স্বদেশ রায়
৫ আগষ্ট যে সময়ে সেনাপ্রধানের উদ্যোগে বঙ্গভবনে মিটিং -এর পরে প্রেসিডেন্টের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে মুহাম্মদ ইউনূসের নাম ঘোষণা করা হয়- ওই সময়ে অনান্য অনেকের মধ্যে একজন আওয়ামী লীগ নেতাও ফোন করেন। ওই নেতা বলেন, “ আমাদের আমলে আমরা ইউনূসকে যা বলেছি বা করেছি সেটা ভিন্ন কথা, এ মুহূর্তে তিনিই বাংলাদেশে সব থেকে জনপ্রিয়। তার জনপ্রিয়তা এখন ৯০% এর কাছাকাছি হবে। তার কয়েক ঘন্টা পরে একটি ফার্মেসীতে ওষুধ কিনতে গিয়েছিলাম। বড় ফার্মেসী, সেখানে প্রায় ১০ জনের ওপর সেলসম্যান। তাদের নিজেদের ভেতর কথা বা আলাপচারিতায় বুঝতে পারি, ওদেরও সিংহভাগ শেখ হাসিনার আকস্মিক দেশত্যাগের পরে মুহাম্মদ ইউনূসকেই সঠিক মানুষ বলে মনে করছে।
এমনকি ওই সময়ে যখন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে এবং একের পর এক অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটতে থাকে- সে সময়ে মানুষ সেনাপ্রধান এবং মুহাম্মদ ইউনূসের ওপরই আস্থা রেখেছিলেন। এমনকি অনেকে মনে করেছিলেন, ইউনূস ফিরে এলে এগুলো ঠিক হয়ে যাবে।
এই শতকরা নব্বইভাগ মানুষের একটি ক্ষুদ্রতম অংশ হলেও দেশের সচেতন মানুষ যারা ভূ-রাজনৈতিক বিষয়টিতে জ্ঞান রাখেন, তাদের কপালের রেখায় চিন্তার ভাঁজ ফেলে দেন তিনি দ্বায়িত্ব নেবার আগেই প্যারিসে বসে মিডিয়াকে দেয়া সাক্ষাৎকারে। সেখানে তিনি বলেন, “ বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করা হলে, ভারতের সেভেন সিস্টারও ( উত্তর -পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্য) স্থিতিশীল থাকবে না” । তার এই বক্তব্য মিডিয়ায় বার বার প্রচার পেতে থাকলে একজন প্রজ্ঞাবান ও অনেক সিনিয়র সাবেক ডিপ্লোম্যাট ফোন করে বলেন ( তখনও টেলিফোনে কথা বলা নিয়ে এতটা ভয়ের সংস্কৃতি চালু হয়নি), ইউনূস সাহেবের মত শিক্ষিত ব্যক্তি, সব থেকে বড় নিকট প্রতিবেশী এবং ২০৭ কিলোমিটার ল্যান্ড বর্ডার ছাড়া বাদবাকি ল্যান্ড বর্ডার যে দেশের সঙ্গে, সেই দেশকে নিয়ে কেন এ ধরনের মন্তব্য করতে গেলেন?
ওনাকে বলি, দেখুন পেশাগত কারণে ইউনূস ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় দীর্ঘদিনের। তার রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিয়ে লেখা “ পথের বাধা সরিয়ে দিন” প্রবন্ধ নিয়ে আমি আমার একটি লেখায়, তার কোন কোন চিন্তা সুভাষ বোস ও গান্ধীর মত বলে উল্লেখ করি। কারণ, তার লেখার মূল থিম আমার কাছে মনে হয়েছিলো, তিনি বিশ্বাস করেন, রাষ্ট্র সর্বগ্রাসী ও আগ্রাসী হবে না- রাষ্ট্র শুধু তার দেশের মানুষের অগ্রগতির সহায়ক হবে। ব্যক্তিগতভাবে আমার বিশ্বাসও এখানে। (রাষ্ট্র যত বেশি সমাজকে স্পেস দেবে ততই ওই রাষ্ট্র শক্তিশালী বলে আমি মনে করি।) ওই সময়ে তিনি একদিন ফোনে আমাকে বলেন, “ আপনি কি আমার সম্পর্কে একটু বেশি লিখে ফেললেন না” ? সেই মানুষের মুখে এ ধরনের কথা, আমি ঠিক মেলাতে পারছি না। তবে আমার মনে হয়, ওনার চিহ্নিত শত্রু শেখ হাসিনাকে ভারত আশ্রয় দেবার ফলে উনি ক্ষুব্ধ হয়ে একথা বলেছেন।
সে সময়ে ওই কূটনীতিক সিনিয়র ভাই বলেন, “ দেখ, আমাদের এই বয়সে কি কোন কারণে ক্ষুব্দ হওয়া মানায়? আর উনি তো আমাদের থেকে সিনিয়র। তাছাড়া ভারত তো শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেবেই। আর শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেয়া আর তাদের বাংলাদেশ নীতি তো সব ক্ষেত্রে এক হবে না। ভারত তিব্বতের নেতা দালাইলামাকে আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু ,ভারত কখনও চায়নার প্রতি আগ্রাসী হয়নি। অহেতুক চায়নার সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কোন ঝগড়ায় যায়নি। তাছাড়া ১৯৭১ সালে ভারত আওয়ামী লীগ নেতাদের আশ্রয় দিয়েছে। শরনার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও স্বাধীনতার সংগ্রামকে সমর্থন করেছে। কিন্তু পাকিস্তান যতক্ষণ না ভারত আক্রমন করেছে তার আগে ভারত কিন্তু পাকিস্তানের কোন ভূমির দিকে তাকায়নি। এমনকি মিত্র বাহিনী হিসেবেও বিজয়ের পরে তারা এখানে থাকার কোন চেষ্টা করেনি। ইউনূস সাহেবের তো এসব বোঝা উচিত ছিলো । উনি কেন আগ বাড়িয়ে ভারতকে শত্রু রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড় করাতে যাচ্ছেন”!
ওনার মতো আরো কয়েকজন প্রজ্ঞাবান কূটনীতিক ও আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক বিষয়ক অধ্যাপক ফোনে একই ধরনের একাডেমিক আলোচনা করেন। ওই সময়ে বেশিভাগ মানুষ ঘরে বন্দী। কারণ, রাস্তায় নানা অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটছিলো। তাই টেলিফোনই ছিলো ওই মুহূর্তে পারস্পারিক মত বিনিময়ের একমাত্র মাধ্যম। আর ওই কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে, একটি বিষয় বুঝতে পারি, মুহাম্মদ ইউনূস শপথ নেবার আগেই দেশের একটি শ্রেণীর ( সংখ্যায় তারা যতই কম হোন না কেন, তাদের চিন্তার প্রভাব অনেক বেশি থাকে সমাজে) কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে দিয়েছেন।
তবে মুহাম্মদ ইউনূসের এই কথা বলার পর পরই দেশে সেভেন সিস্টার দখল ও চিকেন নেক নিয়ে হাজার হাজার শব্দ বোমা শুরু হয়ে যায়। বুঝতে পারি, যে সরকারকে হঠানো হয়েছে, তাকে আরো কোনঠাসা করার জন্যে সেই “ অতি-পূরাতনভাব” কিন্তু “ নব আবিস্কার” হয়েছে। অর্থাৎ পাকিস্তান আমলের সেই ভারত বিরোধীতা ও হিন্দু বিরোধীতার রাজনীতি। কিন্তু মোহাম্মদ ইউনূস কেন এই রাজনীতিকে উসকে দিলেন , তা ঠিক বুঝতে পারি না। কারণ, এই রাজনীতি তো শুধু মাত্র ভোটের মাঠের রাজনীতি। রাষ্ট্র পরিচালনার রাজনীতি নয়। মুহাম্মদ ইউনূসের কাজ তো রাষ্ট্রকে সঠিকভাবে পরিচালনা করে- দ্রুত একটি ইনক্লুসিভ নির্বাচন দেয়া, যা সারা পৃথিবীতে গ্রহনযোগ্য হয়। আওয়ামীলীগের আমলে যা ২০১৪ তে পাঁচ সিটি কর্পোরেশান নির্বাচনের পরে আর ঘটেনি। তাছাড়া ওনার নিজের তো কোন ভোটের রাজনীতি নেই। আর এ ধরনের কোন প্রতিবেশী দেশ বিরোধীতা বা ধর্মীয় সংখ্যালঘু বিরোধীতা যে শুধুমাত্র নির্বাচনী প্রচারের বিষয়, রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয় নয়- তা ২০১৪তে বেগম জিয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন। ওই সময়ে বিজেপি নির্বাচনী প্রচারে ভারতের সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অনেক বক্তব্য রাখছিলো। অন্যদিকে, বিএনপি তখন ধরে নিয়েছিলো, ২০০১ এর মতো এবারও বিজেপি আওয়ামী লীগের বদলে তাদের বন্ধু হবে। তাই তারা বার বার বিজেপির সমর্থনে কথা বলছিলো। এমন একটি সময়ে বেগম জিয়াকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, বিজেপি এভাবে ভারতের সংখ্যলঘু মুসলমানদের বিরুদ্ধে কথা বলছে ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কথা বলছে – তারা ক্ষমতায় এলে বিএনপি তাদের সঙ্গে কীভাবে বন্ধুত্ব বজায় রাখবে? নির্বাচনী রাজনীতিতে পরিশ্রমী, অভিজ্ঞ ও সফল এবং রাষ্ট্র পরিচালনার অভিজ্ঞতা থেকে বেগম জিয়া এই উপমহাদেশের নির্বাচনী রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার সঠিক কথাটি বলেন। তিনি খুবই গোছানো শব্দে যা বলেন তা ছিলো এমনই “ নির্বাচনে জেতার জন্যে মাঠের বক্তব্য কখনও রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রভাব ফেলে না। বিজেপি যা বলছে , ওটা তাদের নির্বাচনে জেতার জন্য মাঠের বক্তব্য মাত্র”। বেগম জিয়ার দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার এই নির্যাস থেকে বলা যায়, মুহাম্মদ ইউনূস আসলে ভারতকে ঘিরে নির্বাচনী মাঠের রাজনৈতিক বক্তব্যই দেয়া শুরু করেন ক্ষমতা গ্রহনের আগে থেকেই। যা দেশের বিবেচক অনেকেরই দ্রুত মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে যে অতি উচ্চ ধারণার ঘোর তার ওপর একটি প্রশ্ন চিহ্ন তৈরি করে দেয়।
অন্যদিকে ইউনূস একটু খেয়াল করলেন না বিএনপি নেতা রিজভী উত্তেজনার বশে বা পরিবেশের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে একটি শাল ও একটি শাড়ী পোড়ানোর পরে তিনি শুধু থেমে গেলেন না- তার দলও তার এই কাজকে এনডোরস করেনি। এবং বেগম জিয়া বা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কেউই এই ভারত বিরোধীতা বা সাত বোনের রূপকথা শুনতে আগ্রহী হলেন না। তারা বরং বিপরীত অবস্থানে থাকলেন। অর্থাৎ বিএনপির নেতারাও পরোক্ষভাবে মুহাম্মদ ইউনূসের ওপর একটি প্রশ্ন চিহ্ন একে দেন।
এরপরে দেশ ফিরে রাষ্ট্রপতির অধীনে শপথ নেবার পরে, তিনি ইতিহাস বিজড়িত বঙ্গবন্ধুর বত্রিশ নম্বর বাড়িতে আগুন দেয়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুর্তি ভাঙ্গা ও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলাকে নিয়ে যা বলেন, তার মমার্থ দাঁড়ায়, এটা বিপ্লবের সেলিব্রেশানের অংশ। মুহাম্মদ ইউনূসের মতো একজন শিক্ষিত ব্যক্তি’র বত্রিশ নম্বর বাড়িতে আগুন দেয়া নিয়ে ওই ধরনের কথা বলা বা তা নিয়ে কোন ব্যবস্থা না নেয়া কিন্তু সর্বনিম্ম ধরলেও অন্তত এক কোটি মানুষকে মুহাম্মদ ইউনূস থেকে দূরে নিয়ে যায়। কারণ, যদি ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে ধরা হয় অর্থাৎ যদি বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমানে ভাগ করা হয়, তাহলে বাঙালি হিন্দু -মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রামমোহন রায়, রবীন্দ্রনাথ, চিত্ত রঞ্জন দাশ, (সি আর দাশ) সুভাষ বোস প্রমূখকে প্রজ্ঞা ও বীরত্বের হিরো হিসেবে বুকের মধ্যে রাখতে পারে। আর এর বিপরীতে বাঙালি মুসলিমের কিন্তু নজরুল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব । ( যদিও বিবেকবান বাঙালি সব সময়ই হিন্দু- মুসলিমের উর্ধে উঠে উল্লিখিত সবাইকে তাদের চিন্তার ও বীরত্বের নায়ক হিসেবেই গ্রহন করে) তাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি এই পরোক্ষ অবজ্ঞা অন্তত এক কোটি মানুষের একটি প্রশ্নের চিহ্ন মুহাম্মদ ইউনুসের ওপর ফেলে দেয়। পরবর্তীতে তিনি যখন বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যার দিবসকে জাতীয় শোক দিবস থেকে বাদ দেন- তখনও একটি বড় সংখ্যক মানুষকে তিনি আহত করেন।
আর এর সঙ্গে সঙ্গে তিনি যখন প্রথমে সংখ্যালঘু অর্থাৎ বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলাকে কোন ক্রিমিনাল অফেন্স না বলে, রাজনৈতিক ঘটনা বলে স্টাবলিশ করতে চান সে সময়ে, ২ কোটি হিন্দু খুব সহজে এটাই ভাববে, “ যে আমাকে ঠকায় সে আমার থেকে চালাক নয়, কেবল আমি অসহায় তাই সে এই সুযোগ নিচ্ছে” । আর আপনি যাকে অসহায়ত্বে ফেলে দিচ্ছেন, সে আর যাই হোক আপনার ভক্ত বা সমর্থক হবে না। অর্থাৎ ইউনূস সাহেবের ওপর থেকে আরো দুই কোটি মানুষ তাদের ভক্তি ও সমর্থন উঠিয়ে নিলো নীরবে। পরে অবশ্য ভারতীয় ফরেন সেক্রেটারী বিক্রম মিশ্রি’র সফরের পরে মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব- প্রেসের কাছে খুব কম সংখ্যক ঘটনার কথা স্বীকার করলেন, এবং তার কিছু অংশ তদন্ত হচ্ছে বলেও সরকারের পক্ষ হয়ে দেশ ও বিশ্ববাসীকে জানালেন। কিন্তু এই লেখা যখন লিখছি তার দুই দিন আগে তিনি, জানালেন পুলিশি তদন্তে জানা গেছে ওই সব ঘটনাই ছিলো রাজনৈতিক। তার ওই বক্তব্য’র পরে নীরবে সমর্থন উঠিয়ে নেয়া হিন্দুরা আরো গভীর নীরবতায় চলে গেলো। আর যাদের এরশাদ আমলে লেখা শামসুর রাহমানের ওই কবিতার লাইন মনে আছে, “ তোমার প্রেম সরকারি প্রেস নোটের মতো মিথ্যে”। তারা হয়তো এখানে একটু লাইনটি বদলে নেবে, “ তোমার প্রেম ডাস্টবিন প্রেস সচিবের বক্তব্য’র মতো মিথ্যে” ।
এর পরে তিনি জাতিসংঘে গিয়ে ক্লিন্টন সেন্টারের ডোনার হিসেবে ক্লিন্টন সেন্টারে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় শেখ হাসিনার সরকার বিরোধী আন্দোলন- যা দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের আন্দোলন হিসেবে ততক্ষন অবধি পরিচিত ছিলো, তার নায়ক হিসেবে( মেটিকুলাস ডিজাইনের অন্যতম ব্যক্তি) পরিচয় করিযে দেন একটি উগ্র ধর্মীয় সংগঠনের এক বালককে। যার এ যাবৎ কালের বক্তব্য ও কার্যকলাপ সবই প্রমান করেছে, এদেশে আশির দশক অবধি ক্লাস এইট বা নাইনে পড়া কিছু বামপন্থী বালক বালিকা থাকতো, যাদের জ্ঞান মাত্র সামান্য পড়াশুনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে একটি অন্ধ বিশ্বাস তৈরি করতো সমাজতন্ত্রের ওপর- তারই এক ভিন্ন ধরনের, ভিন্ন অবস্থানের ভার্সান মাত্র। কোন মতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক চল্লিশ থেকে সত্তর বা আশির দশকের ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের বিশ বাইশ বছরের জ্ঞানের একশ মাইলের মধ্যে তাকে নেবার কোন সুযোগ নেই। যাহোক, ওই তরুণের জ্ঞান বা অজ্ঞতা বড় কথা নয়। ক্লিন্টন সেন্টারে দেয়া ইউনূসের ওই বক্তব্য মূলত ২৪ এর আন্দোলনকে ভিন্ন অবস্থানে নিয়ে যায়। এর আগ অবধি, সাধারণ ছাত্র ও সাধারণ মানুষের আন্দোলন হিসেবে চিহ্নিত থাকলেও সেটা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে নামানোর উগ্রবাদীদের মেটিকুলাস ডিজাইনের একটি অংশ হিসেবে চিহ্নিত হয়। সাধারণ ছাত্র, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ( বিশেষ করে, প্রগতিশীল ও সেন্টার রাইট) কর্মী ও খেটে খাওয়া মানুষ থেকে যে সাধারণ মধ্যবিত্ত, অফিসের কেরাণী অবধি রাজপথে এসেছিলো- তাদেরকে দূরে ঠেলে দেন তিনি। তিনি এনজিও ব্যবসায়ী- রবীন্দ্রনাথ তাদের কোন কাজে লাগে না বরং রবীন্দ্রনাথ তাদের কাজের কিছুটা বাধাও । তারপরে এ সময়ে তিনি রবীন্দ্রনাথকে মনে করলে ভালো করতেন, নিজেকে সকল গৌরবের অধিকারী করার চেষ্টা সব সময়ই ভুল। আর ভুল চিন্তা থেকেই তিনি যেমন ২০২৪ এর কোটা বিরোধী ও সরকার বিরোধী আন্দোলনকে একটি মৌলবাদী উত্থান হিসেবে চিহ্নিত করলেন। তেমনি সাধারণ ছাত্র, সাধারণ মানুষ এবং আন্দোলনে অংশ গ্রহনকারী অনান্য রাজনৈতিক দলের কৃতিত্ব ছিনতাই করে এক বিপুল সংখ্যক মানুষকে আহত করলেন। এই আহত মানুষের কত অংশ এরপর থেকে তার প্রতি আস্থা ও শ্রদ্ধা রাখছে তা নিয়েও একটা প্রশ্ন চিহ্ন এসে যায়।
এরপরে ওই আমেরিকাতে বসেই তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে দেয়া সাক্ষাতকারে “রিসেট বাটনে” চাপ দিয়ে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধকে ম্যাজিশিয়ানের মতো হাওয়া করে দিয়ে সেখানে ২০২৪ কে বসিয়ে দেন। মুহাম্মদ ইউনূস এনজিও নেতা বা ব্যবসায়ী। তিনি হয়তো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’র গভীরে যাবার সময় পাননি বা তার প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু যারা গভীরে গেছেন তারা জানেন, ৪০ এর দশক থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক পূর্ববাংলার বাঙালি মুসলিমের যে এক ধরনের রেঁনেসা শুরু হয় তা শুধু তাদের একটি ভূখন্ড কেন্দ্রিক কিছু আধুনিক চিন্তার কনসেফচুয়াল জাতীয়তাবাদ ভিত্তিক ছিলো না, ভাষা কেন্দ্রিকও ছিলো না- এর সঙ্গে আরো ছিলো একটি হীনমন্যতা থেকে বেরিয়ে আসার জন্যে এক আত্মত্যাগের দুর্বার আকাঙ্খা। কারণ, বাঙালি মুসলমান পাকিস্তান পেয়েছিলো বিনা আত্মত্যাগে। অন্যদিকে বাঙালি হিন্দু’র ছিলো ঋষি অরবিন্দ’র সৃষ্টি সেই অগ্নিযুগের বিপ্লবী পথ যা ক্ষুদিরাম থেকে শুরু করে সূর্য অস্ত না যাওয়া ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে বসে চট্টগ্রামে তিন দিন মাস্টার দা’ সূর্য সেনের নেতৃত্বে ব্রিটিশ পতাকা নামিয়ে ভারতীয় পতাকা তুলে স্বাধীন রাখা, বিনয় বাদল দীনেশ এর বারান্দা ব্যাটেল, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের একাকি যুদ্ধ ও আত্মদান, বাঘা যতীনের বালাশোর ব্যাটেল, চিত্ত রঞ্জন দাশের বাঙালি হিন্দু- মুসলিমের মিলিত সংগ্রামের চেষ্টা আর সর্বোপরি সুভাষ বোসের রূপকথাকে হার মানানোর সেই স্বাধীনতার পথে যাত্রা, সেই ডাক- “তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব” । এই বিশাল সময় ও ইতিহাসের পর্বকে ঢেকে না দিলেও তার সমানে সমানে মাথা উঁচু করিয়ে দাঁড়িয়েছিলো- পূর্ব বাংলার তরুণরা মাত্র ২২ বছরের সংগ্রামে। যেখানে আগ্নেগিরির অগ্ন্যূপাতের মতো উচ্চারিত হয়েছিলো, “ আমরা যখন মরতে শিখেছি, কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না”; “ এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম” । তেমনি ক্রাক প্লাটুনের সদস্যদের অনেকে এখনও বেঁচে আছেন, তাদেরকে যমুনাতে ডেকে- তাদের বুকে কান পাতলে ইউনূস সাহেব শুনতে পাবেন, কী গর্ব সে বুকে- আত্মত্যাগের কী আকাঙ্খা সেখানে- যা সূর্যসেন, গনেশ ঘোষ , স্বদেশ রঞ্জন বসু বা বাঘা যতীনের মতই এক ব্যঘ্র হৃদপিন্ডের বুক। তাই বাঙালির এই ২২ বছরের সংগ্রাম আর ১৯৭১ কে “ রিসেট বাটনের” মাধ্যমে হাওয়া করতে গিয়ে তিনি বাঙালির একটি বড় অংশের অর্জিত গর্বে আঘাত করেন। যে আঘাতে এ দুঃসময়ে কেউ কোন কথা বলেনি ঠিকই তবে তার থেকে নীরবে দূরে চলে গেছে তারা। তাদের সংখ্যাও কম পক্ষে কোটি ছাড়িয়ে যাবে। হয়তো আরো বেশি হবে।
এছাড়া তিনি পুলিশ হত্যার বিচার বন্ধের জন্যে ইনডেমনিটি দিয়েছেন। এতে প্রমানিত হয়, ওই পুলিশ হত্যাকে এক ধরনের জায়েজ করা। কারণ, পুলিশ শেখ হাসিনার নির্দেশ মতো গুলি ছুড়েছিলো। তাই তারা শেখ হাসিনার পুলিশ। বুরোক্রেসীতেও তিনি একই চিন্তায় অস্বাভাবিক ধরনের পরিবর্তন এনেছেন। কিন্তু একটু পেছন ফিরে তাকালে দেখতে পেতেন, যে পুলিশ এরশাদ আমলে মিছিলে গুলি চালিয়ে ৯০ এর ডিসেম্বরের ২ বা ৩ তারিখেও বিএনপির কর্মী হত্যা করে। ওই পুলিশই কিন্তু বেগম জিয়া ৯১ এ এপ্রিলে সরকার গঠন করার পরেই ঢাকার পাগলায় এরশাদের জাতীয় পার্টির প্রথম মিটিং গুলি ও টিয়ার গ্যাস ছুড়ে ভেঙ্গে দেয়। আবার ৯৬ তে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে ওই পুলিশ একই কাজ করে বিএনপির পল্টনের মিটিং এ। আবার ২০০১ বিএনপি ক্ষমতায় আসার পরে ওই পুলিশই রাজপথে মতিয়া চৌধুরি, তোফায়েল আহমদ, রাশেদ খান মেনন প্রমুখকে রাস্তায় ফেলে লাঠি পেটা করে। তাই পুলিশ মূলত রাষ্ট্রের। যখন যে ক্ষমতায় এসে তাকে যেভাবে ব্যবহার করে সে সেইভাবেই ব্যবহৃত হয়। এছাড়া তার কোন উপায়ও নেই। বুরোক্রেসীও ১৯৭৫ এর ১৫ আগষ্টের আগের চরিত্র আর ১৬ আগষ্টের চরিত্র থেকে শুরু করে প্রতিটি সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে তাদের সরকারের রঙের সঙ্গে মিশে যাওয়া দেখলেই বোঝা যায়। আর এটাই বুরোক্রেসি। তাই পুলিশ বা সিভিল বুরোক্রেসিতে দল খুঁজতে যাওয়া সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। বরং যে বিপুল সংখ্যক পুলিশ নিহত হয়েছেন তাদের হত্যার বিচারের পথ বন্ধ করে মূলত মুহাম্মদ ইউনূস শুধু কয়েক লাখ পুলিশের প্রশ্ন চিহ্ন নিজের ওপর টেনে নেননি। তাদের আত্মীয় স্বজন মিলে এ সংখ্যা কত তা হিসেব করা যেতে পারে। বুরোক্রেসির ক্ষেত্রেও একই। সেখানেও তিনি আহবান করেছেন তার ওপর প্রশ্নবোধক চিহ্ন।
এর পরে তিনি মিশিয়ে ফেলেছেন, শেখ হাসিনার অংশগ্রহনমূলক নির্বাচনহীনতার সঙ্গে আওয়ামীলীগকে। বিদেশী ডোনারদের নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে তিনি হয়তো বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজ নিয়ে খুব বেশি খোঁজখবর নেবার সময় পাননি। তাই তিনি সহজে শেখ হাসিনার নির্বাচনহীনতার রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে আওয়ামীলীগকে শতভাগ মিলিয়ে ফেলছেন। পুর্ববাংলার মোট মুসলিম জনগোষ্টির ৩ থেকে ৫ ভাগের অর্থাৎ নবাব, জমিদার ও ভূস্বামীদের মুসলিম লীগের বাইরে এসে কমপক্ষে ৭০ ভাগ প্রজা মুসলিম জনগোষ্টির তৈরি প্রজাদের মুসলিম লীগই হলো আওয়ামী মুসলিম লীগ যার থেকে আওয়ামী লীগ। আর সেখানে এক ধরনের কাল্ট হিসেবে আবির্ভূত হলেন প্রজাকূলোদ্ভব শেখ মুজিবুর রহমান। তাই এই সহজিয়া বিশ্বাস ও ভক্তির গাঙ্গেয় বঙ্গের মাটিতে আওয়ামী লীগ শুধু একটি রাজনৈতিক দল নয়, এর চরিত্র কিছুটা ধর্মের মতো। যার প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছেন শেখ মুজিবুর রহমান।তাই এখানে১৯৭৫ পরবর্তী একজন আব্দুর রাজ্জাক, ১৯৮১ পরবর্তী একজন শেখ হাসিনা কোন চিরস্থায়ী বিষয় নয়। এখানে সব থেকে বড় বিষয় হলো, কবি রফিক আজাদের ভাষায়, প্রকৃত আওয়ামীলীগার কনভার্ট হয়ে হওয়া যায় না, প্রকৃত আওয়ামীলীগার জম্মসূত্রে হতে হয়। বাস্তবে আওয়ামী পরিবারে আওয়ামীলীগার জম্ম নেয়। অন্যকিছু জম্ম নেয় না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ কনভার্ট হয়ে আওয়ামীলীগার হয়। যেমন তাদের অনেকে এখন মুহাম্মদ ইউনূসের খুব কাছে। তাই যে রাজনৈতিক দল অনেকটা জম্মসূত্রে কর্মী তৈরি করে তাকে চাপা দেবার চেষ্টা করতে গেলে ভুল হয়। আর এই ভুল জিয়াউর রহমান, এরশাদ কেউ করেননি। তাই তারাও একটা নির্দিষ্ট পরিমানে ও সময় অবিধি প্রকৃত আওয়ামী লীগারদের সমর্থনও পেয়েছিলেন। এবং তার ফলে দেশ দ্রুত স্থিতিশীল হয় এবং তারাও জনসমর্থন পান। ড. ইউনূস যে দেশকে স্থিতিশীল করতে পারছেন না তার কারণ তিনি জিয়া বা এরশাদের কাছ থেকে শিক্ষা নিচ্ছেন না। আর এই অস্থিতিশীলতা, প্রতিদিনের মৃত্যু, যেখানে সেখানে নারীর শ্লীলতাহানীকর ঘটনা, প্রগতির বিপরীতের শক্তিদের উত্থান- সহজিয়া বাঙালি সমাজে দ্রুত তার জনপ্রিয়তাকে কমিয়ে দিচ্ছে।
এছাড়া,বাংলাদেশে গত তিরিশ বছর ধরে ধীরে ধীরে রাষ্ট্র ও সমাজের সব থেকে বড় স্টেকহোল্ডার হয়েছে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা। এই ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের নিশ্চয়তা দিতে না পারায়- তাদের কারখানা আগুনে ভস্মীভূত হওয়া থেকে শুরু করে বন্ধ হবার ফলে ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা সব মিলে একটি বড় অংশ তার প্রতি উচ্ছসিত হবার বদলে নীরব হয়ে গেছে।
অন্যদিকে সচেতন ব্যবসায়ীদের তিনি আতঙ্কিত করেছেন, ফিনানসিয়াল টাইমসে দেয়া এক সাক্ষাতকারে। সেখানে তিনি বলেছেন, জিডিপি বৃদ্ধির অর্থনীতিতে তিনি বিশ্বাস করেন না। গোটা বিশ্ব এখানে ভুল করছে। তার বয়স ৮৬, প্রার্থনা করি তিনি শতায়ু হোন। তবে তারপরেও তাকে এ সত্য মানতে হবে, পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে ক্যাপিটালইজমের এই যে ধারা তৈরি হয়ে আজ একটি শক্তিশালী রূপ নিয়েছে, একটি কাঠামো তৈরি হয়েছে – কোন এক ব্যক্তির তা বদলে দেবার চেষ্টা – মূলত দুই হাতে ঠেলে হিমালয়কে স্থানান্তিরত করার চেষ্টামাত্র। এর থেকে বড় কিছু হিসেবে প্রাকটিক্যাল অর্থনীতির কেউ একে মনে করবে না। বরং তারা চিন্তিত হবে তাদের শিল্প ও ব্যবসা নিয়ে। এমন নেতৃত্ব কি তাদেরকে এগিয়ে যেতে সহায়ক হবে? নাকি তার প্রতি নীরব হওয়াই ভালো?
সর্বোপরি, দেশের এ মুহূর্তে প্রকাশ্যে থাকা বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি সহ বেশিভাগ দলই চায় দেশে দ্রুত নির্বাচন হোক। এবং একটি নিরপেক্ষ ব্যবস্থা দেশে সেই ইনক্লুসিভ নির্বাচনের ব্যবস্থা করুক। আর্ন্তজাতিক পরিমন্ডলেও বাংলাদেশের ভবিষ্যত নিয়ে একই আশা। সেখানেও কিন্তু তিনি শেষ পেরকটি মারলেন, ডাভোসে বসে গিডিয়ন রাচম্যানকে দেয়া পডকাস্টের সাক্ষতকারে। তিনি সেখানে স্পষ্টই বললেন, তিনি ছাত্রদের একটি রাজনৈতিক দল করতে বলেছেন। আর একাজের ভেতর দিয়ে প্রমানিত হলো তিনি সরাসরি দলে থাকবেন কি থাকবেন না তা বড় নয়- তিনি একটি “ কিংস পার্টি” গড়তে যাচ্ছেন। এর ফলে তার নিরপেক্ষতা শুধু শেষ হলো না বিএনপি সহ সকল রাজনৈতিক দল যারা শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিলো তাদেরও সমর্থন তিনি হারালেন।
এর পরে আর হারাধনের ছানা ক’টি থাকে বেঁচে?
লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World.