চট্টগ্রামের বুকে শ্বাস ফেলা কর্ণফুলী নদী একাধারে বাণিজ্য-নদী, প্রাণের জলপথ ও সংস্কৃতির অবিরাম স্রোত। মিজোরামের পাহাড়ি অরণ্য থেকে নেমে এসে দুই শতকের বেশি সময় ধরে এই নদী গড়ে তুলেছে বন্দরনগরীর অর্থনীতি, জনপদ, বন–জঙ্গল ও লোকজ কাব্য। আজ নদীর তলে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম সাবমেরিন সড়ক টানেল চালু—নতুন সম্ভাবনার দরজা খুললেও নদীর স্বরূপ রক্ষা করাই আসল চ্যালেঞ্জ।
নদীর জন্মকথা ও প্রাথমিক সভ্যতা
মিজোরামের লুসাই পাহাড় ঘেরা অরণ্যে কর্ণফুলীর স্রোত শৈশব পার করে খাগড়াছড়ি–রাঙামাটির গিরি–বাঁকে তরঙ্গ তোলে, শেষে চট্টগ্রামের পলিমাটিতে প্রবেশ করে বাঙালি জীবনযাত্রার সঙ্গে মিশে যায়। শত শত বছর আগে আরাকানিস, রাখাইন, চাকমা-তঞ্চঙ্গ্যা প্রভৃতি পাহাড়ি জনগোষ্ঠী বাঁশের ভেলা ভাসিয়ে লবণ, মোম, সুতার বালতি আর ফল-মূল নিয়ে এই নদী বেয়ে সমতলে নেমেছেন। নদীর ধার ঘেঁষে গড়ে ওঠা বাজারগুলোই ছিল উপনিবেশ-পূর্ব ‘রোড-হেড’—যেখান থেকে পাহাড়ি মৌসুমি পণ্য সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ত।
ঔপনিবেশিক বাণিজ্যের নীল নকশা
ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি চা-কাঠ-লবণ রপ্তানির ‘সাপ্লাই লাইফলাইন’ হিসেবে ১৮ শতকের শেষ ভাগে কর্ণফুলীকে কৌশলগত নৌপথে রূপ দেয়। ১৮৮৭-এর আধুনিক চট্টগ্রাম বন্দর গড়ে ওঠার অনেক আগে থেকেই নদীর দক্ষিণ মোহনা পতেঙ্গা ঘেঁষে জেটি-গুদাম-গভীরজল পয়েন্ট তৈরির কাজ চলছিল। ব্রিটিশ নাবিকদের নথি বলছে, ‘কর্ণাফলি’ বা ‘কার্নেফুলি’ ছিল একমাত্র নদী, যেখানে এক হাজার টন ওজনের ট্রাম্প স্টিমার ভিড়তে পারত। সেই স্রোতে কাঠের ভেলা, চা-পাতা আর বোম্বের রঙিন সুতা—সব পণ্যই জাহাজে উঠত-নামত।
কাপ্তাই বাঁধ, বিদ্যুৎ ও জনপদ-পাল্টানো গল্প
১৯৬২ সালে কাপ্তাই হ্রদ সৃষ্টির জন্য কর্ণফুলীর ওপর বাঁধ তোলা হলে ৫৪,০০০ একরের বেশি ভূমি জলমগ্ন হয়, বাস্তুচ্যুত হন প্রায় এক লাখ আদিবাসী। হ্রদের জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র চট্টগ্রামের গ্রিডে আলো জ্বালালেও বন-জঙ্গল হারানোর বেদনা পাহাড়ে আজও প্রজন্ম ধরে বয়ে চলেছে। বাঁধ-পরবর্তী নৌ-যোগাযোগ পাল্টে যায়—করুণ স্রোত আর বুকে ঢেউয়ের ঢাকায় খেয়া-স্টিমারের যুগ হারিয়ে দেয়ালঘেরা হ্রদ ও সেতু-নির্ভর সড়কপথের যুগ শুরু হয়।
কর্ণফুলীর পাড়ে শহর-গ্রামের রূপান্তর
বন্দরপাড়ের তুফানিয়া স্ট্রিট, কোতোয়ালি, আগ্রাবাদ—অন্য পারে আনোয়ারা, কর্ণফুলী উপজেলা, শিকলবাহা—সব জনপদ নদীর জোয়ার-ভাটায় গড়ে উঠেছে। প্রত্যেক গ্রামের মহাল-খেয়াঘাট বাজারে সূর্য ওঠা-পড়ার শব্দও নদীপথের সাঁই-সাঁই করে ছুটে আসা কাঠ-লবণ-মাছভরা ডিঙির সঙ্গে মিশে থাকে। আজ ব্রিজ-ফ্লাইওভারের ভিড়েও নৌকার ঘণ্টি-বাঁশির সুর ফুরায়নি; শীতের ভোরে ইছানগর ঘাটে আজও চোখে পড়ে শস্য-লবণ-বোঝাই ট্রলার ঢোকার দৃশ্য।
হারিয়ে যাওয়া বন ও ফিরতে চাওয়া বন্যপ্রাণ
কর্ণফুলীর অববাহিকায় একসময় ছিল শাল-গর্জন-চাম্বল-বাঁশের গভীর জঙ্গল; হুল দুলিয়ে ফিরত হাতি, চিতল, বন-বিড়াল আর অসংখ্য টিয়া-মনা-শামুকখোল। শিল্পাঞ্চল ও আবাসন বাড়তে বাড়তে রাউজান-শিকলবাহায় বনভূমি আজ সংকুচিত। তবু মধুমতী ও শঙ্খের সঙ্গে কর্ণফুলীর সঙ্গমস্থলে এখনও ডলফিন (ইরাবতী) দেখা যায়; বর্ষাকালে চা-বাগানঘেরা ঢেউয়ে পাখির কলকাকলি বন-স্মৃতির জানান দেয়।
জলে ভেসে ওঠা স্বাদে-গন্ধে কর্ণফুলীর মাছ
জনশ্রুতি আছে—শীতকালে নদীর ‘বাশমুখ’ অঞ্চলে ত্বরিত স্রোতে ওঠা বোয়াল-আইর কেটে ভাত, সিদ্ধ কুলচা বা মেজবান গরুর মাংস যে-কোনও রান্নাকে হার মানায়। ডুগডুগি-টিলার কাছে আগে শোল-গজার, কাঁকড়া, রূপালি পুঁটি-চিংড়িতে ভরা দিনের ভাঁজ; আজ নোনা জলের আগ্রাসন, বর্জ্যের টান আর হরেক জাহাজের পিচ ফেলে ৩০ শতাংশ স্থানীয় মাছ বিলুপ্তির পথে। তবু নদী বাঁচলে অস্ট্রেলিয়ান ব্যারামুন্ডি, স্থানীয় হাওড়ের গলদা-সহ মিশ্র-চাষের পরীক্ষামূলক সাফল্য নতুন আশা জাগায়।
বন্দর, ব্যবসা ও বৈশ্বিক যোগাযোগ
বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ কন্টেইনারবাহী জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে ঢোকে—আর সেই প্রবেশদ্বার কর্ণফুলী। ব্রিটিশ আমলের জেটি ও গুদাম বাড়তে বাড়তে আজ পতেঙ্গা সাউথ কন্টেইনার টার্মিনাল, বে-টার্মিনাল, মেরিন ড্রাইভ ব্লু-ইকোনমি করিডর ইত্যাদি মেগা-প্রকল্প নদীপারে মাথা তোলে। দিনে প্রায় ১০০ মালবাহী লাইটার ভেসেল নদীর ভেতর বন্দরের ‘চান্দগাঁও মোড়’ পর্যন্ত পণ্য আনে-নেয়।
সাহিত্য, গান ও কর্ণফুলী-নির্ভর লোকজ সংস্কৃতি
“কর্ণফুলীর পানি রে ভাই, সোনার বরণ পানি”—চট্টগ্রামের গ্রামীণ পালাগানে নদীর স্রোত প্রেম-বিরহের সমার্থক শব্দ। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘ছোট্ট গল্প’, কবি সুলতান শাহী বা মফিজুল হকের পদ্যে কর্ণফুলী কখনও বিপ্লবীর অশ্রু, কখনও প্রেমিকার অধরা হাতে রূপালি চুড়ি। নাট্যকার ফরিদুর রহমানের মঞ্চে কর্ণফুলী-পাড়ের মতি-জাহাজির দুঃখ-কষ্ট আজও দর্শক কাঁদায়।
বঙ্গবন্ধু টানেল: জলের নিচে সড়ক, আকাশচুম্বী সম্ভাবনা
২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করা ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ ৩.৪ কিমি দীর্ঘ ডাবল টিউব সড়কপথ, যা কর্ণফুলীর তলের ১৮–৪২ মিটার গভীরে গিয়ে চট্টগ্রাম শহরকে আনোয়ারা শিল্পাঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত করেছে।
প্রতিদিন গড়ে ২০–২২ হাজার যানবাহন চলাচলের লক্ষ্য থাকলেও বাস্তবে এখনও গড় ব্যবহার কয়েক হাজার; ফলে টোল আয়ে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে—২০২৪-এর শেষে মাসিক প্রায় ৯ কোটি টাকা ঘাটতি ধরা পড়েছে।
টানেল-পরবর্তী অর্থনীতি: শিল্প, পর্যটন ও লজিস্টিকস
টানেল চালু হওয়ার পর বন্দর এলাকার যানজট কমে, দ্রুততম রুটে গাড়ি সরাসরি কক্সবাজার মহাসড়কে উঠতে পারছে; আনোয়ারায় গড়ে উঠছে ইকোনমিক প্রসেসিং জোন, এলএনজি টার্মিনাল, গভীর সমুদ্রবন্দর-সংযুক্ত কয়েকটি সিডার রাডার, সোলার পার্ক। টানেলের ভূগর্ভস্থ দর্শন শর্ট ট্যুরের আকর্ষণ হিসেবে ‘রিভার ওয়াক গ্যালারি’ প্রকল্পও প্রস্তাবিত, যা নদী-তত্ত্ব তুলে ধরবে।
পরিবেশের চ্যালেঞ্জ ও নদীর অধিকার
নদী দখল-ভরাট, শিল্পবর্জ্য, শিপ-চ্যানেলের তেল আর কেপিএম-সিমেন্ট কারখানার ধোয়া-পানি মিলিয়ে কর্ণফুলীর বিবর্ণ স্রোত আজ জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি। নদীসংরক্ষণবাদীরা ‘কর্ণফুলী রিভার ট্রাস্ট’ গঠনের দাবি তুলছেন—যাতে আইনগতভাবে নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে দূষক-দখলদারকে শাস্তির আওতায় আনা যায়। নদীর বুকের পাড়ভাঙন ঠেকাতে ভেটিভার ও ম্যানগ্রোভ-মিশ্র রিভার বাফার বাগান ইতিমধ্যেই পাইলট প্রকল্পে সফল হয়েছে।
নদীর বুকে আগামী সম্ভাবনার বৈঠা
কর্ণফুলী দুই শতক ধরে চট্টগ্রামের জীবনধারা, বাণিজ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। টানেল চালু করেছে যানবাহনের নতুন করিডর; কিন্তু নদীর প্রবাহ, মাছ, বন-জঙ্গল, আদিবাসী সাংস্কৃতিক পরম্পরা বাঁচিয়ে রাখাই টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত। কর্ণফুলী বাঁচলেই বন্দর-শহর-মহাসড়ক-শিল্প—সবকিছু বাঁচবে; নদীর বুকের সেই ভালবাসা অক্ষুণ্ণ রাখাই আগামী বাংলাদেশের পরিকল্পনা-পথরেখা।