বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে সমতলের প্রান্তিক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায় পর্যন্ত বহু এনজিও—দেশি ও বিদেশি—বড় বড় সাইনবোর্ড টাঙিয়ে “উন্নয়ন” আর “ক্ষমতায়ন”-এর স্বপ্ন দেখিয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তাদের একাংশই সেই স্বপ্নভঙ্গের মূল কুশীলব।
এই লেখায় আমরা খুঁটিয়ে দেখব,কীভাবে কিছু এনজিও-সংগঠক ও সুবিধাভোগী গোষ্ঠী “সহযোগিতা” বা “উন্নয়ন”-এর নামে আদিবাসী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষকে শোষণ করছে।
কথিত উন্নয়ন প্রকল্পের ফাঁদ
বেশ কিছু এনজিও, বিশেষ করে বিদেশি অনুদান-নির্ভর প্রকল্প চালায় যেগুলোর লক্ষ্য হিসেবে লেখা থাকে—
• “আদিবাসী নারী শিক্ষা উন্নয়ন”
• “প্রাকৃতিক সম্পদে অধিকার প্রতিষ্ঠা”
• “ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ”
কিন্তু দেখা যায়, অনুদান আসে কোটি কোটি টাকা, অথচ—
• প্রকল্পের বেশিরভাগ বাজেট ঢাকার অফিস, বিদেশ ভ্রমণ, সেমিনার ও প্রশাসনিক খরচে যায়
• মাঠপর্যায়ে গিয়ে ঠেকে দু-একটি নামকাওয়াস্তে কর্মশালা আর কিছু ফ্লেক্স-পোস্টারে
• আদিবাসী গ্রামের মানুষকে বলা হয়, “এই ফর্মে সই করলেই টাকাটা আসবে,” কিন্তু বড় অংশ চলে যায় অন্যের পকেটে
বিনা মূল্যের শ্রম ও তথ্য নেওয়া
অনেক এনজিও গবেষণা ও জরিপের নামে—
• ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের কাছ থেকে ঐতিহ্য, ঔষধি গাছ ও লোকজ জ্ঞান বিনা মূল্যে সংগ্রহ করে
• পরে বিদেশি জার্নালে লিখে গবেষক ও এনজিও কর্মকর্তারা খ্যাতি পান, প্রকল্প পায় আরও তহবিল
• অথচ যাদের থেকে এই জ্ঞান নেওয়া হয়, তাদের জন্য কোনো স্বীকৃতি বা অর্থপ্রদানের ব্যবস্থা থাকে না
জমি অধিগ্রহণে সুবিধা করা
কিছু প্রকল্পে অভিযোগ ওঠে—
• বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে মিলে বনায়ন বা ইকোটুরিজমের নামে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জমি অধিগ্রহণে সহায়তা করা হয়
• বলা হয় “টেকসই উন্নয়ন,” “কমিউনিটি-ভিত্তিক ট্যুরিজম”
• কিন্তু স্থানীয়রা উচ্ছেদ হন বা নামমাত্র মজুরি পান; নিয়ন্ত্রণ থাকে এনজিও ও বিনিয়োগকারীর হাতে
সাংস্কৃতিক শোষণ
- কিছু এনজিও স্থানীয় ভাষা,পোশাক, গান-নাচ নিয়ে আন্তর্জাতিক ফেস্টিভালে শো করে
• স্থানীয় শিল্পীদের নাম উল্লেখ বা পারিশ্রমিক দেয় না
• গ্রামীণ নারী-পুরুষকে “মডেল” বানিয়ে ভিডিও তুলে বিদেশে অনুদান তোলে
• কিন্তু ওই গ্রামের মানুষের জন্য স্থায়ী আয় বা পেশাগত উন্নয়ন গড়ে ওঠে না
রাজনৈতিক প্রভাব ও বিভাজন
- এনজিও অনেক সময় এক গ্রামের ভেতর দলাদলি বাধায়—কারা প্রকল্প পাবে,কারা পাবে না
• স্থানীয় নেতাদের দিয়ে দালালি করিয়ে প্রভাব খাটায়
• প্রকল্প শেষে সেই দ্বন্দ্ব আর ভাঙা সামাজিক সম্পর্ক থেকেই যায়
নারীর ক্ষমতায়নের নামে নিয়ন্ত্রণ
- “নারীর ক্ষমতায়ন”প্রকল্পে স্থানীয় নারী নেত্রীদের প্রতীকীভাবে ব্যবহার করা হয়
•বাইরে বলা হয়, “নারী নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে”
• আসলে পরিকল্পনা, বাজেট ও সিদ্ধান্ত থাকে ঢাকায় কিংবা বিদেশি দাতাদের হাতে
প্রকল্পের টেকসইতা নেই
- প্রকল্প চলাকালে সামান্য সুযোগ-সুবিধা—চালের বস্তা,ক্ষুদ্রঋণ—দেওয়া হয়
• প্রকল্প শেষ হলে আর কিছু থাকে না
• অনুদান শেষ মানেই ‘উন্নয়ন’-এর সমাপ্তি
দায়বদ্ধতার অভাব
- প্রকল্পের ফলাফল মূল্যায়ন করে এনজিও নিজেই
•ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের কাছে কোনো জবাবদিহি থাকে না
• সরকারের নজরদারি দুর্বল; স্থানীয় প্রশাসনও অনেক সময় সুবিধাভোগী
কিছু বাস্তব উদাহরণ
- পার্বত্য চট্টগ্রামে বেসরকারি“শান্তি-গঠন” প্রকল্প চালিয়ে ত্রাণ বিতরণের ছবি তুলে বহু এনজিও তহবিল তুলেছে
• উত্তরবঙ্গের সাঁওতাল এলাকায় ল্যান্ড-রাইটস প্রকল্পে তথ্য নিয়েও ভূমি-সংগ্রামের পাশে দাঁড়ায়নি
• ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনায় গারো নারী উদ্যোক্তা প্রকল্পের অর্থ ঢাকার এনজিও-র প্রশাসনে খরচ হয়েছে
সমাধানের দিক
- স্থানীয় নেতৃত্ব ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা
•প্রকল্প বাজেটের স্বচ্ছতা আনতে বাধ্য করা
• এনজিওর কাজে সরকারি ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর যৌথ নজরদারি
• ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক সম্পদের বাণিজ্যিক ব্যবহারে ন্যায্য অংশ নিশ্চিত করা
সব এনজিও খারাপ নয়; অনেক সৎ ও নিবেদিত সংস্থা সত্যিই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য কাজ করে। তবু “উন্নয়ন” এখন বড় এক ইন্ডাস্ট্রি, যেখানে একাংশ এনজিও মানুষকে প্রকৃত অর্থে ক্ষমতায়িত না করে শোষণ করে চলছে।
বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের জন্য প্রয়োজন তাদের মতামত, সম্মান এবং অধিকারকে সর্বাগ্রে রাখা। উন্নয়নের নামে শোষণের এই চক্র বন্ধ করতে হবে এখনই।