০৪:০৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫
চেকিয়ার জাতীয় ব্ল্যাকআউট: তদন্তে নেমেছে কর্তৃপক্ষ ঢাকা জনঘনত্বের দিক থেকে ৩০ কোটি মানুষের নগরী? সোশ্যাল মিডিয়া: এক প্রজন্মকে হতাশা, অমনোযোগ, অলসতা ও বৈষম্য’র দিকে ঠেলে দেওয়া এনজিওর নামে শোষণ: বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের দুর্দশার গল্প মালয়েশিয়ায় ধরা পড়া বাংলাদেশী জঙ্গীরা “বাংলাদেশ ইসলামিক স্টেট” (আইএস)কে অর্থ পাঠাতো: মালয়েশিয়ান আইজিপি টানা বৃষ্টিতে সবজি ও ফসলের অবস্থা: কোন কোন এলাকা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত, বাজারে মূল্যবৃদ্ধি বাংলাদেশে ধর্ষণ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে, প্রশ্নের মুখে রাষ্ট্রের ভূমিকা প্রতিদিন একটি রুমাল (পর্ব-২৬) তারল্য সংকটের নতুন ডোমিনো ও মধ্যবিত্তের দুর্ভাবনা আমেরিকার বাণিজ্য অংশীদারদের জন্য সিদ্ধান্তের সময়

সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির ভবিষ্যৎ কী?

  • Sarakhon Report
  • ০৫:২৯:২৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • 21

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নিবন্ধন করা প্রায় পৌণে চার লাখ মানুষের মধ্যে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার এই কর্মসূচি অব্যাহত রেখে আরও আকর্ষর্ণীয় করার বলেছে। এরপরও পেনশন কর্মসূচি নিয়ে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে না।

নিবন্ধিত অনেকে কিস্তির টাকাও জমা দিচ্ছেন না। গত ছয় মাসে নতুন করে নিবন্ধন করার সংখ্যা উল্লেখ করার মতো নয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানাচ্ছে।

কর্তৃপক্ষ বলছে, এখন প্রচারণার অভাবে আগ্রহ কমেছে।

“ছয় সাত মাস আগে সেই যে প্রথম কিস্তিতে ৫০০ টাকা দিয়েছিলাম, এরপর আর সেখানে কোনো টাকা জমা দেওয়া হয় নাই।”

সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির সমতা স্কিমের আওতায় নিবন্ধন করার বিষয়ে বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন নাসিমা আক্তার নূপুর, যিনি বাংলাদেশের পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার একটি কলেজের প্রভাষক।

“নিবন্ধন করার পর আমাদের কাছে সেরকম কোনো নির্দেশনাও আসেনি। মাঝে একবার শুনছিলাম যে কিস্তি জমা না দিলে জরিমানা দিতে হবে,” তিনি আরও বলেন।

মিজ নূপুরের অন্যান্য সহকর্মীরাও ওই স্কিমের আওতায় নিবন্ধন করেছিলেন এবং তারা কেউ-ই ওই কিস্তি “কন্টিনিউ করছেন না” বলে উল্লেখ করেন তিনি।

তার মতো আরও কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা ওই স্কিমের আওতায় নিবন্ধন করেছিলেন ওপর মহলের চাপে পড়ে।

কারণ প্রতি মাসে টাকা জমা দেওয়ার পর সরকার আদৌ সেই টাকা তাদেরকে সময়মতো ফেরত দিতে পারবে কিনা, সে বিষয়ে তারা সন্দিহান ছিলেন।

সেইসাথে, জুলাই-অগাস্ট মাসের গণঅভ্যুত্থান, চাকরিজীবিদের ব্যয় অনুযায়ী আয় না থাকা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি— চাঁদা জমা দেওয়ার ব্যাপারে তাদের অনীহার পেছনে এগুলোও দায়ী।

এসবের কারণে সরকার পতনের পর নতুন করে নিবন্ধনের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কম।

তবে মানুষদের মাঝে যে টাকা ফেরত না পাওয়ার এবং আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চালু হওয়া এই কর্মসূচি বন্ধ হয়ে যাওয়ার যে এক ভয়, সেটিকে উড়িয়ে দিয়েছে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ।

তারা বলছে, এই পেনশন কর্মসূচি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বন্ধ বা বাতিল তো করছেই না, বরং সরকার এই খাতে আরও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে।

২০২৩ সালে বাংলাদেশে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু হয়েছে, প্রতীকী ছবি
২০২৩ সালে বাংলাদেশে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু হয়েছে, প্রতীকী ছবি

পেনশন স্কিম নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা

জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১৩ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সর্বজনীন পেনশনের চার স্কিমে মোট নিবন্ধন করেছেন তিন লাখ ৭৩ হাজার ৩০৮ জন। আর এখন পর্যন্ত মোট জমা হয়েছে ১৫৭ কোটি ৯১ লাখ ১১ হাজার ৫০০ টাকা।

পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. গোলাম মোস্তফা জানিয়েছেন, গ্রাহকদের বেশিরভাগই সরকার পতনের আগে নিবন্ধন করেছেন। নতুন নিবন্ধনকারীর সংখ্যা আগের তুলনায় কম।

কত কম? সেটি তিনি সুনির্দিষ্টভাবে বলতে না পারলেও জানিয়েছেন, “সরকার পতনের পর নিবন্ধনের হার বেড়েছে, সেটি বলবো না। তবে সরকার পতনের পর নিবন্ধনের গতি কমে গেল।”

“কারণ অনেকের মাঝে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব এলো, স্কিম থাকবে কি থাকবে না। কিন্তু এখন যেহেতু সরকার বলেছে যে স্কিম থাকবে এবং এটিকে আকর্ষণীয় করার উদ্যোগ নেওয়া হবে, সুতরাং আমরা এখন সেভাবেই এগোনোর উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করছি,” ব্যাখ্যা করেন তিনি।

এখন প্রতিদিনই নিবন্ধনকারীর সংখ্যা বাড়ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “তবে মাসে এখন ২০০-৩০০ করে বাড়ে। আমাদের তো আশা ছিল দিনে ৫০০-৮০০ করে বাড়বে।”

নতুন করে নিবন্ধন না করার কারণ হিসেবে তিনি প্রচারণার অভাবের কথা বলেন।

টাকার ছবি
প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা – নামে চারটি স্কিম চালু আছে আপাতত, প্রতীকী ছবি

মো. গোলাম মোস্তফার মতে, “একটি নতুন জিনিস মানুষের মাঝে নিলে তারা দেখতে চাইবে যে এর ফিচারগুলো কী, এটা টেকসই কি না; সেজন্যই প্রচার দরকার হয়। এটি নিয়ে বিশেষভাবে কাজ করছি।”

গণঅভ্যুত্থানের আগে প্রচারণার উদ্দেশ্যে দেশের আট বিভাগের দু’টো বিভাগ, রাজশাহী ও রংপুরে মেলার আয়োজন করেছিলো পেনশন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের কারণে তাতে পুরোপুরিভাবেই ভাটা পড়ে গত জুলাই-অগাস্ট মাসে।

কিন্তু এখন কর্তৃপক্ষ তা কাটিয়ে উঠতে চাইছে। সেজন্যই সরকার পতনের পর এবার প্রথমবারের মতো সিলেটে আরেকটি মেলার আয়োজন করতে যাচ্ছে তারা এবং সেটি রমজানের আগেই।

পাঁচ অগাস্টের আগে আয়োজিত দুই মেলায় ‘ভালো সাড়া’ পেয়েছিলেন জানিয়ে মি. মোস্তফা আরও বলেন, “এখন আমরা আবার সেটিকে বেগবান করতে চাচ্ছি।”

“আমরা বিভাগীয় পর্যায়ক্রমে আগে মেলার আয়োজন করবো। প্রতিটি বিভাগের মেলা হয়ে গেলে পর্যায়ক্রমে সবগুলো জেলা ও উপজেলায়ও একই আয়োজন করবো।”

তিনি জানান, সরকার ইতিমধ্যে বিপিএলের খেলায় বিজ্ঞাপন দিয়েছে। আসন্ন চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতেও বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে। পত্রিকার প্রথম পাতায় অহরহ বিজ্ঞাপন যাচ্ছে। সেইসাথে, টেলিটকের মাধ্যমে ভয়েস মেসেজ পাঠিয়েও প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

প্রচারণার পাশাপাশি পেনশন কর্মসূচিতে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়ার আগে সেগুলো সুনির্দিষ্টভাবে বলাটা কঠিন, বলেন মি. মোস্তফা।

তবে বোঝার সুবিধার্থে তিনি বলেছেন, “পেনশন স্কিমগুলোতে নানা ধরনের বীমা সুবিধা যোগ করা হয়েছে। মানুষ যাতে মনে করে এটা তাদের জন্য কমফোর্ট জোন, সেরকম চেষ্টা করছি।”

বয়স্ক নাগরিকের সংখ্যা সামনে বাড়বে, এই ধারণা থেকে সবাইকে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে আনতে চাইছে সরকার
বয়স্ক নাগরিকের সংখ্যা সামনে বাড়বে, এই ধারণা থেকে সবাইকে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে আনতে চাইছে সরকার

সমস্যা ‘সুবিধায়’ নাকি অন্য কোথাও?

সরকার থেকে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করার জন্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর এবং প্রচারণায় মনোযোগী হওয়ার কথা বলা হলেও ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, “এখানে মূল সমস্যা নিশ্চয়তা, ব্যবস্থাপনা ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে।”

“স্কিমগুলোর যে ডিজাইন যে এত বছর হলে এত টাকা পাবে…সেখানে কোনো সমস্যা নাই। এখানে ইস্যুটা সুযোগ-সুবিধার না।”

“সরকার থেকে যেগুলো অফার করা হয়েছে, সেগুলোর গ্রহণযোগ্যতার অভাব নেই। এখানে ইস্যুটা প্রাতিষ্ঠানিক,” তিনি আবারও উল্লেখ করেন।

ওই ‘সমস্যাগুলো’ ঠিক করা না হলে মানুষ এতে খুব বেশি সাড়া দেবে না বলে মনে করেন তিনি।

তার মতে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে “সরকারের পেনশন অথরিটি এই টাকাগুলো ম্যানেজ করবে। সেই টাকা গ্রাহকরা সময়মতো পাবে কিনা, তার নিশ্চয়তা নেই।”

“আমি যে টাকা দেবো, সেই টাকা পেনশন অথরিটি কীভাবে ম্যানেজ করবে, তার জেনারেল কিছু ধারণা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেটি পরিষ্কার হয়নি।”

“আমি যে টাকা দিচ্ছি, সেটি দিয়ে ট্রেজারি বিল কিনলো। সেটি তো সরকারের কাছেই গেল। সরকার সেই টাকা রেখে দেবে না। সেটি বাজেটে ব্যবহার করবে। তাহলে আমি কীভাবে নিশ্চিত হবো যে যখন আমার পাওয়ার সময় হবে, তখন এই পেনশন অথরিটির কাছে টাকা দেওয়ার মতো সক্ষমতা থাকবে?” প্রশ্ন করেন তিনি।

যেখানে টাকাটা রাখা হচ্ছে, সেটি “কোনো স্বাধীন প্রতিষ্ঠান না” উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, “যদি বলা হতো, ট্রেজারি বিল কিনে যে টাকা সরকার পাচ্ছে, তা বাজেটে যাবে না, তা আলাদাভাবে সংরক্ষিত থাকবে, কোথাও বিনিয়োগ করবে… (তাহলে ঠিক ছিল)।”

“এটি ফুললি ফান্ডেড সিস্টেম হতে হবে। কিন্তু এটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে। সরকারের যখন প্রয়োজন হবে, সে তো এখান থেকে নিতে পারবে টাকা। ওই ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক সিস্টেম থাকবে না কি থাকবে না, এগুলো পরিষ্কার ছিল না। এখনও পরিষ্কার না।”

সেইসাথে, সঞ্চয়পত্র বা ডিপিএসে টাকা রেখে যে মুনাফা আসে, পেনশন স্কিমের টাকা থেকে তার থেকে বেশি মুনাফা আসা প্রয়োজন বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

এবং, “দক্ষ, ফাইন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট বোঝেন; এমন প্রফেশনাল স্টাফদের হাতে পেনশন স্কিমের টাকা পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া উচিত” বলেও মনে করেন তিনি।

পেনশন স্কিম বয়স্ক মানুষদের উপকারে আসবে বলে মনে করে সরকার
পেনশন স্কিম বয়স্ক মানুষদের উপকারে আসবে বলে মনে করে সরকার

তবে গ্রাহকদের মনে চলমান ওই শঙ্কা ও এবং অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণের বিষয়ে পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. গোলাম মোস্তফা বলেন, “এটি যেহেতু সরকারের প্রোগ্রাম, এখানে অনিশ্চয়তার কিছু নাই। গ্রাহকরা সময়মতো টাকা পাবে।”

“জনগণ যে টাকা দেয়, তা একটি ডেডিকেটেড ফান্ডে থাকে। সেটি শুধু বিনিয়োগ করা যায়। মেয়াদ শেষ হলে তখন পেনশন দেওয়া যাবে। অন্য কোনো পারপাসে ওই টাকা ব্যয় করা যায় না। এই স্কিমগুলোর পরিচলন ব্যয় শূন্য। কারণ এর পুরোটাই দেয় সরকার।”

“আর অ্যাকাউন্ট এমনভাবে খোলা যে যিনি খুলেছেন, তিনি যেকোনো সময় তার অ্যাকাউন্ট চেক করতে পারেন। বছর শেষে কত লাভ, সেটিও দেখতে পাবেন। এখানে সবকিছু স্বচ্ছ; বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বিষয় নাই। এখানে কোনো সন্দেহ-দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কারণ নাই,” তিনি যোগ করেন।

তিনি জানান, এ যাবত ১৫৭ কোটি টাকা পেলেও বিনিয়োগ করা হয়েছে প্রায় ১৬৪ কোটি টাকা।

“লাভের যে টাকা, সেটিকেও বিনিয়োগ করেছি আমরা। এইজন্য জমার চেয়ে বিনিয়োগ বেশি।”

এছাড়া, সঞ্চয়পত্রের সাথে পেনশন স্কিমের তুলনাটা অনুচিত জানিয়ে তিনি বলেন,

“যেহেতু এই ফান্ডের পরিচালন ব্যয় শূন্য, তাই এই ফান্ডের চেয়ে বেশি রিটার্ন অন্য কোনো জায়গা থেকেই পাওয়ার কথা না। আর সঞ্চয়পত্রের চেয়ে এটার পার্থক্য আছে।”

“আপনার হাতে নূন্যতম এক লাখ টাকা থাকলে আপনি সঞ্চয়পত্র কিনতে পারবেন। কিন্তু এখানে ৫০০ টাকা জমা দিয়েও এখানে আসা যাচ্ছে। এটি ক্ষুদ্র সঞ্চয় থেকে ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা।”

আগামী ১৭ই ফেব্রুয়ারি দেশে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির দেড় বছর পূর্ণ হবে।

২০২৩ সালের ১৭ই অগাস্ট সমতা, সুরক্ষা, প্রগতি ও প্রবাস— এই চারটি স্কিমের নিবন্ধনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে এর কার্যক্রম শুরু হয়।

মি. মোস্তাফা জানিয়েছেন, “আপাতত এই চারটি স্কিম-ই থাকবে। পরবর্তীতে সরকার যদি কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়, সেক্ষেত্রে আবার নতুন কোনো স্কিম চালু হবে।”

বিবিসি বাংলা

চেকিয়ার জাতীয় ব্ল্যাকআউট: তদন্তে নেমেছে কর্তৃপক্ষ

সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির ভবিষ্যৎ কী?

০৫:২৯:২৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নিবন্ধন করা প্রায় পৌণে চার লাখ মানুষের মধ্যে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার এই কর্মসূচি অব্যাহত রেখে আরও আকর্ষর্ণীয় করার বলেছে। এরপরও পেনশন কর্মসূচি নিয়ে মানুষের আগ্রহ বাড়ছে না।

নিবন্ধিত অনেকে কিস্তির টাকাও জমা দিচ্ছেন না। গত ছয় মাসে নতুন করে নিবন্ধন করার সংখ্যা উল্লেখ করার মতো নয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানাচ্ছে।

কর্তৃপক্ষ বলছে, এখন প্রচারণার অভাবে আগ্রহ কমেছে।

“ছয় সাত মাস আগে সেই যে প্রথম কিস্তিতে ৫০০ টাকা দিয়েছিলাম, এরপর আর সেখানে কোনো টাকা জমা দেওয়া হয় নাই।”

সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির সমতা স্কিমের আওতায় নিবন্ধন করার বিষয়ে বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন নাসিমা আক্তার নূপুর, যিনি বাংলাদেশের পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার একটি কলেজের প্রভাষক।

“নিবন্ধন করার পর আমাদের কাছে সেরকম কোনো নির্দেশনাও আসেনি। মাঝে একবার শুনছিলাম যে কিস্তি জমা না দিলে জরিমানা দিতে হবে,” তিনি আরও বলেন।

মিজ নূপুরের অন্যান্য সহকর্মীরাও ওই স্কিমের আওতায় নিবন্ধন করেছিলেন এবং তারা কেউ-ই ওই কিস্তি “কন্টিনিউ করছেন না” বলে উল্লেখ করেন তিনি।

তার মতো আরও কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, তারা ওই স্কিমের আওতায় নিবন্ধন করেছিলেন ওপর মহলের চাপে পড়ে।

কারণ প্রতি মাসে টাকা জমা দেওয়ার পর সরকার আদৌ সেই টাকা তাদেরকে সময়মতো ফেরত দিতে পারবে কিনা, সে বিষয়ে তারা সন্দিহান ছিলেন।

সেইসাথে, জুলাই-অগাস্ট মাসের গণঅভ্যুত্থান, চাকরিজীবিদের ব্যয় অনুযায়ী আয় না থাকা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি— চাঁদা জমা দেওয়ার ব্যাপারে তাদের অনীহার পেছনে এগুলোও দায়ী।

এসবের কারণে সরকার পতনের পর নতুন করে নিবন্ধনের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কম।

তবে মানুষদের মাঝে যে টাকা ফেরত না পাওয়ার এবং আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চালু হওয়া এই কর্মসূচি বন্ধ হয়ে যাওয়ার যে এক ভয়, সেটিকে উড়িয়ে দিয়েছে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ।

তারা বলছে, এই পেনশন কর্মসূচি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বন্ধ বা বাতিল তো করছেই না, বরং সরকার এই খাতে আরও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে।

২০২৩ সালে বাংলাদেশে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু হয়েছে, প্রতীকী ছবি
২০২৩ সালে বাংলাদেশে সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু হয়েছে, প্রতীকী ছবি

পেনশন স্কিম নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা

জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ১৩ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সর্বজনীন পেনশনের চার স্কিমে মোট নিবন্ধন করেছেন তিন লাখ ৭৩ হাজার ৩০৮ জন। আর এখন পর্যন্ত মোট জমা হয়েছে ১৫৭ কোটি ৯১ লাখ ১১ হাজার ৫০০ টাকা।

পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. গোলাম মোস্তফা জানিয়েছেন, গ্রাহকদের বেশিরভাগই সরকার পতনের আগে নিবন্ধন করেছেন। নতুন নিবন্ধনকারীর সংখ্যা আগের তুলনায় কম।

কত কম? সেটি তিনি সুনির্দিষ্টভাবে বলতে না পারলেও জানিয়েছেন, “সরকার পতনের পর নিবন্ধনের হার বেড়েছে, সেটি বলবো না। তবে সরকার পতনের পর নিবন্ধনের গতি কমে গেল।”

“কারণ অনেকের মাঝে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব এলো, স্কিম থাকবে কি থাকবে না। কিন্তু এখন যেহেতু সরকার বলেছে যে স্কিম থাকবে এবং এটিকে আকর্ষণীয় করার উদ্যোগ নেওয়া হবে, সুতরাং আমরা এখন সেভাবেই এগোনোর উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করছি,” ব্যাখ্যা করেন তিনি।

এখন প্রতিদিনই নিবন্ধনকারীর সংখ্যা বাড়ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “তবে মাসে এখন ২০০-৩০০ করে বাড়ে। আমাদের তো আশা ছিল দিনে ৫০০-৮০০ করে বাড়বে।”

নতুন করে নিবন্ধন না করার কারণ হিসেবে তিনি প্রচারণার অভাবের কথা বলেন।

টাকার ছবি
প্রবাস, প্রগতি, সুরক্ষা ও সমতা – নামে চারটি স্কিম চালু আছে আপাতত, প্রতীকী ছবি

মো. গোলাম মোস্তফার মতে, “একটি নতুন জিনিস মানুষের মাঝে নিলে তারা দেখতে চাইবে যে এর ফিচারগুলো কী, এটা টেকসই কি না; সেজন্যই প্রচার দরকার হয়। এটি নিয়ে বিশেষভাবে কাজ করছি।”

গণঅভ্যুত্থানের আগে প্রচারণার উদ্দেশ্যে দেশের আট বিভাগের দু’টো বিভাগ, রাজশাহী ও রংপুরে মেলার আয়োজন করেছিলো পেনশন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের কারণে তাতে পুরোপুরিভাবেই ভাটা পড়ে গত জুলাই-অগাস্ট মাসে।

কিন্তু এখন কর্তৃপক্ষ তা কাটিয়ে উঠতে চাইছে। সেজন্যই সরকার পতনের পর এবার প্রথমবারের মতো সিলেটে আরেকটি মেলার আয়োজন করতে যাচ্ছে তারা এবং সেটি রমজানের আগেই।

পাঁচ অগাস্টের আগে আয়োজিত দুই মেলায় ‘ভালো সাড়া’ পেয়েছিলেন জানিয়ে মি. মোস্তফা আরও বলেন, “এখন আমরা আবার সেটিকে বেগবান করতে চাচ্ছি।”

“আমরা বিভাগীয় পর্যায়ক্রমে আগে মেলার আয়োজন করবো। প্রতিটি বিভাগের মেলা হয়ে গেলে পর্যায়ক্রমে সবগুলো জেলা ও উপজেলায়ও একই আয়োজন করবো।”

তিনি জানান, সরকার ইতিমধ্যে বিপিএলের খেলায় বিজ্ঞাপন দিয়েছে। আসন্ন চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতেও বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে। পত্রিকার প্রথম পাতায় অহরহ বিজ্ঞাপন যাচ্ছে। সেইসাথে, টেলিটকের মাধ্যমে ভয়েস মেসেজ পাঠিয়েও প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

প্রচারণার পাশাপাশি পেনশন কর্মসূচিতে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়ার আগে সেগুলো সুনির্দিষ্টভাবে বলাটা কঠিন, বলেন মি. মোস্তফা।

তবে বোঝার সুবিধার্থে তিনি বলেছেন, “পেনশন স্কিমগুলোতে নানা ধরনের বীমা সুবিধা যোগ করা হয়েছে। মানুষ যাতে মনে করে এটা তাদের জন্য কমফোর্ট জোন, সেরকম চেষ্টা করছি।”

বয়স্ক নাগরিকের সংখ্যা সামনে বাড়বে, এই ধারণা থেকে সবাইকে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে আনতে চাইছে সরকার
বয়স্ক নাগরিকের সংখ্যা সামনে বাড়বে, এই ধারণা থেকে সবাইকে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে আনতে চাইছে সরকার

সমস্যা ‘সুবিধায়’ নাকি অন্য কোথাও?

সরকার থেকে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করার জন্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর এবং প্রচারণায় মনোযোগী হওয়ার কথা বলা হলেও ঢাকায় বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, “এখানে মূল সমস্যা নিশ্চয়তা, ব্যবস্থাপনা ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে।”

“স্কিমগুলোর যে ডিজাইন যে এত বছর হলে এত টাকা পাবে…সেখানে কোনো সমস্যা নাই। এখানে ইস্যুটা সুযোগ-সুবিধার না।”

“সরকার থেকে যেগুলো অফার করা হয়েছে, সেগুলোর গ্রহণযোগ্যতার অভাব নেই। এখানে ইস্যুটা প্রাতিষ্ঠানিক,” তিনি আবারও উল্লেখ করেন।

ওই ‘সমস্যাগুলো’ ঠিক করা না হলে মানুষ এতে খুব বেশি সাড়া দেবে না বলে মনে করেন তিনি।

তার মতে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে “সরকারের পেনশন অথরিটি এই টাকাগুলো ম্যানেজ করবে। সেই টাকা গ্রাহকরা সময়মতো পাবে কিনা, তার নিশ্চয়তা নেই।”

“আমি যে টাকা দেবো, সেই টাকা পেনশন অথরিটি কীভাবে ম্যানেজ করবে, তার জেনারেল কিছু ধারণা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেটি পরিষ্কার হয়নি।”

“আমি যে টাকা দিচ্ছি, সেটি দিয়ে ট্রেজারি বিল কিনলো। সেটি তো সরকারের কাছেই গেল। সরকার সেই টাকা রেখে দেবে না। সেটি বাজেটে ব্যবহার করবে। তাহলে আমি কীভাবে নিশ্চিত হবো যে যখন আমার পাওয়ার সময় হবে, তখন এই পেনশন অথরিটির কাছে টাকা দেওয়ার মতো সক্ষমতা থাকবে?” প্রশ্ন করেন তিনি।

যেখানে টাকাটা রাখা হচ্ছে, সেটি “কোনো স্বাধীন প্রতিষ্ঠান না” উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, “যদি বলা হতো, ট্রেজারি বিল কিনে যে টাকা সরকার পাচ্ছে, তা বাজেটে যাবে না, তা আলাদাভাবে সংরক্ষিত থাকবে, কোথাও বিনিয়োগ করবে… (তাহলে ঠিক ছিল)।”

“এটি ফুললি ফান্ডেড সিস্টেম হতে হবে। কিন্তু এটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে। সরকারের যখন প্রয়োজন হবে, সে তো এখান থেকে নিতে পারবে টাকা। ওই ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক সিস্টেম থাকবে না কি থাকবে না, এগুলো পরিষ্কার ছিল না। এখনও পরিষ্কার না।”

সেইসাথে, সঞ্চয়পত্র বা ডিপিএসে টাকা রেখে যে মুনাফা আসে, পেনশন স্কিমের টাকা থেকে তার থেকে বেশি মুনাফা আসা প্রয়োজন বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

এবং, “দক্ষ, ফাইন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট বোঝেন; এমন প্রফেশনাল স্টাফদের হাতে পেনশন স্কিমের টাকা পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া উচিত” বলেও মনে করেন তিনি।

পেনশন স্কিম বয়স্ক মানুষদের উপকারে আসবে বলে মনে করে সরকার
পেনশন স্কিম বয়স্ক মানুষদের উপকারে আসবে বলে মনে করে সরকার

তবে গ্রাহকদের মনে চলমান ওই শঙ্কা ও এবং অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণের বিষয়ে পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য মো. গোলাম মোস্তফা বলেন, “এটি যেহেতু সরকারের প্রোগ্রাম, এখানে অনিশ্চয়তার কিছু নাই। গ্রাহকরা সময়মতো টাকা পাবে।”

“জনগণ যে টাকা দেয়, তা একটি ডেডিকেটেড ফান্ডে থাকে। সেটি শুধু বিনিয়োগ করা যায়। মেয়াদ শেষ হলে তখন পেনশন দেওয়া যাবে। অন্য কোনো পারপাসে ওই টাকা ব্যয় করা যায় না। এই স্কিমগুলোর পরিচলন ব্যয় শূন্য। কারণ এর পুরোটাই দেয় সরকার।”

“আর অ্যাকাউন্ট এমনভাবে খোলা যে যিনি খুলেছেন, তিনি যেকোনো সময় তার অ্যাকাউন্ট চেক করতে পারেন। বছর শেষে কত লাভ, সেটিও দেখতে পাবেন। এখানে সবকিছু স্বচ্ছ; বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বিষয় নাই। এখানে কোনো সন্দেহ-দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কারণ নাই,” তিনি যোগ করেন।

তিনি জানান, এ যাবত ১৫৭ কোটি টাকা পেলেও বিনিয়োগ করা হয়েছে প্রায় ১৬৪ কোটি টাকা।

“লাভের যে টাকা, সেটিকেও বিনিয়োগ করেছি আমরা। এইজন্য জমার চেয়ে বিনিয়োগ বেশি।”

এছাড়া, সঞ্চয়পত্রের সাথে পেনশন স্কিমের তুলনাটা অনুচিত জানিয়ে তিনি বলেন,

“যেহেতু এই ফান্ডের পরিচালন ব্যয় শূন্য, তাই এই ফান্ডের চেয়ে বেশি রিটার্ন অন্য কোনো জায়গা থেকেই পাওয়ার কথা না। আর সঞ্চয়পত্রের চেয়ে এটার পার্থক্য আছে।”

“আপনার হাতে নূন্যতম এক লাখ টাকা থাকলে আপনি সঞ্চয়পত্র কিনতে পারবেন। কিন্তু এখানে ৫০০ টাকা জমা দিয়েও এখানে আসা যাচ্ছে। এটি ক্ষুদ্র সঞ্চয় থেকে ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা।”

আগামী ১৭ই ফেব্রুয়ারি দেশে সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির দেড় বছর পূর্ণ হবে।

২০২৩ সালের ১৭ই অগাস্ট সমতা, সুরক্ষা, প্রগতি ও প্রবাস— এই চারটি স্কিমের নিবন্ধনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে এর কার্যক্রম শুরু হয়।

মি. মোস্তাফা জানিয়েছেন, “আপাতত এই চারটি স্কিম-ই থাকবে। পরবর্তীতে সরকার যদি কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়, সেক্ষেত্রে আবার নতুন কোনো স্কিম চালু হবে।”

বিবিসি বাংলা