সারাক্ষণ ডেস্ক
বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের (টিইউসি) সভাপতি, শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ) এর অন্যতম শীর্ষ নেতা, পাট আন্দোলনের পুরোধা, প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা সহিদুল্লাহ চৌধুরীর প্রয়ানে আজ ২৪ জানুয়ারি-২০২৫ শুক্রবার বিকাল ৩.০০ টায় রাজধানীর তোপখানা রোডস্থ বিএমএ মিলনায়তনে শোক সভা, শ্রদ্ধা নিবেদন ও তার গৌরবোজ্জ্বল জীবন সংগ্রামের উপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন কর্মসূচী পালিত হয়। কর্মসূচীর শুরুতে শোক ও গণসংগীত পরিবেশন করেন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী। প্রয়াত সভাপতির প্রতি দাড়িয়ে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র (টিইউসি) কর্তৃক আয়োজিত উক্ত কর্মসূচীতে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সহ-সভাপতি প্রবীণ শ্রমিক নেতা মাহবুব আলম। প্রয়াত নেতার জীবন ও কর্মের উপর স্মৃতিচারণ করে বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এম এম আকাশ, শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান ও বিলসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি নারী নেত্রী ডা ফওজিয়া মোসলেম, বিশ্ব ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন (ডঋঞট) এর প্রেসিডেন্সিয়াল কাউন্সিলের মেম্বার মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ, সর্বভারতীয় ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস এর প্রতিনিধি ও ভারতের চটকল মজদুর ফেডারেশনের অন্যতম নেতা অচিন্ত্য নারায়ন চৌধুরী, পাট-সুতা- বস্রকল শ্রমিক কর্মচারী সংগ্রাম পরিষদের প্রতিষ্ঠাকালীন যুগ্ম আহবায়ক সহিদুল্লাহ চৌধুরীর লড়াই সংগ্রামের অত্যন্ত ঘনিষ্ট সহযোদ্ধা লুৎফর রহমান, আইবিসির ভাইস চেয়ারম্যান জেড এম কামরুল আনাম, টিইউসির সহ-সভাপতি তপন দত্ত, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ, ইদ্রিস আলী প্রমুখ। শোক সভায় সহিদুল্লাহ চৌধুরীর জীবন সংগ্রাম সম্পর্কিত শোক প্রস্তাব পাঠ করেন টিইউসির দপ্তর সম্পাদক সাহিদা পারভীন শিখা। শোক সভা পরিচালনা করেন টিইউসির অর্থ সম্পাদক কাজী রুহুল আমিন।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা, শিল্প সম্পর্ক এবং অর্থনীতির বিষয়ে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকরাও সহিদুল্লাহ চৌধুরীর নিকট থেকে অনেক কিছু শিখেছি। নীতিতে দৃঢ়, কৌশলে নমনীয় এবং আচরণে তার বিনয়ী ও উন্নত মানবিক গুণাবলী এদেশের অসংখ্য মানুষকে মানবমুক্তির সংগ্রামে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। শ্রেণী সচেতন ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন এবং সাম্যবাদী সমাজ বিনির্মাণের পাথেয় হিসেবে চিরঞ্জীব হয়ে থাকবেন তিনি।
শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেন শ্রমিকের উন্নত জীবন, শিল্পের অগ্রগতি এবং উৎপাদন ও জাতীয় অর্থনীতিতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার সম্পর্কে সহিদুল্লাহ চৌধুরীর জ্ঞান ও প্রজ্ঞা মানবজাতির জন্য অতুলনীয়।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন সহিদুল্লাহ চৌধুরী শ্রমিকদের অধিকার আদায় এবং শোষনমুক্তির সংগ্রামে ভুমিকা রাখার পাশাপাশি শ্রমিক ও তার পরিবারের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
টিইউসির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ বলেন ষাটের দশকে পাটকল শ্রমিক আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান ও মহান মুক্তিযুদ্ধে লতিফ বাওয়ানীসহ পাটকল শ্রমিকদের লড়াকু ভুমিকার অন্যতম প্রধান নেতা ছিলেন সহিদুল্লাহ চৌধুরী। তিনি আরো বলেন বাংলাদেশের শ্রমিকদের অর্থনৈতিক সুবিধা আদায়ের সংগ্রাম এবং মজুরি দাসত্ব থেকে শ্রমিক শ্রেণীকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে সহিদুল্লাহ চৌধুরীর সততা, ত্যাগ ও আদর্শনিষ্ঠা এদেশের শ্রমিক আন্দোলনের পাথেয় হয়ে থাকবেন। সামাজিক মুক্তির লক্ষ্যে দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও তার ভুমিকা ছিল অবিস্মরণীয়।
শ্রমিক আন্দোলনের সিড়ি বেয়ে বামপন্থী রাজনীতি তথা জাতীয় রাজনীতিতে এবং শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির লড়াইয়ে তরুণ সমাজ ও দেশের মানুষকে সংগঠিত করতে পশ্চাৎপদ সুবিধাবাদী সংস্কৃতির দেয়াল ভেঙ্গে প্রগতির যাত্রাপথে সাথী হওয়ার আলোকবর্তিকা ছিলেন সহিদুল্লাহ চৌধুরী। ১৯৬৯ সালে ডেমরায় টর্নেডোতে অসংখ্য মানুষ মৃত্যুবরণ করেন এবং আহত হন। শত শত ঘর-বাড়ি ধ্বংস হয়ে হাজার হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হন। আহতদের চিকিৎসা, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন এবং খাদ্য প্রদানের জন্য ৬ মাসব্যাপী রিলিফ কার্যক্রম পরিচালনার অন্যতম নেতা ছিলেন সহিদুল্লাহ চৌধুরী। তিনি বিভিন্ন সময়ে লেবার কোর্টের সদস্য এবং জাতীয় পাট কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। স্পেকট্রাম গার্মেন্ট-এর ভবন ধ্বসের পর জাতীয় তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
নিরক্ষর শ্রমিকদের শিক্ষা প্রদানের জন্য তিনি বয়স্ক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। বয়স্কদের শিক্ষা দানের সেই স্কুলই পরবর্তীতে বাওয়ানী স্কুল নামে একটি পূর্ণাঙ্গ স্কুলে উন্নীত হয়। শ্রমিকদের সন্তানদের শিক্ষা দান নিশ্চিত করতে ১৯৮৩ সালে মিলের সাথে প্রতিষ্ঠা করেন ডেমরা কলেজ। শ্রমিকদের সম্মতিক্রমে তৎকালীন সময়ে একদিনের মজুরী এক লক্ষাধিক টাকা দিয়ে কলেজের কার্যক্রম শুরু করেন। সহিদুল্লাহ চৌধুরীর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা জানাতে শ্রমিক কর্মচারীদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন জোরদার এবং তার আশা আকাঙ্খা পূরণে তারই রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করা আমাদের বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের নৈতিক কর্তব্য।