শশাঙ্ক মণ্ডল
সাহিত্য
পঞ্চম অধ্যায়
১৯১৬ খ্রীষ্টাব্দের জেলা গেজেটিয়ারগুলিতে লক্ষ করা যাচ্ছে হাড়োয়া থানার লোকসংখ্যা প্রতি বর্গমাইলে ১২৬৭ জন, বসিরহাট থানায় ১০১৫ জন, বাদুড়িয়ায় ৯০৪ জন। সমগ্র বসিরহাট থানায় লোকসংখ্যা ৪১৭০৯-মাধ্যমিক স্তরের ছাত্রসংখ্যা ৪১২, বাদুড়িয়া থানার লোকসংখ্যা ৩৮৯১৭-মাধ্যমিক স্তরের ছাত্র ৫১২ জন, যশোর এর নড়াইল থানার লোকসংখ্যা ১৭০৮৯ মাধ্যমিক স্তরের ছাত্রসংখ্যা ৩০২ জন। এক সামান্য অংশের ছাত্রই সে দিন মাধ্যমিক শিক্ষার সুযোগ পেত। যে সব কৃষকের উদ্বৃত্ত সম্পদ ছিল না তারা এ সুযোগ কোনমতেই পেত না।
এমনকি কৃষকদের মধ্যে যাদের উদ্বৃত্ত সম্পদ থাকত ধনী চাষির পর্যায়ে ফেলা যেত তাদেরও মাধ্যমিক শিক্ষগ্রহণের আর্থিক সঙ্গতি সে যুগে ছিল না (১০) ১৯১৬ খ্রীষ্টাব্দে টাকী সরকারি বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণীর একজন ছাত্রকে সেদিন তা Ist class নামে পরিচিত ছিল বিদ্যালয়ের বেতন বাবদ বৎসরে ৫০ টাকা খরচ করতে হত এবং সেই সময়ে একমণ চালের দাম ছিল ৫ টাকা এবং চারজন মজুরের একদিনের বেতন ছিল ১ টাকা। সেদিন দশম শ্রেণীর একজন ছাত্রের অভিভাবককে স্কুলের বেতন বাবদ দিত হত ১০ মণ চালের দাম।
এর সঙ্গে পুস্তকাদির ব্যয় অবশ্যই ছিল। সেদিন শিক্ষা ছিল এক বিশাল ব্যয়বহুল ব্যবস্থা (১১) ব্রিটিশ রাজত্বে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় যে শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল তাতে লক্ষ করা যাচ্ছে মুসলমানদের শিক্ষার হার হিন্দুদের তুলনায় খুবই নীচে। বিভিন্ন সরকারি বদ্যালয়ে মুসলমান ছাত্রদের জন্য সংরক্ষিত আসন কখনই পূর্ণ হত না। মুসলমান প্রধান গ্রামগুলিতে কোন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল না বললেই চলে, যা দু-একটি গড়ে উঠেছিল তা ১৯৩০ এর পরে। পাশ্চাত্ত শিক্ষার প্রতি মুসলমানদের অনীহার কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, মুসলমান সমাজের এক বিপুল অংশ কৃষির সঙ্গে যুক্ত ছিল এবং দরিদ্র কৃষকদের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি।
এসব মানুষদের উদ্বৃত্ত সম্পদ এলতে কিছুই ছিল না এরা অনেকে পরবর্তীকালে ভূমিহীন ক্ষেতমজুরে পরিণত হয়েছিল। ব্রিটিশ যুগের বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত রিপোর্টগুলিতে বিশেষকরে যশোর খুলনা, বাখরগঞ্জে হিন্দুদের তুলনায় মুসলমানদের মৃত্যুর হার বেশি হবার কারণ খুঁজতে গয়ে দারিদ্রকে চিহ্নিত করা হয়েছে। (১২) ১৯১১ এর সেন্সসে বাখরগঞ্জের গড় শিক্ষিতের হার ৮.৩ শতাংশ। হিন্দুদের গড় ১৬%, মুসলমান গড় ৫%, হিন্দু মহিলা ৩% সেক্ষেত্রে মুসলমান মহিলাদের শিক্ষার হার ২৭%। এই দরিদ্র মানুষরা শিক্ষার কথা ভাবতে পারত না।
শিশুরা শৈশবে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকে সংসারের কাজে অথবা অপরের বাড়িতে মাহিন্দার হিসাবে নিয়োজিত করা হত। নারীশিক্ষার ক্ষেত্রে শোচনীয় অবস্থা লক্ষ করা যাচ্ছে। ১৮৯১ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে সমগ্র সুন্দরবন এলাকার বর্তমানের প্রায় ৫টি জেলায় মাত্র ৭টি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার মধ্যে ১টি হাইস্কুল বাকিগুলি সবই এম.ই. স্কুল। ১৯৪৬ খ্রীষ্টাব্দে ২৪ পরগণা জেলা উত্তর দক্ষিণ মিলিয়ে ১৭টি বালিকা বিদ্যালয়ে ছাত্রীরা অধ্যয়ন করছে। স্বাধীনতার প্রাক্ মুহূর্তে খুলনা জেলার নারীশিক্ষার হার ৮.৩৫ শতাংশ আর বসিরহাট মহকুমার ক্ষেত্রে তা ৯.৮৭ শতাংশ লক্ষ করা যাচ্ছ।