সন্ন্যাসী ঠাকুর
সন্ন্যাসী ঠাকুরের এই সুদীর্ঘ কাহিনী শুনিয়া কার কি উপকার হইবে জানি না। তিনি যে-পথের পথিক ছিলেন এখন আমি সে-পথের পথিক নই। তাঁহার দেবতা ও সাধন-প্রণালীতেও আজ আমার আস্থা নাই। তাঁহার সঙ্গ পাইয়া আমার প্রথম জীবনের যে-দিনগুলি কাটিয়াছিল সেই কৃষ্ণসাধনা, অভিভাবকদের অত্যাচার হাসিমুখে উড়াইয়া দেওয়া, ইহা আমার জীবনের কোনো কাজে আসিয়াছে কি না আজ ভালো করিয়া নির্ণয় করিতে পারি না। তবে অভিজ্ঞতার মূল্য আছে। শৈশবকালের সেই কৃষ্ণসাধনা অনাগত জীবনে পৃথিবীর বহু প্রলোভন হইতে আমাকে রক্ষা করিয়াছে।
কোনোকিছু ত্যাগ করিতে আজ আমাকে অপরের মতো বেগ পাইতে হয় না। তাহা ছাড়া ছোটবেলায় হিন্দুসমাজের দেবদেবী ও সাধন-প্রণালী প্রভৃতি বিষয়ে যে-জ্ঞান লাভ করিয়াছিলাম, তাহা আমার কাব্যসৃষ্টিতে আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করিয়াছে। এদেশের সাহিত্য শুধুমাত্র হিন্দুর সাহিত্য হইবে না, পৃথক করিয়া মুসলমানের সাহিত্যও হইবে না। হিন্দু-মুসলমান এক ভাষায় কথা বলে বলিয়া এদেশের সাহিত্য হইবে হিন্দু-মুসলমানের সাহিত্য। যাঁহারা পৃথক করিয়া সাহিত্য রচনা করিবেন তাঁহারা বেশি দিন টিকিবেন বলিয়া মনে হয় না।
কারণ সাহিত্যের যে-সার্বজনীনতা জগৎকে আকর্ষণ করে সেই স্থানে কোনো সাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি প্রবেশলাভ করিতে পারে না। আমার সাহিত্যসৃষ্টিতে এই সার্বজনীনতা যদি কিছু ঘটিয়া থাকে তাহা এই সন্ন্যাসী ঠাকুরেরই দান।
আমি যখন কলিকাতায় এম এ পড়িতে আসিলাম তখন খবর পাইলাম রানীদিদিরা ফরিদপুরের বাস উঠাইয়া কালীঘাটে আসিয়া রহিয়াছেন। ঠিকানা লইয়া একদিন রানীদিদিকে দেখিতে গেলাম। আমার সেই স্নেহময়ী রানীদিদি। বালককালের কল্পনা লইয়া এই দিদিটিকে কতই না আপনার জন ভাবিতাম। তাঁর কাছে যে স্নেহ-মমতা পাইয়াছি, তাহা আমার শিশুজীবনকে কতভাবেই না আকৃষ্ট করিয়া তুলিত। অনেক খোঁজাখুঁজির পর রানীদিদির বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম। বাসা তো নয় একখানামাত্র ঘর। সেই ঘরে যেন একটি দেবী-প্রতিমা বসিয়া আছেন।
মুখের শ্রীতে আবছা মলিনতার দাগ পড়িয়াছে। কিন্তু সেই হাসিটি আগের মতোই আছে। ঘরের মধ্যে রানীদিদির পুজার ঠাকুর। কলসিতে জল। কোথায় আমাকে বসিতে দিবেন। ঘরের সামনে শানবাঁধানো সামান্য একটু জায়গা। সেখানেই একটি মাদুর পাতিয়া আমাকে বসিতে বলিলেন। বসিয়া বসিয়া রানীদিদির সঙ্গে আবার সেই সন্ন্যাসী ঠাকুরের গল্প।
মত পরিবর্তন করিয়া সন্ন্যাসী ঠাকুরের সকল শিক্ষা-দীক্ষা ছাড়িয়াছি। কিন্তু রানীদিদি আর তাঁর স্বামী তাঁহার সবকিছু শিক্ষা-দীক্ষা আজও নিজেদের জীবনে প্রতিদিনের কাজে জীবন্ত করিয়া রাখিয়াছেন। একথা সেকথার পরে তাঁহাদের বর্তমান অবস্থার কথা জিজ্ঞাসা করিলাম।
দাসা আলিপুরের কোর্টে যাইয়া বসিয়া থাকেন। কোনো মামলায় আসামির জামিনের প্রয়োজন হইলে দাদা তাহার হইয়া জামিন-নামায় দস্তখত করেন। ইহাতে যা সামান্য আয় হয় তাহাতে ভালো করিয়া সংসার চলে না। ফরিদপুরে থাকিতে রানীদিদিদের সংসারে কোনো অভাব ছিল না। কেন তাঁহারা দেশ ছাড়িয়া এই বান্ধবহীন শহরে এত অনটনের সঙ্গে যুদ্ধ করিতে আসিয়াছেন কিছুতেই ভাবিয়া পাইলাম না।
চলবে…
Sarakhon Report 



















