১০:২৫ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫

সংখ্যালঘুদের ওপর “রাজনৈতিক কারণে হামলা” এ বাক্য আর কতদিন শুনতে হবে 

  • Sarakhon Report
  • ০৮:০০:৪৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫
  • 18

স্বদেশ রায়

দৈনিক প্রথম আলোর অনলাইন এডিশনে ১১ জানুয়ারি ১৭.৫৪ মিনিটি আপলোড করা একটি সংবাদের শিরোনাম, “ সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা- ভাঙচুরের ৯৮% রাজনৈতিক কারণে: পুলিশের অনুসন্ধান” সংবাদে বলা হয়েছে ৪ আগষ্ট থেকে ২০ আগষ্ট অবধি সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও ভাঙচুরের ১ হাজার ৪১৫টি অভিযোগের মধ্যে ৯৮.৪ শতাংশই হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

রাজনৈতিক কারণে হামলা, ভাঙচুর কথাটি কেন উল্লেখ করা হচ্ছে, আর “ রাজনৈতিক কারণে হামলা বিষয়টি” কি তা অবশ্য প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে  কোন ব্যাখা দেয়া হয়নি। বাংলাদেশের পেনাল কোডে রাজনৈতিক হামলা,  রাজনৈতিক ভাঙচুর বলে কোন কিছুর উল্লেখ নেই। আর এই ২০২৪ এর আগে বাংলাদেশে কেউ কখনো শোনেনি যে সংখ্যালঘুদের ওপর যে হামলা হয়েছে তাকে “রাজনৈতিক হামলা” বলে সংঙায়িত করা হয়েছে। বড় জোর কোন কোন রাজনৈতিক দলের মাঠ কর্ম‍ীরা অনেক সময় বলতো সংখ্যালঘুরা অমুক দলকে ভোট দেয় বলে ভোটের সময় তাদের ওপর হামলা হয়।

 

বাস্তবে বাংলাদেশে দ্বায়িত্বপূর্ণ কোন মুখ থেকে ২০২৪ এর আগষ্টেই প্রথম শোনা গেলো বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ ও খৃষ্টানদের ওপর যে হামলা হয়েছে তা রাজনৈতিক কারণে। আর সেটা বললেন, দেশের বর্তমান এডমিনিস্ট্রেশানে রাষ্ট্রপতি যাকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করেছেন, তিনি অর্থাৎ ড. মোহাম্মদ ইউনুস। মি. ইউনুস একজন সফল এনজিও ব্যক্তিত্ব হিসেবে পৃথিবীর আরো অনেক এনজিও ব্যক্তিত্ব’র মত তিনিও তার প্রতিষ্ঠান মিলে শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন। শান্তিতে নোবেল আফ্রিকার মাথাই লাখ লাখ গাছ লাগানোর জন্যে পেয়েছিলেন। মাথাই গাছ লাগানোর জন্যে নোবেল পাবার পরে তিনি আরো অধিক সংখ্যক গাছ লাগিয়েছিলেন। মি. ইউনুস-এর এনজিও গ্রামীন ব্যাংক শুধু স্বল্প সুদে ঋন দেয়া একটি প্রতিষ্ঠান নয়, পরোক্ষভাবে নারী ক্ষমতায়নেও কাজ করে। পৃথিবীতে নারী ক্ষমতায়ন মূলত মানবাধিকারকে উচ্চে তুলে ধরার মধ্যে পড়ে। সে হিসেবে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেয়াও যে কোন দেশের মানবাধিকারের অংশ। আর এনজিও’র কাজে মি. ইউনুস পৃথিবীর বহুদেশ ঘুরেছেন। বিশেষ করে যে ইউরোপ ও আমেরিকা এনজিওকে বেশি ফান্ড দেয় সেখানে তাঁকে জীবনের অনেক সময়, অনেক বড় ও ছোট পরিবেশে কাটাতে হয়েছে বা মিশতে হয়েছে। তাই তিনি নিশ্চয়ই অন্য অনেকের থেকে বেশি জানেন, ওই সকল দেশগুলো কীভাবে সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার রক্ষা করে। সেখানে তিনি যদি বলেন, বাংলাদেশে শেখ হাসিনার পতনের পরে সংখ্যালঘুদের ওপর যে হামলা হয়েছে এগুলো রাজনৈতকি কারনে তখন স্বাভাবিকই একটা ব্যাখা মানুষের কাছে প্রয়োজন পড়ে কারণ, “ রাজনৈতিক কারণে হামলা” বিষয়টি কি? আগেই উল্লেখ করেছি, পেনাল কোডে এ ধরনের কোন অপরাধকে সংঙায়িত করা হয়নি। সব ধরনের হামলা ও ভাঙচুর ও হত্যা ক্রিমিনাল অফেনস।

তাছাড়া পেনাল কোডের বাইরে এসে রাজনৈতিকভাবে যদি কোন হামলা, ভাঙচুর বা হত্যাকে রাজনৈতিক বলে চিহ্নিত করার একটি চেষ্টাও করা হয়- তাহলে বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপর হামলা কোন দিক থেকে রাজনৈতিক হামলা?  যারা হামলা করছে তারাই কি রাজনৈতিক কোন শক্তি, যাদের নীতি হিন্দুদের নির্যাতন করা।আর সেজন্য তারা এ কাজটি করছে। না বাংলাদেশের হিন্দুরা বড় কোন রাজনৈতিক শক্তি বলে তারা তাদের ওপর হামলা করা হচ্ছে।

সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশে ২ কোটির ওপর হিন্দু আছে। যা সত্যিই একটি বড় জনগোষ্টি। কিন্তু বাস্তবে কি বাংলাদেশের হিন্দুদের কোন রাজনৈতকি শক্তি আছে?

এমনকি যে বলা হয় হিন্দুরা সবাই আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়, বাস্তবে বাংলাদেশের কতভাগ হিন্দু স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারে? গত তিনটি নির্বাচনে দেশের সংখ্যাগুরুদের সঙ্গে সংখ্যালঘুরাও ভোট দিতে পারেনি। তবে ১৯৭০ ও ১৯৭৩ এর নির্বাচনের পরে সংখ্যালঘুরা কি আর সত্যি অর্থে সকলে স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পেরেছে? অনেক জায়গাতে ভোটের আগের রাতেই বলে দেয়া হয়, তারা যেন ভোট দিতে না যায়। তাই সে সব জায়গায় সাধারণত ভোট দিতে গেলেও পুরুষ ও বৃদ্ধ মহিলারা যান। কারণ, একপক্ষ ভোট কেন্দ্রে যেতে না বলে গেছে, অন্যপক্ষ আবার ভোট দেবার চাপ দিয়েছে। তাই বাংলাদেশের হিন্দুদের এভাবে ব্যালান্স করে চলতে হয় গ্রামাঞ্চলে।

১৯৭৫ এর রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর থেকে রাজনৈতিক দল ও সরকারে হিন্দুদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ভিন্ন পথে প্রবাহিত হচ্ছে। ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্টের রাজনৈতিক পট- পরিবর্তনের আগে এ দেশে যোগ্যতা অনুযায়ী হিন্দুরা যে কোন রাজনৈতিক দলে পদ পদবি পেতো এবং জাতীয় ব্যক্তিত্বরাই মন্ত্রীত্ব পেতো। কিন্তু ১৯৭৫ এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরে একের পর এক যে কিংস পার্টি তৈরি হয়েছে তারা হিন্দুদের ক্ষেত্রে “টোকেন” পদ্ধতি চালু করে। তারা যে কোন একটা বা দুটো কুমিরের বাচ্চা দেখানোর জন্যে বাংলা শব্দে নাম বা কোন হিন্দুকে তাদের নেতা বা সরকারে মন্ত্রী করা শুরু করে। ১৯৭২ থেকে ৭৫ এ ফণী মজুমদার, মনোরঞ্জন ধর এমন জাতীয় ব্যক্তিত্বরা মন্ত্রী হতেন- তার বদলে ৭৫ পরবর্তীকালে  রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে ক্ষমতাহীনদের নাম মাত্র মন্ত্রী বা রাজনৈতিক দলে রেখে খুবই পরিকল্পিতভাবে হিন্দুদের রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাহীন করা হয়। ১৯৯১ এর পর থেকে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগও মূলত একই পথ অবলম্বন করে। যে আওয়ামীলীগকে ঘিরে এখন বলা হচ্ছে তারা হিন্দুদের সুবিধা দিয়েছিলো। বাস্তবে একটি উদাহরণের দিকে চোখ রাখলেই তো বোঝা যায়, কী সুবিধা সেখানে হিন্দুরা পেয়েছে? আওয়ামী লীগও কি ১৯৭৫ এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরের কিংস পার্টিগুলোর মতো কুমিরের বাচ্চা দেখায়নি?   তারা কি কোন জাতীয় পর্যায়ে পরিচিত হিন্দুকে তাদের সরকারের মন্ত্রী করেছিলো? তারাও তো চালের দোকানদার, স্কুল মাস্টার এদেরকেই মন্ত্রী বানিয়েছিলো। দলীয় বড় পদেও ঠিক একই অবস্থা।এমন কোথা থেকে একজনকে এনে পদ দিতো যাকে দেশের মানুষ তো দূরে থাক তার এলাকার হিন্দুরাও চিনত না।  তবে হ্যা, চাকুরির ক্ষেত্রে এখন যেমন বাদ পড়ার এই ডিজাইনে হিন্দুদের পারসেন্টজটা থাউজেন্ডটাইম ছাড়িয়ে যাচ্ছে, তখন এমনটি ঘটেনি। তবে জনসংখ্যা ও শিক্ষার হারের অনুপাতে তারা সরকারি চাকরি পায়নি। তার পরেও ভিসি, সচিব, ব্যাংকের এমডি এগুলোর কয়েকটা পদ তারা পেয়েছিলো।

তবে রাজনৈতিক ক্ষমতা ও নাগরিক অধিকার যাকে বলে, এমনকি হিন্দুদের যে ভারতের সঙ্গে সব সময়ই ট্যাগ করা হয়, যে ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও হয়- সেই ভারতে সংখ্যালঘুদের যে রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার আছে বাংলাদেশে ১৯৭৫ এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরে তা কি কখনও চিন্তা করা যায়! এ পি জে আবুল কালাম আজাদের মত সে দেশে একজন সংখ্যালঘু হয়ে যেমন রাষ্ট্রপতি হন বাংলাদেশে তেমনটি ঘটবে,  বা সালমান খুরশীদের মত এখানে কোন সংখ্যালঘু পররাষ্ট্র মন্ত্রী হবেন এটা কেউ কখনও চিন্তা করতে পারে না।

ভারতের অন্যতম রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী শহরের মেয়র ফিরহাদ হাকিম। তিনি মন্ত্রীও।  বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার মেয়র বাদ দেন,  খুলনা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম বা বরিশালের মত বিভাগীয় শহরে কোন মেয়র হিন্দু হবে এ চিন্তা এখন কেউ কল্পনা করতে পারে না। আর একা ফিরহাদ হাকিম ভারতের রাজনীতিতে যে রাজনৈতিক শক্তি রাখেন বাংলাদেশের দুই কোটি হিন্দুর রাজনৈতিক শক্তি তার সঙ্গে তুলনা করতে গেলে সৈয়দ মুজতবা আলীর “পাদটিকা” গল্পের পন্ডিতমশাইয়ের সেই আঁকটি  ( অংক) মনে পড়ে যায়। – “ লাট সাহেবের কুত্তাটার পেছনে মাসে পঁচাত্তর টাকা খরচ হয়, আর সে কুকুরের যদি তিনটে ঠ্যাং হয় তবে ফি ঠ্যাঙের জন্যে কত খরচ হয়?’  আমি ভয় করছিলুম পন্ডিত মহাশয় একটা মারাত্মক রকম আঁক কষতে দেবেন। আরাম বোধ করে তাড়াতাড়ি বললুম ‘ আজ্ঞে পঁচিশ টাকা’। পন্ডিতমশাই বললেন, ‘ সাধু সাধু’ ! তারপর বললেন, অপিচ আমি, ব্রাহ্মণী, বৃদ্ধা মাতা, তিন কন্যা, বিধবা পিসি, দাসী একুনে আটজন। আমাদের সকলের জীবন ধারনের জন্যে আমি মাসে পাই পঁচিশ টাকা । এখন বলতো দেখি, তবে বুঝি তোর পেটে কত বিদ্যে, এই ব্রাহ্মণ পরিবার লাট সাহেবের কুকুরের ক’টা ঠ্যাঙের সমান?

ভারতের একটি রাজ্যে’র ৪২টি লোকসভা আসনের ৩০টি যে দলের দখলে এবং ২৯৪টি বিধান সভার আসনের মধ্যে ২২৫টি যাদের দখলে সেই দলের শুধু মন্ত্রী ও রাজধানী শহরের মেয়র নন, দলের সেকেন্ড ম্যানও ফিরহাদ হাকিম। এখন যদি বাংলাদেশের কোন পন্ডিতমশাই(যদিও নেই) বেঁচে থাকতেন, আর তিনি যদি কোন আঁক কষতে দিতেন, বলতো ফিরহাদ হাকিমের পায়ের কটা আঙুলের সমান বাংলাদেশের দুই কোটির বেশি হিন্দু?  সে অংকটি কি একেবারে সহজ নয়?

তবে এই সহজ অংকটির কি কোন শেষ নেই?

আগের দুটি লেখাতেও উল্লেখ করেছি, এবারও একই কথা উল্লেখ করি, বাংলাদেশের তরুণ হিন্দু প্রজম্ম এই অংকটি আর করতে চায় না। তারা এ অংকের সমাপ্তি ঘটাতে চায়।

তাই ইতিহাসের অনেক বড় ভুলের পরিসমাপ্তি ও এ ভূখন্ডে একটি সুন্দর মানব সমাজ তৈরির স্বার্থে, এই “ রাজনৈতিক হামলা”র মতো সোনার পাথর বাটি তৈরি না করে, এবং সেজন্য একটি দক্ষ পুলিশ বাহিনীর কাঁধে বন্দুক না রেখে- সত্য’র ভূমিতে সকলের নেমে আসা ভালো।

সর্বোপরি, বলবো, বর্তমানের পুলিশ প্রধান শুধু একজন শিক্ষিত ব্যক্তি নন, তিনি আর্ন্তজাতিক মানের পুলিশিং এর শিক্ষকও, তিনি নিশ্চয়ই পুলিশের ঘাড়ে এই বন্দুক রাখা থেকে বিষয়টি বিরত করবেন। এবং প্রকৃত হামলা, হত্যা ও শ্লীলতাহানীর বিচার করে দেশের সংখ্যালঘু নাগরিকদের মনকে ভয়মুক্ত করতে সহায়তা করবেন।আর একটা বিষয় এ মুহূর্তে মনে করিয়ে দেয়া দরকার, ৫ তারিখ শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পরে সেনাবাহিনী প্রধানই জাতির উদ্দেশ্য প্রথম ভাষণ দেন। আর ওই ভাষনে তিনি বলেছিলেন, তাঁর ওপর আস্থা রাখতে। তিনি সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন। তার আশ্বাসেই কিন্তু সংখ্যালঘুরা বাড়িতে বসেছিলো, পালাইনি। আর বাস্তবে তিনিই এ সরকার গঠন করেছেন। তাই সংখ্যালঘু বা হিন্দুদের নিয়ে এই “রাজনৈতিক হামলা” নামক নাটকের অবসান ঘটাতে ও তাদের ওপর যা ঘটে গেছে নাগরিক হিসেবে সে বিচার পাবার বিষয়টি তিনিও অবশ্য দেখবেন।

লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ ও The Present World.

সংখ্যালঘুদের ওপর “রাজনৈতিক কারণে হামলা” এ বাক্য আর কতদিন শুনতে হবে 

০৮:০০:৪৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২৫

স্বদেশ রায়

দৈনিক প্রথম আলোর অনলাইন এডিশনে ১১ জানুয়ারি ১৭.৫৪ মিনিটি আপলোড করা একটি সংবাদের শিরোনাম, “ সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা- ভাঙচুরের ৯৮% রাজনৈতিক কারণে: পুলিশের অনুসন্ধান” সংবাদে বলা হয়েছে ৪ আগষ্ট থেকে ২০ আগষ্ট অবধি সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও ভাঙচুরের ১ হাজার ৪১৫টি অভিযোগের মধ্যে ৯৮.৪ শতাংশই হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

রাজনৈতিক কারণে হামলা, ভাঙচুর কথাটি কেন উল্লেখ করা হচ্ছে, আর “ রাজনৈতিক কারণে হামলা বিষয়টি” কি তা অবশ্য প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে  কোন ব্যাখা দেয়া হয়নি। বাংলাদেশের পেনাল কোডে রাজনৈতিক হামলা,  রাজনৈতিক ভাঙচুর বলে কোন কিছুর উল্লেখ নেই। আর এই ২০২৪ এর আগে বাংলাদেশে কেউ কখনো শোনেনি যে সংখ্যালঘুদের ওপর যে হামলা হয়েছে তাকে “রাজনৈতিক হামলা” বলে সংঙায়িত করা হয়েছে। বড় জোর কোন কোন রাজনৈতিক দলের মাঠ কর্ম‍ীরা অনেক সময় বলতো সংখ্যালঘুরা অমুক দলকে ভোট দেয় বলে ভোটের সময় তাদের ওপর হামলা হয়।

 

বাস্তবে বাংলাদেশে দ্বায়িত্বপূর্ণ কোন মুখ থেকে ২০২৪ এর আগষ্টেই প্রথম শোনা গেলো বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ ও খৃষ্টানদের ওপর যে হামলা হয়েছে তা রাজনৈতিক কারণে। আর সেটা বললেন, দেশের বর্তমান এডমিনিস্ট্রেশানে রাষ্ট্রপতি যাকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করেছেন, তিনি অর্থাৎ ড. মোহাম্মদ ইউনুস। মি. ইউনুস একজন সফল এনজিও ব্যক্তিত্ব হিসেবে পৃথিবীর আরো অনেক এনজিও ব্যক্তিত্ব’র মত তিনিও তার প্রতিষ্ঠান মিলে শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন। শান্তিতে নোবেল আফ্রিকার মাথাই লাখ লাখ গাছ লাগানোর জন্যে পেয়েছিলেন। মাথাই গাছ লাগানোর জন্যে নোবেল পাবার পরে তিনি আরো অধিক সংখ্যক গাছ লাগিয়েছিলেন। মি. ইউনুস-এর এনজিও গ্রামীন ব্যাংক শুধু স্বল্প সুদে ঋন দেয়া একটি প্রতিষ্ঠান নয়, পরোক্ষভাবে নারী ক্ষমতায়নেও কাজ করে। পৃথিবীতে নারী ক্ষমতায়ন মূলত মানবাধিকারকে উচ্চে তুলে ধরার মধ্যে পড়ে। সে হিসেবে সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেয়াও যে কোন দেশের মানবাধিকারের অংশ। আর এনজিও’র কাজে মি. ইউনুস পৃথিবীর বহুদেশ ঘুরেছেন। বিশেষ করে যে ইউরোপ ও আমেরিকা এনজিওকে বেশি ফান্ড দেয় সেখানে তাঁকে জীবনের অনেক সময়, অনেক বড় ও ছোট পরিবেশে কাটাতে হয়েছে বা মিশতে হয়েছে। তাই তিনি নিশ্চয়ই অন্য অনেকের থেকে বেশি জানেন, ওই সকল দেশগুলো কীভাবে সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার রক্ষা করে। সেখানে তিনি যদি বলেন, বাংলাদেশে শেখ হাসিনার পতনের পরে সংখ্যালঘুদের ওপর যে হামলা হয়েছে এগুলো রাজনৈতকি কারনে তখন স্বাভাবিকই একটা ব্যাখা মানুষের কাছে প্রয়োজন পড়ে কারণ, “ রাজনৈতিক কারণে হামলা” বিষয়টি কি? আগেই উল্লেখ করেছি, পেনাল কোডে এ ধরনের কোন অপরাধকে সংঙায়িত করা হয়নি। সব ধরনের হামলা ও ভাঙচুর ও হত্যা ক্রিমিনাল অফেনস।

তাছাড়া পেনাল কোডের বাইরে এসে রাজনৈতিকভাবে যদি কোন হামলা, ভাঙচুর বা হত্যাকে রাজনৈতিক বলে চিহ্নিত করার একটি চেষ্টাও করা হয়- তাহলে বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপর হামলা কোন দিক থেকে রাজনৈতিক হামলা?  যারা হামলা করছে তারাই কি রাজনৈতিক কোন শক্তি, যাদের নীতি হিন্দুদের নির্যাতন করা।আর সেজন্য তারা এ কাজটি করছে। না বাংলাদেশের হিন্দুরা বড় কোন রাজনৈতিক শক্তি বলে তারা তাদের ওপর হামলা করা হচ্ছে।

সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশে ২ কোটির ওপর হিন্দু আছে। যা সত্যিই একটি বড় জনগোষ্টি। কিন্তু বাস্তবে কি বাংলাদেশের হিন্দুদের কোন রাজনৈতকি শক্তি আছে?

এমনকি যে বলা হয় হিন্দুরা সবাই আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়, বাস্তবে বাংলাদেশের কতভাগ হিন্দু স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারে? গত তিনটি নির্বাচনে দেশের সংখ্যাগুরুদের সঙ্গে সংখ্যালঘুরাও ভোট দিতে পারেনি। তবে ১৯৭০ ও ১৯৭৩ এর নির্বাচনের পরে সংখ্যালঘুরা কি আর সত্যি অর্থে সকলে স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পেরেছে? অনেক জায়গাতে ভোটের আগের রাতেই বলে দেয়া হয়, তারা যেন ভোট দিতে না যায়। তাই সে সব জায়গায় সাধারণত ভোট দিতে গেলেও পুরুষ ও বৃদ্ধ মহিলারা যান। কারণ, একপক্ষ ভোট কেন্দ্রে যেতে না বলে গেছে, অন্যপক্ষ আবার ভোট দেবার চাপ দিয়েছে। তাই বাংলাদেশের হিন্দুদের এভাবে ব্যালান্স করে চলতে হয় গ্রামাঞ্চলে।

১৯৭৫ এর রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর থেকে রাজনৈতিক দল ও সরকারে হিন্দুদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ভিন্ন পথে প্রবাহিত হচ্ছে। ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্টের রাজনৈতিক পট- পরিবর্তনের আগে এ দেশে যোগ্যতা অনুযায়ী হিন্দুরা যে কোন রাজনৈতিক দলে পদ পদবি পেতো এবং জাতীয় ব্যক্তিত্বরাই মন্ত্রীত্ব পেতো। কিন্তু ১৯৭৫ এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরে একের পর এক যে কিংস পার্টি তৈরি হয়েছে তারা হিন্দুদের ক্ষেত্রে “টোকেন” পদ্ধতি চালু করে। তারা যে কোন একটা বা দুটো কুমিরের বাচ্চা দেখানোর জন্যে বাংলা শব্দে নাম বা কোন হিন্দুকে তাদের নেতা বা সরকারে মন্ত্রী করা শুরু করে। ১৯৭২ থেকে ৭৫ এ ফণী মজুমদার, মনোরঞ্জন ধর এমন জাতীয় ব্যক্তিত্বরা মন্ত্রী হতেন- তার বদলে ৭৫ পরবর্তীকালে  রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে ক্ষমতাহীনদের নাম মাত্র মন্ত্রী বা রাজনৈতিক দলে রেখে খুবই পরিকল্পিতভাবে হিন্দুদের রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাহীন করা হয়। ১৯৯১ এর পর থেকে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগও মূলত একই পথ অবলম্বন করে। যে আওয়ামীলীগকে ঘিরে এখন বলা হচ্ছে তারা হিন্দুদের সুবিধা দিয়েছিলো। বাস্তবে একটি উদাহরণের দিকে চোখ রাখলেই তো বোঝা যায়, কী সুবিধা সেখানে হিন্দুরা পেয়েছে? আওয়ামী লীগও কি ১৯৭৫ এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরের কিংস পার্টিগুলোর মতো কুমিরের বাচ্চা দেখায়নি?   তারা কি কোন জাতীয় পর্যায়ে পরিচিত হিন্দুকে তাদের সরকারের মন্ত্রী করেছিলো? তারাও তো চালের দোকানদার, স্কুল মাস্টার এদেরকেই মন্ত্রী বানিয়েছিলো। দলীয় বড় পদেও ঠিক একই অবস্থা।এমন কোথা থেকে একজনকে এনে পদ দিতো যাকে দেশের মানুষ তো দূরে থাক তার এলাকার হিন্দুরাও চিনত না।  তবে হ্যা, চাকুরির ক্ষেত্রে এখন যেমন বাদ পড়ার এই ডিজাইনে হিন্দুদের পারসেন্টজটা থাউজেন্ডটাইম ছাড়িয়ে যাচ্ছে, তখন এমনটি ঘটেনি। তবে জনসংখ্যা ও শিক্ষার হারের অনুপাতে তারা সরকারি চাকরি পায়নি। তার পরেও ভিসি, সচিব, ব্যাংকের এমডি এগুলোর কয়েকটা পদ তারা পেয়েছিলো।

তবে রাজনৈতিক ক্ষমতা ও নাগরিক অধিকার যাকে বলে, এমনকি হিন্দুদের যে ভারতের সঙ্গে সব সময়ই ট্যাগ করা হয়, যে ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাও হয়- সেই ভারতে সংখ্যালঘুদের যে রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার আছে বাংলাদেশে ১৯৭৫ এর রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পরে তা কি কখনও চিন্তা করা যায়! এ পি জে আবুল কালাম আজাদের মত সে দেশে একজন সংখ্যালঘু হয়ে যেমন রাষ্ট্রপতি হন বাংলাদেশে তেমনটি ঘটবে,  বা সালমান খুরশীদের মত এখানে কোন সংখ্যালঘু পররাষ্ট্র মন্ত্রী হবেন এটা কেউ কখনও চিন্তা করতে পারে না।

ভারতের অন্যতম রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী শহরের মেয়র ফিরহাদ হাকিম। তিনি মন্ত্রীও।  বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার মেয়র বাদ দেন,  খুলনা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম বা বরিশালের মত বিভাগীয় শহরে কোন মেয়র হিন্দু হবে এ চিন্তা এখন কেউ কল্পনা করতে পারে না। আর একা ফিরহাদ হাকিম ভারতের রাজনীতিতে যে রাজনৈতিক শক্তি রাখেন বাংলাদেশের দুই কোটি হিন্দুর রাজনৈতিক শক্তি তার সঙ্গে তুলনা করতে গেলে সৈয়দ মুজতবা আলীর “পাদটিকা” গল্পের পন্ডিতমশাইয়ের সেই আঁকটি  ( অংক) মনে পড়ে যায়। – “ লাট সাহেবের কুত্তাটার পেছনে মাসে পঁচাত্তর টাকা খরচ হয়, আর সে কুকুরের যদি তিনটে ঠ্যাং হয় তবে ফি ঠ্যাঙের জন্যে কত খরচ হয়?’  আমি ভয় করছিলুম পন্ডিত মহাশয় একটা মারাত্মক রকম আঁক কষতে দেবেন। আরাম বোধ করে তাড়াতাড়ি বললুম ‘ আজ্ঞে পঁচিশ টাকা’। পন্ডিতমশাই বললেন, ‘ সাধু সাধু’ ! তারপর বললেন, অপিচ আমি, ব্রাহ্মণী, বৃদ্ধা মাতা, তিন কন্যা, বিধবা পিসি, দাসী একুনে আটজন। আমাদের সকলের জীবন ধারনের জন্যে আমি মাসে পাই পঁচিশ টাকা । এখন বলতো দেখি, তবে বুঝি তোর পেটে কত বিদ্যে, এই ব্রাহ্মণ পরিবার লাট সাহেবের কুকুরের ক’টা ঠ্যাঙের সমান?

ভারতের একটি রাজ্যে’র ৪২টি লোকসভা আসনের ৩০টি যে দলের দখলে এবং ২৯৪টি বিধান সভার আসনের মধ্যে ২২৫টি যাদের দখলে সেই দলের শুধু মন্ত্রী ও রাজধানী শহরের মেয়র নন, দলের সেকেন্ড ম্যানও ফিরহাদ হাকিম। এখন যদি বাংলাদেশের কোন পন্ডিতমশাই(যদিও নেই) বেঁচে থাকতেন, আর তিনি যদি কোন আঁক কষতে দিতেন, বলতো ফিরহাদ হাকিমের পায়ের কটা আঙুলের সমান বাংলাদেশের দুই কোটির বেশি হিন্দু?  সে অংকটি কি একেবারে সহজ নয়?

তবে এই সহজ অংকটির কি কোন শেষ নেই?

আগের দুটি লেখাতেও উল্লেখ করেছি, এবারও একই কথা উল্লেখ করি, বাংলাদেশের তরুণ হিন্দু প্রজম্ম এই অংকটি আর করতে চায় না। তারা এ অংকের সমাপ্তি ঘটাতে চায়।

তাই ইতিহাসের অনেক বড় ভুলের পরিসমাপ্তি ও এ ভূখন্ডে একটি সুন্দর মানব সমাজ তৈরির স্বার্থে, এই “ রাজনৈতিক হামলা”র মতো সোনার পাথর বাটি তৈরি না করে, এবং সেজন্য একটি দক্ষ পুলিশ বাহিনীর কাঁধে বন্দুক না রেখে- সত্য’র ভূমিতে সকলের নেমে আসা ভালো।

সর্বোপরি, বলবো, বর্তমানের পুলিশ প্রধান শুধু একজন শিক্ষিত ব্যক্তি নন, তিনি আর্ন্তজাতিক মানের পুলিশিং এর শিক্ষকও, তিনি নিশ্চয়ই পুলিশের ঘাড়ে এই বন্দুক রাখা থেকে বিষয়টি বিরত করবেন। এবং প্রকৃত হামলা, হত্যা ও শ্লীলতাহানীর বিচার করে দেশের সংখ্যালঘু নাগরিকদের মনকে ভয়মুক্ত করতে সহায়তা করবেন।আর একটা বিষয় এ মুহূর্তে মনে করিয়ে দেয়া দরকার, ৫ তারিখ শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পরে সেনাবাহিনী প্রধানই জাতির উদ্দেশ্য প্রথম ভাষণ দেন। আর ওই ভাষনে তিনি বলেছিলেন, তাঁর ওপর আস্থা রাখতে। তিনি সকলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন। তার আশ্বাসেই কিন্তু সংখ্যালঘুরা বাড়িতে বসেছিলো, পালাইনি। আর বাস্তবে তিনিই এ সরকার গঠন করেছেন। তাই সংখ্যালঘু বা হিন্দুদের নিয়ে এই “রাজনৈতিক হামলা” নামক নাটকের অবসান ঘটাতে ও তাদের ওপর যা ঘটে গেছে নাগরিক হিসেবে সে বিচার পাবার বিষয়টি তিনিও অবশ্য দেখবেন।

লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ ও The Present World.