ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে বোতলজাত পানির দাম হুহু করে বাড়ছে। এক লিটার বোতল আগে ২০–২৫ টাকায় পাওয়া গেলেও এখন অনেক দোকানে ৩০ টাকা ছুঁইছুঁই। ৫ লিটারের বোতলের দাম ৭০–৮০ টাকা ছাড়িয়ে ১০০ টাকার ওপরে উঠে গেছে। এ অবস্থায় নিম্ন আয়ের মানুষের পক্ষে বোতলজাত পানি কেনা দিন দিন অসম্ভব হয়ে পড়ছে।
এদিকে প্রধান সরবরাহকারী ঢাকা ওয়াসার পানি সরাসরি পানযোগ্য নয়—বিষয়টি বহুবার বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন। সাধারণ মানুষ তাই পানি ফুটিয়ে খেতে বাধ্য হয়। কিন্তু ফুটানোর জন্য চাই গ্যাস বা বিদ্যুৎ, আর এ দুটোরই ঘাটতি এখন নগর জীবনের নিত্যদিনের দুর্ভোগ। ফলে বিশুদ্ধ পানি সবার নাগালে রাখাই এখন এক বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বোতলজাত পানির দাম বৃদ্ধি: ব্যবসায়ীদের অজুহাত বনাম বাস্তবতা
পানির বোতল উৎপাদকদের দাবি, প্লাস্টিক রজনের (raw material) মূল্য, লেবেল ছাপা, পরিবহন ব্যয় ও বৈদেশিক মুদ্রার দর বৃদ্ধি মিলিয়ে উৎপাদন খরচ বেড়েছে। ভোক্তাদের অভিযোগ, এই অজুহাতের আড়ালে একটি সিন্ডিকেট সুযোগ নিয়ে মনগড়া বাড়তি দাম বসাচ্ছে। এতে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত ক্রেতাদের উপর সরাসরি চাপ পড়ছে।
ওয়াসার পানি ফুটিয়ে খাওয়া কি সত্যিই নিরাপদ?
ওয়াসার সরবরাহকৃত পানি প্রায়শই দুর্গন্ধযুক্ত, ময়লাযুক্ত, লবণাক্ত বা ব্যাকটেরিয়া ও ভারী ধাতু দূষণে আক্রান্ত থাকে। সংস্থাটি নিজেই বলে, পানি ফুটিয়ে খেলে নিরাপদ হবে; কিন্তু বাস্তবে পুরোপুরি সুরক্ষার নিশ্চয়তা নেই।
ফুটানো পানি জীবাণু (ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস) মেরে ফেলে ঠিকই, কিন্তু—
- রাসায়নিক দূষণ (যেমন আর্সেনিক, লোহা, সীসা) ফুটিয়েও দূর হয় না
- পাইপলাইনের ময়লা বা গন্ধযুক্ত দূষণ ভালো ফিল্টার ছাড়া থেকে যেতে পারে
- সংরক্ষণ ঠিকঠাক না হলে পানি পরে আবার দূষিত হতে পারে
বিশেষজ্ঞদের মতে, ওয়াসার পানি ফুটিয়ে খেতে হলে আগেই উন্নত ফিল্টারে পরিশোধন করা জরুরি—যার খরচ গরিব মানুষের নাগালের বাইরে।
ফুটানো পানির বাড়তি খরচ: গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটে দিশেহারা দরিদ্ররা
ওয়াসার পানি ফুটিয়ে বিশুদ্ধ করতে দরকার গ্যাসের চুলা বা বৈদ্যুতিক কেটলি/ইনডাকশন। কিন্তু গ্যাস-সংকট এখন নিত্যদিনের সঙ্গী; ভোররাতে বা গভীর রাতে গ্যাস পাওয়ার সময়ে পরিবারগুলোকে পানি ফুটিয়ে রাখতে হয়। বৈদ্যুতিক কেটলি ব্যবহারকারীদের সমস্যা আলাদা—বিদ্যুতের দাম বেড়েছে, লোডশেডিংও নিয়মিত। ফলে দুটির কোনোটিতেই পুরোপুরি নির্ভর করা যাচ্ছে না।
এই পরিস্থিতিতে—
- গরিব মানুষকে ফুটানো ছাড়াই দূষিত পানি খেতে হয়
- অথবা ধনীদের মতো দামি বোতলজাত পানি কিনতে হয়, যা তাদের পক্ষে অসম্ভব
- কেউ কেউ সস্তা ও মানহীন ফিল্টার ব্যবহার করছে, যেগুলোর কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ
দরিদ্র মানুষের জীবনযুদ্ধ: বিশুদ্ধ পানি সবার অধিকার
সংবিধান বিশুদ্ধ পানি নাগরিকের অধিকার হিসেবে স্বীকার করলেও বাস্তবে তা সহজলভ্য নয়। ঝুপড়ি বস্তি ও নিম্ন আয়ের এলাকাগুলোয় পাইপলাইন প্রায়ই খোলা নর্দমার পাশ দিয়ে যায়; পাইপ ফেটে গেলে নোংরা জল মিশে যায়।
একজন রিকশাচালকের অভিব্যক্তি—
“উপর মহলের লোকজন দামি বোতল পানি খায়। আমরা ওয়াসার ময়লা পানি ফুটাই, কিন্তু গ্যাস থাকে না। কখনো কাঁচা পানি খেয়ে পেটের রোগে ভুগি।”
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
- পানি ফুটিয়ে জীবাণু দূর হলেও রাসায়নিক দূষণ থেকে যায়
- উন্নত মানের ফিল্টার (UV/RO) থাকলে তুলনামূলক নিরাপদ, তবে দাম ৫–১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত
- সরকারের উচিত ওয়াসার পানি সরাসরি পানযোগ্য করতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া
- দরিদ্রদের জন্য কম দামে বা বিনা খরচে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা
সরকারি উদ্যোগ কতদূর?
ওয়াসা বলছে, শিগগিরই আধুনিক শোধনাগার চালু হবে, কিন্তু নির্মাণের গতি ধীর। কিছু এলাকায় কমিউনিটি-ভিত্তিক বিশুদ্ধ পানি কেন্দ্র স্থাপন করা হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। বোতলজাত পানি ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত মুনাফা নিয়ন্ত্রণেও পর্যাপ্ত নজরদারি নেই।
ঢাকাসহ দেশের শহরগুলোতে বোতলজাত পানির দাম সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে, আর ওয়াসার পানি ফুটিয়ে খাওয়াও গ্যাস–বিদ্যুৎ সংকটে কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশুদ্ধ পানি সবার অধিকার—এ বাস্তবতা নিশ্চিত করতে দ্রুত ও সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন: আধুনিক শোধনাগার, সুলভ ফিল্টার, কমিউনিটি পানিকেন্দ্র, আর বোতলজাত পানির বাজারে কঠোর নজরদারি। এখনই ব্যবস্থা না নিলে স্বাস্থ্যঝুঁকি আরও বাড়বে, এবং বিশুদ্ধ পানির সংকট বয়ে আনবে বড় মানবিক বিপর্যয়।