০৯:২০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

ব্রিটিশ রাজত্বে সুন্দরবন (পর্ব-১৩০)

  • Sarakhon Report
  • ১২:০০:০৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ১২ জানুয়ারী ২০২৫
  • 19

শশাঙ্ক মণ্ডল

গাজন চড়ক দেল উৎসব

বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে শিবের এই উৎসব নানা নামে পরিচিত; উত্তরে গম্ভীরা রাঢ়ভূমিতে তা গাজন আবার দক্ষিণবাংলার বিস্তীর্ণ এলাকাতে তা চড়ক আর সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশে চড়ক নীল পূজা বা দেল উৎসব নামে পরিচিত। চৈত্র সংক্রান্তির এই উৎসবকে কেন্দ্র করে সমাজের তলাকার মানুষরা এক মহোৎসবে মেতে ওঠে। ব্রিটিশ রাজত্বে সুন্দরবনের সব চাইতে বড় উৎসব হিসাবে চড়ক চিহ্নিত ছিল; এতবেশি মানুষের অংশ গ্রহণ অন্য কোন অনুষ্ঠানে সম্ভব ছিল না।

সে যুগে অর্থনৈতিক কারণটাই বড় হয়ে দেখা দিত। আজকের মতো সে যুগে দুর্গা পূজা আদৌ হত না সাধারণতঃ অবস্থাপন্ন বাড়ীতে সীমাবদ্ধভাবে দুর্গা পূজা হত আর আজকের বারোয়ারি পূজার বাহুল্য সে যুগে আদৌ ছিল না। বর্ণ হিন্দু প্রধান এলাকাতে চড়কের তেমন প্রচলন সেদিন ছিল না আজও নেই। চড়কের সন্ন্যাসীদের মধ্যে ব্রাহ্মণ বা বর্ণ হিন্দুদের উপস্থিতি খুব একটা লক্ষ করা যায় না। অন্তজ মানুষগুলি এই উৎসবে মেতে উঠে। সুন্দরবনের কৃষিজীবী মানুষদের মধ্যে যেহেতু এসব মানুষদের সংখ্যাধিক্য সেজন্য চড়ক উৎসব এখানে জাতীয় উৎসবের মর্যাদা পেত।

প্রায় প্রতি গ্রামে চড়কের সন্ন্যাসীদের তীব্র গর্জন, চৈত্র মাসের শেষে শোনা যেত। ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে চড়কের বিভিন্ন অনুষ্ঠান সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা জারি করা সত্ত্বেও সেই প্রাচীন অনুষ্ঠানের অনেক রীতি নীতি বান ফোড়, বটি ঝাপ, কাঁটা ঝাপ প্রভৃতি এখনও সন্ন্যাসীরা করে আসছে।

সুপ্রাচীন কাল থেকে বাঙালীর ঘরে ঘরে শিব পূজার প্রচলন; প্রতিটি গ্রামে শিব মন্দির অথবা শিবের ‘থান’ লক্ষ করা যাবে। চড়কের উৎসবের মধ্য দিয়ে পৌরাণিক শিবের স্থলে সন্ন্যাসীরা লোকায়ত শিবের পূজা করে। এ শিব বাঙালির কৃষিজীবী সমাজের আপন-জন তার দুঃখ বেদনা সাংসারিক কান্না হাসির সাথে এই শিব মিলে মিশে একাকার; দেবত্ব খসিয়ে এখানে মাটির মানুষের সাথে একাকার করে ফেলেছে।

চড়কের অনেক অনুষ্ঠান অনার্য ধ্যান ধারণার সমগোত্রীয় হলেও এর মধ্যে লৌকিক ও পৌরাণিক শিবের মিশ্রণ ঘটেছে- হাজরাতলার অনুষ্ঠানগুলি এখনও পরিপূর্ণভাবে এই স্মৃতি বহন করে চলেছে। চড়কে মূল সন্ন্যাসী নির্বাচনের ক্ষেত্রে অন্যান্য সন্ন্যাসীদের ভূমিকা থাকে। মূল সন্ন্যাসী কোথাও বংশনুক্রমিক আবার কোথাও বা বিগত বছরের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে অন্যান্য সন্ন্যাসীদের মতামতের মধ্য দিয়ে নির্বাচন করা হয়। চড়কের অনুষ্ঠানগুলি কয়েকটি পর্বে বিভক্ত সন্ন্যাসী নির্বাচন, হবিষন্ন গ্রহণ, ঘট স্থাপন, নীলপুজা, মূল চড়ক অনুষ্ঠান ফুল চাপান, পাটাস ভাঙা ইত্যাদি।

 

 

ব্রিটিশ রাজত্বে সুন্দরবন (পর্ব-১৩০)

১২:০০:০৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ১২ জানুয়ারী ২০২৫

শশাঙ্ক মণ্ডল

গাজন চড়ক দেল উৎসব

বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে শিবের এই উৎসব নানা নামে পরিচিত; উত্তরে গম্ভীরা রাঢ়ভূমিতে তা গাজন আবার দক্ষিণবাংলার বিস্তীর্ণ এলাকাতে তা চড়ক আর সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশে চড়ক নীল পূজা বা দেল উৎসব নামে পরিচিত। চৈত্র সংক্রান্তির এই উৎসবকে কেন্দ্র করে সমাজের তলাকার মানুষরা এক মহোৎসবে মেতে ওঠে। ব্রিটিশ রাজত্বে সুন্দরবনের সব চাইতে বড় উৎসব হিসাবে চড়ক চিহ্নিত ছিল; এতবেশি মানুষের অংশ গ্রহণ অন্য কোন অনুষ্ঠানে সম্ভব ছিল না।

সে যুগে অর্থনৈতিক কারণটাই বড় হয়ে দেখা দিত। আজকের মতো সে যুগে দুর্গা পূজা আদৌ হত না সাধারণতঃ অবস্থাপন্ন বাড়ীতে সীমাবদ্ধভাবে দুর্গা পূজা হত আর আজকের বারোয়ারি পূজার বাহুল্য সে যুগে আদৌ ছিল না। বর্ণ হিন্দু প্রধান এলাকাতে চড়কের তেমন প্রচলন সেদিন ছিল না আজও নেই। চড়কের সন্ন্যাসীদের মধ্যে ব্রাহ্মণ বা বর্ণ হিন্দুদের উপস্থিতি খুব একটা লক্ষ করা যায় না। অন্তজ মানুষগুলি এই উৎসবে মেতে উঠে। সুন্দরবনের কৃষিজীবী মানুষদের মধ্যে যেহেতু এসব মানুষদের সংখ্যাধিক্য সেজন্য চড়ক উৎসব এখানে জাতীয় উৎসবের মর্যাদা পেত।

প্রায় প্রতি গ্রামে চড়কের সন্ন্যাসীদের তীব্র গর্জন, চৈত্র মাসের শেষে শোনা যেত। ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে চড়কের বিভিন্ন অনুষ্ঠান সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা জারি করা সত্ত্বেও সেই প্রাচীন অনুষ্ঠানের অনেক রীতি নীতি বান ফোড়, বটি ঝাপ, কাঁটা ঝাপ প্রভৃতি এখনও সন্ন্যাসীরা করে আসছে।

সুপ্রাচীন কাল থেকে বাঙালীর ঘরে ঘরে শিব পূজার প্রচলন; প্রতিটি গ্রামে শিব মন্দির অথবা শিবের ‘থান’ লক্ষ করা যাবে। চড়কের উৎসবের মধ্য দিয়ে পৌরাণিক শিবের স্থলে সন্ন্যাসীরা লোকায়ত শিবের পূজা করে। এ শিব বাঙালির কৃষিজীবী সমাজের আপন-জন তার দুঃখ বেদনা সাংসারিক কান্না হাসির সাথে এই শিব মিলে মিশে একাকার; দেবত্ব খসিয়ে এখানে মাটির মানুষের সাথে একাকার করে ফেলেছে।

চড়কের অনেক অনুষ্ঠান অনার্য ধ্যান ধারণার সমগোত্রীয় হলেও এর মধ্যে লৌকিক ও পৌরাণিক শিবের মিশ্রণ ঘটেছে- হাজরাতলার অনুষ্ঠানগুলি এখনও পরিপূর্ণভাবে এই স্মৃতি বহন করে চলেছে। চড়কে মূল সন্ন্যাসী নির্বাচনের ক্ষেত্রে অন্যান্য সন্ন্যাসীদের ভূমিকা থাকে। মূল সন্ন্যাসী কোথাও বংশনুক্রমিক আবার কোথাও বা বিগত বছরের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে অন্যান্য সন্ন্যাসীদের মতামতের মধ্য দিয়ে নির্বাচন করা হয়। চড়কের অনুষ্ঠানগুলি কয়েকটি পর্বে বিভক্ত সন্ন্যাসী নির্বাচন, হবিষন্ন গ্রহণ, ঘট স্থাপন, নীলপুজা, মূল চড়ক অনুষ্ঠান ফুল চাপান, পাটাস ভাঙা ইত্যাদি।