“দুই তিনদিন আগে মনির আসছিল, কেবিন নিয়ে ঝামেলা হইছে। ওইদিন হুমকি দিয়ে চলে গেছে। পরের দিন পোলাপান ঝাঁকে ঝাঁকে আসছে, দুইজন, চারজন করে প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ জনের মতো। পরে খাওয়া শেষে ‘মনির ভাইকে তোরা কেবিন দিস নাই’ বলেই ভাঙচুর শুরু করছে।”
ঢাকার মহাখালী ওয়ারলেস গেট এলাকার হোটেল জাকারিয়া ইন্টারন্যাশনাল রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বারে গত পহেলা জুলাই রাতের ঘটনা এভাবে বর্ণনা করছিলেন সেখানকার জেনারেল ম্যানেজার খোকন চৌধুরী।
এই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে গতকাল বৃহস্পতিবার।
অনেকটা সিনেমার দৃশ্যের মতো ভাংচুর ও মারামারি দেখা যায় ছড়িয়ে পড়া ওই ভিডিওতে। ভিডিও’র একটি অংশে দুই নারীকে ধাওয়া করে মারধরের বিষয়টি নিয়ে তৈরি হয় আরও বেশি সমালোচনা।
শুক্রবার সকালে হোটেলটি সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে একেবারেই সুনসান পরিস্থিতি দেখা গেছে।
ঘটনার অগ্রগতি জানতে কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মীর উপস্থিতি থাকলেও হোটেলের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাউকেই পাওয়া যায়নি। এমনকি হোটেলের রিসিপশনিস্টও হামলার ঘটনা নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
যদিও নাম প্রকাশ না করার শর্তে হোটেলের এক কর্মী বিবিসি বাংলাকে জানান, বিষয়টি নিয়ে কোনো কথা না বলতে তাদেরকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে এবং “বারের কার্যক্রম আপাতত বন্ধ” আছে।
হোটেলটির জেনারেল ম্যানেজার খোকন চৌধুরীর কাছে ফোনে জানতে চাইলে বলেন, ঘটনার বিস্তারিত মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। মেরামতের কাজ চলায় ভাঙচুর হওয়া অংশ এই মুহূর্তে বন্ধ রাখা হয়েছে বলেও তিনি জানান।
এ ঘটনায় দোসরা জুলাই রাতে রাজধানীর বনানী থানায় মামলা করে হোটেল কর্তৃপক্ষ। মামলার প্রধান আসামি করা হয় স্থানীয় যুবদল নেতা মনির হোসেনকে।
মামলার এজাহার অনুযায়ী হোটেল কর্তৃপক্ষের দাবি, দুই দিন আগে বারে গিয়ে হট্টগোল করেছিল মনির। সেসময় দেখে নেয়ার হুমকিও দিয়েছিল সে।
প্রাথমিক তদন্তে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করা গেছে বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রাসেল সরোয়ার। যদিও এ ঘটনায় এখনো কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি বলেও জানান তিনি।
এদিকে অভিযুক্ত যুবদল নেতা মনির হোসেন বনানী থানা যুবদলের আহ্বায়ক বলে জানা গেছে। জাকারিয়া হোটেলে হামলা ও ভাঙচুর ঘটনার পর তাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কারের কথা জানিয়েছে যুবদল।
যদিও একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও ঘটনার মূল অভিযুক্ত মনির হোসেনের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তার মুঠোফোন নম্বরও বন্ধ পাওয়া গেছে।

ঘটনা সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটি সিসিটিভি ফুটেজ থেকেই প্রথম নজরে আসে হোটেল জাকারিয়া ইন্টারন্যাশনাল রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড বারে হামলার এই ঘটনাটি।
ফুটেজে দেখা গেছে, জাকারিয়া হোটেলের সিঁড়িতে দুইজন নারী দৌড়ে নিচের দিকে নেমে আসছেন। তাদের পেছন থেকে ধাওয়া করছিলেন কয়েকজন। শাড়ি পরিহিত এক নারীর পথ রোধ করে তার ওপর হামলা চালায় বিপরীত দিক থেকে আসা এক ব্যক্তি।
এরপর সেখানে আরও কয়েকজন এসে দুই নারীর ওপর আক্রমণ করেন। হামলার ওই ভিডিওতে অন্তত দশ জনকে দেখা যায়।
এছাড়া হোটেলের বারের অংশটিতে এলোপাতাড়ি ভাঙচুরের কিছু দৃশ্যও দেখা যায় ভিডিওটিতে।
ঘটনার পরদিন সন্ধ্যায় হোটেলটির সহকারী মহাব্যবস্থাপক আবু বকর সিদ্দিক বাদী হয়ে রাজধানীর বনানী থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেন।
যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, গত ৩০শে জুন রাত আটটার দিকে মনির নামের এক ব্যক্তি হোটেলের বারে এসে ভিআইপি কেবিন চান। কিন্তু অন্য অতিথির জন্য বরাদ্দ থাকায় কেবিনটি তখন দেওয়া সম্ভব হয়নি।
পরে অন্য টেবিলে বসে খাবার ও পানীয় গ্রহণ করেন মনির। ‘স্থানীয় নেতা’ পরিচয় দিয়ে ডিসকাউন্ট (ছাড়) দাবি করেন। হোটেল কর্তৃপক্ষ তাকে ডিসকাউন্ট দিয়েই বিল নেয়।
এরপরও ‘ক্ষুব্ধ মনির হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে হট্টগোল করে ও দেখা নেয়ার হুমকি দিয়ে’ চলে যায়।
পরদিন হোটেলটিতে হামলার ঘটনা ঘটে। যেখানে দুই নারীকেও মারধর করে একদল ব্যক্তি।
শুক্রবার সকালে ঘটনাস্থলে সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায় হোটেলটির রেস্টুরেন্ট ও আবাসিক অংশের মূল গেট খোলা থাকলেও বন্ধ রাখা হয়েছে বারের প্রধান ফটক। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া ওই অংশে প্রবেশ নিষেধ বলে জানান প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরতরা।
এছাড়া হামলার ঘটনা নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলা নিষেধ বলেও জানা যায়।
টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে হোটেলের জেনারেল ম্যানেজার খোকন চৌধুরী জানান, “এইটা দুই-তিন দিন আগের ঘটনা। পুলিশের কাছে রিপোর্টে যেটা লেখা হইছে ওইখানেই সব আছে।”
তিনি জানান, “দুই তিনদিন আগে মনির আসছিল, কেবিন নিয়ে ঝামেলা হইছে।”
ওইদিন হুমকি দিয়ে চলে গেলেও পরের দিন দলবদ্ধভাবে ভাঙচুর চালানো হয় বলে তিনি উল্লেখ করেন।

হামলার দিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে মি. চৌধুরী বলেন, “পরের দিন পোলাপান ঝাঁকে ঝাঁকে আসছে, দুইজন, চারজন করে প্রায় ত্রিশ-চল্লিশ জনের মতো। পরে খাওয়া শেষে ‘মনির ভাইকে তোরা কেবিন দিস নাই’ বলেই ভাঙচুর শুরু করছে।”
মি. চৌধুরী দাবি করেন, চেয়ার, টেবিল, সিসিটিভি মনিটর, ক্রোকারিজসহ রেস্টুরেন্টের বিভিন্ন সামগ্রী ভাঙচুর ও লুটপাট করে তারা। ক্যাশ কাউন্টার থেকে ৭০ হাজার টাকা এবং প্রায় পাঁচ লাখ টাকার মদ ও বিয়ার লুট করে নেওয়ার পাশাপাশি অন্য টেবিলে থাকা নারীদেরকেও হেনস্তা করে তারা।
তিনি বলেন, ভাঙচুর শুরু হবার পর সেখান থেকে বের হয়ে যাবার সময় ভিডিওতে দেখা যাওয়া দুজন নারীর ওপর চড়াও হন হামলাকারীরা।
ভাঙচুরের সময় মূল অভিযুক্ত মনির উপস্থিত না থাকলেও তার নির্দেশেই এই হামলা চালানো হয়েছে এবং ভাঙচুরের পরে এই ঘটনায় থানায় কোনো মামলা না দিতে হোটেল কর্তৃপক্ষকে তিনি হুমকিও দিয়েছিলেন বলেও দাবি করেন মি. চৌধুরী।
মূল অভিযুক্ত মনির হোসেনসহ পাঁচজনের নাম উল্লেখ করে এবং আরও ২০ থেকে ২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা হলেও এ ঘটনায় এখনো কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. রাসেল সরোয়ার বিবিসি বাংলাকে জানান, এ ঘটনায় হোটেল কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে গতকাল রাতেই একটি মামলা করেছে। মামলাটি বর্তমানে তদন্তাধীন রয়েছে।
“আমরা, ডিবি পুলিশসহ সবাই আসামিদের ধরতে চেষ্টা করছি,” জানান মি. সরোয়ার।
এদিকে এ ঘটনায় অভিযুক্ত মনির হোসেনকে সংগঠন থেকে বহিষ্কারের কথা জানিয়েছে যুবদল।
সংগঠনটির সভাপতি আব্দুল মোনায়েম মুন্না জানিয়েছেন, কারও অপকর্মের দায় সংগঠন নেবে না। এই ঘটনায় আইনগত ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে জানানো হবে।
তিনি বলেন, “বনানীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলার মধ্য দিয়ে মনির হোসেন ন্যাক্কারজনক কাজ করেছে। সংগঠন থেকে তাকে বহিষ্কার করা হচ্ছে।”
বিবিসি নিউজ বাংলা