঁহার বদনমণ্ডলে কোনরূপ বিকৃতির চিহ্ন নাই। ফলতঃ এই শোচনীয় ব্যাপারে মহারাজ নন্দকুমার যেরূপ শান্তভাক ও দৃঢ়তা দেখাইয়াছিলেন, এরূপ স্থিরচিত্ততার উদাহরণ আমি কখনও শুনি নাই বা পাঠ কাঁর নাই।
অবশেষে সেই ব্রাহ্মণত্রয় তাঁহার মৃত দেহ ভস্মীভূত করিবার জন্য বহন করিয়া লইয়া যায়।” এই হৃদয়-বিদারক দৃশ্যে সমস্ত দর্শকমণ্ডলীর মধ্য হইতে এক মর্ম্মস্পর্শী কাতরধ্বনি উঠিয়া আকাশ বিদীর্ণ করিবার উপক্রম করিল। অনেকে সেই দৃশ্য দেখিতে অসক্ত হইয়া পলায়ন করিল; কেহ কেহ বসন দ্বারা বদন আচ্ছাদন করিয়া ফেলিল এবং কেহ কেহ এই পাপদৃশ্য দেখিবার জন্য প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ পবিত্র-সলিলা ভাগীরথীজলে পতিত হইল।।