বাংলা বাণিজ্যিক সিনেমার ইতিহাসে হুট করে ঝলসে ওঠা উজ্জ্বল এক নক্ষত্রের নাম সালমান শাহ। নব্বই দশকের শুরুর রোমান্টিক পোস্টারগুলোয় যাঁর তীক্ষ্ণ চাহনি ও স্টাইলিশ ফ্যাশন তরুণদের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল, তাঁর আসল পরিচয় শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন। মাত্র চার বছরের কর্মজীবন, অথচ প্রায় তিন ডজন ছবি, অব্যাহত ব্লকবাস্টার আর আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তার গল্প আজও চলচ্চিত্র–অনুরাগীদের অদম্য কৌতূহলের খোরাক হয়ে আছে।
প্রথম দৃশ্য: জকিগঞ্জের শান্ত সকাল
১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর, সিলেটের জকিগঞ্জে জন্ম নিলেন এক সংস্কৃতি–মোহিত কিশোর। বাড়ির সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলেই গানে, নাচে, অভিনয়ে হাতেখড়ি। উচ্চমাধ্যমিকের পড়াশোনার জন্য ঢাকায় পা রেখেই শুরু টেলিভিশন নাট্যযাত্রা—‘পাথর সময়’ আর ‘আজ রবিবার’-এর মতো জনপ্রিয় ধারাবাহিকে উপস্থিতি দর্শকের চোখে এক নতুন সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলে।
রোমান্টিক হাওয়া: ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’
১৯৯৩—পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান মৌসুমীর বিপরীতে এক ঝকঝকে মুখ খুঁজছিলেন। নাম বদলে সালমান শাহ। মুক্তির দিন থেকেই ছবির টিকিট কাউন্টারে লাইন, অডিও ক্যাসেটে ‘একটি গোলাপ তুমি’ সুপারহিট, আর সারাদেশে নতুন এক ফ্যাশন আইকন। সমালোচকেরা বললেন, “বাংলা ছবিতে শহুরে প্রেম এখনই নিজের ভাষা পেল।”
চার বছরে তিন ডজন: ব্যস্ততার দৌড়
‘তোমাকে চাই’,‘স্বপ্নের ঠিকানা’,‘অন্তরে অন্তরে’, ‘সত্যের মৃত্যু নেই’, ‘প্রিয়জন’—প্রতিবছর গড়ে ছয়–সাতটি ছবি। শুটিং থেকে শুটিং, লোকেশনে রাত–দিন; চাহিদার চাপে গল্পবদলের ফুরসত নেই। তবু তরুণ দর্শকের কাছে পুনরাবৃত্তি নয়, বরং প্রত্যাশিত বিনোদন। প্রযোজকেরা হিসাব কষে দেখেন—একটি সালমান শাহ ছবির গড় আয় তখনকার বাজারদরে ৬০ লাখ থেকে এক কোটি টাকা।
স্টাইল থ্রু দ্য ক্যামেরা
পোশাকে জিনস–টার্টল নেক, কানে ছোট দুল, চুলে লেয়ার কাট—নায়কের স্টাইল তখন তরুণদের পোশাকের ‘রেডিমেড’ ফর্মুলা। রাজধানীর সেলুনগুলোয় “সালমান কাট” লিখে পোস্টার ঝোলানো হয়; এলিফ্যান্ট রোডের গার্মেন্টস শো–রুম বিজ্ঞাপনে বলে, “সালমান–ব্র্যান্ড জ্যাকেট এখন বাজারে।” সমালোচকের ব্যাখ্যা, বাংলা ছবির ‘মডার্ন হিরো’–ধারণা এখান থেকেই মূল ধারা পায়।
আলোচনার অপর পিঠ
ব্যস্ততার ফাঁদে পড়ে একই ধরনের রোমান্টিক গল্পের পুনরাবৃত্তি ছিল অস্বীকার্য। ছবির চিত্রনাট্যে গভীরতার অভাব, আবেগী দৃশ্যে অতিনাটকীয়তা—এসব অভিযোগ সমালোচক স্তরে ঘুরে বেড়ালেও বাণিজ্যিক সাফল্যে ফাটল ধরেনি। চলচ্চিত্র গবেষক দীপু চক্রবর্তী বলেন, “চরিত্রের পরিসর সীমিত ছিল, তবে কম সময়ে যেভাবে দর্শকের মন ভালোবাসা পেয়েছেন, তা বিরল উদাহরণ।”
রহস্যে মোড়া প্রস্থান
১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর, ঢাকার ইস্কাটনের বাসা থেকে তাঁর মৃত্যুর খবর প্রকাশ্যে আসে। পুলিশ প্রাথমিকভাবে আত্মহত্যার কথা জানালেও পরিবার পরিকল্পিত হত্যা সন্দেহে মামলা করে। প্রায় তিন দশক পার হলেও তদন্ত–ফাইল আজও শেষ পাতায় পৌঁছায়নি; সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে নতুন নতুন তত্ত্ব ফের আলো জ্বেলে দেয়। ওই দিন সন্ধ্যায় এফডিসিতে শিল্পী সংঘের মিলনায়তন ভেঙে পড়ে কান্নায়, সারাদেশে ফ্যান ক্লাব মশাল মিছিল করে শোক জানায়।
উত্তরাধিকার: ভক্ত–সংস্কৃতির জোয়ার
- স্টাইল আইকন: নবীন নায়ক শাকিব খান থেকে সাম্প্রতিক সিয়াম আহমেদ—শহুরে রোমান্টিক ভাবমূর্তির ছায়ায় তাঁরা সালমান শাহকে মনে করেন অগ্রপথিক।
- রোমান্টিক চিত্রনাট্যের চাহিদা: প্রযোজকেরা দর্শক জরিপে খুঁজে পান—‘নব্বই দশকের প্রেম’ এখনো বিক্রি হয়।
- ডিজিটাল স্মৃতি: ইউটিউবে তাঁর গানের ভিউ কোটি ছাড়ায়; প্রতি ৬ সেপ্টেম্বর ভক্তেরা #RememberingSalmanShah হ্যাশট্যাগে স্মরণ করে।
লেখচিত্রের শেষ বাক্য
ক্যারিয়ার মাত্র চার বছর, সেলুলয়েডে স্থায়ী ছাপ অগণিত দৃশ্যে—কনভেয়র বেল্টে ফ্যাক্টরি–ফিল্মের বাজারেও সালমান শাহ তখন ‘তারকা’ নয়, ‘উদ্দীপনা’। চলচ্চিত্রবোদ্ধা অনুপম হায়াতের কথায়, “এত অল্প সময়ে যদি তিনি এতটুকু আলো ছড়াতে পারেন, দীর্ঘ যাত্রায় তাঁর সম্ভাবনার পরিধি মাপা অসম্ভব ছিল।”
আজও নতুন নায়কের আত্মপ্রকাশে দর্শক জিজ্ঞেস করে, “এই ছেলেটি কি নতুন সালমান শাহ হতে পারবে?”—চলচ্চিত্রবিশ্বের এ প্রশ্নই প্রমাণ, রুপালি রূপকথার সেই নায়ক অন্তর্জালে নয়, দর্শকের স্মৃতিতে চিরজাগরূক এক স্বপ্নপুরুষ।