স্বদেশ রায়
কৈশোরে দাদা ঠাকুরের কাছে পড়তে বা তার কথা শোনার একটা আলাদা আকর্ষন ছিলো। মিশন বোর্ডিং থেকে শীতে বাড়ি এলেই সেই ছোলবেলার মতো সকাল বিকাল তার কাছে গিয়েই বসতাম।
সব কথা তিনি বই পড়ে তার থেকে উপলব্দ জ্ঞানে বলতেন তা নয়, বই ও নিজের জীবনের সকল উপলব্দি থেকে সেগুলো বলতেন।
যেমন এখন কোন অমানিশার রাতে আকাশের দিকে তাকালে মনে পড়ে দাদা ঠাকুরের কথা। তিনি বলতেন “ দেখ আকাশে লক্ষ তাঁরা থাকলেও পৃথিবী অন্ধকার থাকে। লক্ষ তারা দিয়েও পৃথিবীকে আলোকিত করা যায় না। কিন্তু এক চন্দ্র ( চাঁদ) পৃথিবীকে আলোকিত করে”।
খুব ছোট বেলাতে মার্কস পড়ার সুযোগ হয়। মন কিছুটা কৈশোরে সেদিকে ঝুঁকেও গিয়েছিলো। কিন্তু তারপরেও শ্রমিক রাজ তত্ত্ব টানেনি। মনে হতো, বাস্তবতা তো লক্ষ তারা আকাশকে আলোকিত করতে পারে না। আকাশ আলোকিত করার জন্যে একটি চন্দ্রের দরকার হয়। যেমন শ্রমিকদের বিপ্লব করার জন্যে লেনিনের মতো একজন মধ্যবিত্ত বীর দরকার হয়েছিলো, জাতীয়তাবাদী ভারতীয়দের সুভাষ বোসের মতো একজন বীর দরকার হয়েছিলো। ঠিক তেমনি বাঙালির আন্দোলনে দেখলাম আকাশ আলোকিত করার জন্যে শেখ মুজিবের মতো একজন দীর্ঘদেহী মানুষের দরকার হলো। তাই মার্কস ছেড়ে দাদা ঠাকুরেই বিশ্বাসটা, বোধটা আটকে গেলো জীবনে।
এখনও মনে পড়ে এমনি এক শীতে দাদা ঠাকুর কাশ্মীরী র্যাপারে শরীর ডেকে বড় গলাবদ্ধ ও মাথা জোড়া মোটা উলে বোনা টুপি পরে টেবিল আলোটি জ্বালিয়ে পুরু লেন্স নিয়ে বইয়ে ডুবেছিলেন। দাদা ঠাকুরের বইগুলো, কথাগুলো আমার কাছে সে সময় বড় শান্ত মনে হতো। সেখানে যেন কোন সমুদ্রের ঝড়ের খোঁজ পেতাম না। বরং মনে হতো আমাদেরই বড় দীঘিটা- যেখানে শান্ত জল আর রাজহাঁস নিরিবিলি থাকে সারাদিন। দাদা ঠাকুর অবশ্য নিরিবিলি বলতেন না- বলতেন, প্রশান্ত। জীবনে এখন এসে বুঝি দাদাঠাকুর প্রশান্তিতে পৌঁছাতে পেরেছিলেন, তাই তিনি বলতে পারতেন প্রশান্ত। দাদা ঠাকুরের এই নিরিবিলি বইয়ের বিপরীতে আমার তখন ভালো লাগে যাবতীয় যুদ্ধের ইতিহাস। আর ওই শীতের রাতে দাদা ঠাকুরের ঘরে গিয়ে তাকে যেই বলেছি, দাদা ঠাকুর পৃথিবীর সব থেকে ভয়ংকর যুদ্ধ কোনটা বলতো? সেই যুদ্ধের ইতিহাস আমি পড়তে চাই। দাদাঠাকুর হাত ধরে টেনে তার পাশে বসিয়ে, মাথায় হাত রেখে বললেন, “ যাকে যুদ্ধ বলে তা পৃথিবীতে কখনই ভয়ংকর নয়। যুদ্ধ বীরেরা করে নতুন কিছু সৃষ্টির জন্যে। পৃথিবীতে সব থেকে ভয়ংকর কী জানো” ?
বলি, জানি না দাদাঠাকুর।
তিনি বললেন, তুমি তো সেগুলো পড়েছো, তা বুঝতে পারোনি।
বলি, না দাদাঠাকুর।
তিনি বললেন, তুমি রাজা যযাতির কাহিনী পড়েছো না?
মাথা নেড়ে বলি, পড়েছি।
বললেন, তুমি বালখিল্য মুনিদের কাহিনী পড়েছো না?
আবারও মাথা নেড়ে একই উত্তর দেই, পড়েছি।
তিনি এবার আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, রাজা যযাতির কাহিনীর মূল কি?
তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলি, রাজা যযাতি তার আরোধ্য দেবতার কাছে বর চেয়েছিলেন, যেন তিনি তার যৌবন ফিরে পান। দেবতা তাকে বর দিয়েছিলো, তার সন্তানদের কেউ যদি তার বার্ধক্য বা জরা নিয়ে তাকে যৌবন দান করে- তাহলে তিনি সেটা পাবেন। যযাতি নিজ পুত্রের কাছ থেকে সেই যৌবন নিয়েছিলেন।
এবার দাদা ঠাকুর আরেকটু ঠেস দিয়ে বসে বলেন, বার্ধক্য কি?
বোকার মত উত্তর দেই- বার্ধক্য অর্থাৎ জীবনের শেষ পর্যায়ে চলে যাওয়া।
দাদা ঠাকুর বলেন, জীবনের শেষ পর্যায় বলে কিছু নেই। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত অবধি সৃষ্টিশীল থাকার জন্যে মানুষের জম্ম। তবে মানুষের কাজের ও মনোজগতের পরিবর্তনের জন্যে বা প্রকৃত মানুষ হবার জন্য মানুষের জীবনকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। কর্ম জীবনের মধ্যে প্রথমে গুরুগৃহ, তার পরে কর্ম বা গৃহীজীবন তার পরে বানপ্রস্থ আর এরপরে বার্ধক্য বা সন্ন্যাস।
এটুকু বলে দাদাঠাকুর বললেন, গুরুগৃহ ও সন্ন্যাস বলছি বলে ভুল বুঝো না।
গুরুগৃহ অর্থাৎ বিদ্যাশিক্ষার শুরু কাল। পৃথিবীর সকল বিদ্যাই গুরুমুখী। অর্থাৎ জীবনের পথে পথে তোমাকে শিখতে হবে। তবে জীবনের প্রথম ওই সময়টুকু তোমাকে বিদ্যা ধারণ করার পাত্রটুকু নিজের ভেতর তৈরি করার জন্যে পিতা, মাতা, ভাই বোন থেকে শিক্ষকের কাছ থেকে তোমাকে শিখতে হবে। তারপরে তোমার কর্ম জীবন। যেটাই তোমার শিক্ষার মূল জীবন শুরু।
সেই শিক্ষাই তোমার গৃহজীবন বা সংসার জীবন। তাই সে তোমার রাজকার্য হোক, বনিকের কার্য হোক আর গৃহকাজ হোক। এটাই তোমার প্রথম ধাপের কর্ম জীবন।
দাদাঠাকুর আবারও একটু দম নিয়ে বলেন, কর্মজীবন মানুষকে অনেক অভিজ্ঞতা দেয়। কেউ কেউ এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আরো কাজ করতে চায়। আর যারা সদাচারী তারা তখন কাজ থেকে নিজেকে অনেকখানি গুটিয়ে নিয়ে, জীবনের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতাকে দ্রবীভূত করে বা তাকে মন্থন করে উপলব্দ বা জ্ঞানসৃষ্টির কাজে নিজেকে নিয়োগ করে। তাই বানপ্রস্থর জন্য একাকীত্বর প্রয়োজন পড়ে না। শুধু নিজের ভেতর নির্মোহতার শুরুটা করতে হয়। আর এর পরে আসে বার্ধক্য। বার্ধক্য বা সন্ন্যাস।এই সন্ন্যাস অর্থও গৃহত্যাগ নয়। সন্ন্যাস অর্থ গৃহত্যাগী নয়। সন্ন্যাস বা বার্ধক্য অর্থাত সকল লোভ লালসা থেকে নিজেকে উর্ধে তুলে এনে জ্ঞানের সঙ্গে ভালোবাসার মিশ্রন ঘটানো। কারণ, জ্ঞানেরও একটি অংহকার থাকে, জ্ঞানের মাধ্যমে কৌশল প্রয়োগ করার একটা কূট লোভ থাকে। এগুলো মূলত কাম ক্রোধের মতই লালসা। রাজা যযাতি হচ্ছে সেই লালসার প্রকৃতি কেমন হয় তার একটি উদাহরণ। অর্থাত বার্ধক্যের লালসা কতটা ভয়ংকর হতে পারে তার প্রকাশ। রাজা যযাতিকে দেবতা যে বর দিয়েছিলো তার ভেতরও একটি পরীক্ষা ছিলো। তাকে বলা হয়েছিলো, সে কেবল তার সন্তানের যৌবন নিতে পারবে।
এবার দাদাঠাকুর মাথায় তার বৃহত হাতের তালুটি রেখে বলেন, পিতার কাছে সন্তান কে?
দাদা ঠাকুরের মুখের দিকে তাকাই।
তিনি উত্তর দেন- পৃথিবীর সব থেকে প্রিয়তম হলো পিতা মাতার কাছে তার সন্তান। তাই দেবতারাও দেখতে চেয়েছিলো, বার্ধক্যে লালসা জাগলে সে বৃদ্ধ কী করে? সে কি পৃথিবীতে তার সব থেকে প্রিয়তমকে ছাড় দেয়?রাজা যযাতি দেয়নি। সে তার পুত্রের কাছ থেকেই পুত্রের যৌবন নিয়েছিলো এবং নিজের বার্ধক্য বা জরা তাকে দিয়েছিলো। এই প্রতীকি উদাহরণ দিয়ে মহাকবি বোঝালেন, বৃদ্ধ যদি লালসাগ্রস্থ হয়- তার কাছে কোন কিছুই নিরাপদ নয়।
এটুকু বলে শীতের রাতে একটু ওম নেবার জন্যে দাদা ঠাকুর তার র্যাপারটি আরো একটু জড়িয়ে নেন শরীরে। তারপরে জিজ্ঞেস করেন আর বালখিল্য মুনী কারা? তাছাড়া মুনী অর্থ তো জ্ঞানী- তারপরেও তাদের বালখিল্য বা শিশু সুলভ জ্ঞানী বলা হলো কেন?
মাথা নীচু করে বলেছিলাম, আমি তো শুধু বালখিল্যদের জম্ম ইতিহাস জানি। আপনি যদি একটু বুঝিয়ে বলেন।
দাদা ঠাকুর বলেন, প্রতীকি হিসেবে বলা হয়েছে- মায়ের পেট থেকেই শিক্ষা লাভ করে তারা অকালে পেট থেকে বের হয়ে এসেছিলো বলে ওরা খর্বাকৃতি বা খাটো ও উগ্র। এবং জ্ঞান নিয়ে তারা বালকের মতো আচরণ করে।
এখানে প্রকৃত অর্থে তারা শরীরের উচ্চতায় কম বা খাটো এটা বলা হয়নি। এখানে প্রকৃত অর্থে বোঝানো হয়েছে, এরা পৃথিবীর সেই সব মানুষেরা যাদের পৃথিবীর জ্ঞানের মহাসাগর সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। সামান্য একটি নালা বা পুকুরকে জেনে্ মনে করে তারা জ্ঞানী হয়ে গেছে। এবং সেই জ্ঞান তাদেরকে উগ্র করে তোলে। আর তা প্রয়োগের জন্যে এরা সংঘবদ্ধভাবে নানান জনের ওপর বা সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর তা প্রয়োগে জোর করতে চায়। এমনকি এদের সেই জ্ঞানের নামের অজ্ঞতার অত্যাচার থেকে, সহস্র বছর ধরে যারা জ্ঞান অর্জন করছেন- সেই জাবালী, বশিষ্ট, বিশ্বামিত্র মুনীরাও আক্রান্ত হন।
অর্থাৎ বৃদ্ধের লালসা যেমন রাষ্ট্র, সমাজও মানুষের জীবন থেকে ভালোবাসা ও ভালো কাজ নষ্ট করার একটি ভয়ংকর শক্তি তেমনি বালখিল্যরাও মূলত রাষ্ট্র, সমাজ ও মানুষের জীবন থেকে জ্ঞানকে ধ্বংস করার একটি সংঘবদ্ধ মূর্খ দল। আর তারা এতই মুর্খ যে নিজেরা মূর্খ সেটা না বুঝে উল্টো নিজেদের জ্ঞানী মনে করে।
তাই পৃথিবীতে সব থেকে ভয়ংকর হলো বৃদ্ধের লালসা আর বালখিল্যরা।
লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World.