০১:৩৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

তারল্য সংকটের নতুন ডোমিনো ও মধ্যবিত্তের দুর্ভাবনা

বাংলাদেশ সরকারের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কেটে দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেশের আর্থিক বাজারে বড় ধরনের আলোড়ন তুলেছে। বহু গ্রাহক ক্ষুব্ধ ও হতাশ। এক ক্ষুদ্র-বিনিয়োগকারীর আক্ষেপ—

“আমরা বেসরকারি চাকরিজীবী মানুষ। ব্যাংক ঋণের সুদ আকাশছোঁয়া, শেয়ারবাজারে স্বচ্ছতা নেই—দুর্নীতির অভিযোগও আছে। তাই সঞ্চয়পত্রই ছিল শেষ ভরসা। এখন ওটারও সুদ কমিয়ে দিলে টাকা রাখব কোথায়? এটা কি আবার নতুন করে তারল্য সংকট তৈরি করবে না?”

এই প্রশ্নগুলো বাস্তব, আর অর্থনীতিবিদরাও বিস্মিত ও চিন্তিত।

শেয়ারবাজারের অনিশ্চয়তা ও আস্থাহীনতা

  • ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ বহু দিন ধরেই অস্থির।
    •অনেক কোম্পানির আর্থিক বিবরণী সন্দেহজনক।
    • হঠাৎ অস্বাভাবিক দাম বাড়া-কমা নিয়ে অভিযোগ রয়েছে।
    • প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, গোপন চুক্তি ও ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের কথাও শোনা যায়।

ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ বিকল্প খুঁজতে গিয়ে সঞ্চয়পত্রকেই ভরসা করেছিলেন।

সঞ্চয়পত্র কেন জনপ্রিয়?

  • ঝুঁকিমুক্ত সুদের হার
    •নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে মূলধন ফেরতের নিশ্চয়তা
    • বৃদ্ধ, অবসরপ্রাপ্ত ও ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের জন্য বাড়তি সুবিধা
    • ব্যাংক ফিক্সড ডিপোজিটের চেয়ে তুলনামূলক বেশি মুনাফা

চাকরিজীবী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, গ্রামীণ নারী ও প্রবাসী পরিবার—সবাই এই পণ্যকে সেভিংসের প্রধান মাধ্যম হিসেবে দেখেন।

সুদ কমলে বিনিয়োগকারীরা কোথায় যাবেন?

  • শেয়ারবাজারে আস্থা নেই।
    •ব্যাংকে সুদ স্বল্প; ঋণ পেতে শর্ত কঠিন।
    • বন্ড মার্কেট দুর্বল, বিকল্প নেই।
    • সোনা, জমি বা রিয়েল-এস্টেটের জন্য বড় অঙ্কের টাকার প্রয়োজন।

ফলে মধ্যবিত্ত বা চাকরিজীবী মানুষের উপযুক্ত বিনিয়োগ ক্ষেত্র সংকুচিত হতে পারে।

তারল্য সংকট কি বাড়বে?

বর্তমানে ব্যাংক খাতে তারল্য সমস্যা চলমান। অনেক ব্যাংক আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে দেরি করছে, ঋণপত্র নবায়নে টালবাহানা করছে। সরকার আগে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে যে অর্থ উঠাত, সুদ কমার সঙ্গে সঙ্গে সেই বিক্রি কমে যেতে পারে—
• সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন চাপে পড়বে।
• নিরাপদ সঞ্চয়ের অপশন কমে গেলে অর্থ ‘ক্যাশ’ আকারে, হাওলা বা অনিয়মিত খাতে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
• ব্যাংকে আমানত বাড়ার বদলে কমতেও পারে, কারণ ব্যাংকও কম সুদ দিচ্ছে।

সব মিলিয়ে পদক্ষেপটি নতুন রকমের তারল্য সংকটের ঝুঁকি ডেকে আনতে পারে।

সরকারি অবস্থান ও সম্ভাব্য সমাধান

সরকারের যুক্তি
• উচ্চ সুদে সঞ্চয়পত্র চালু থাকলে সরকারি ঋণের বোঝা বাড়ে।
• ব্যাংকগুলোর ঋণ ব্যয়ও বেড়ে যায়।
• মিতব্যয়ী নীতির জন্য সুদ কমানো প্রয়োজন।

অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ
• আস্থা ফেরাতে শেয়ারবাজার সংস্কার।
• ব্যাংক খাতের অনিয়ম নিয়ন্ত্রণ।
• বন্ড ও বিকল্প সঞ্চয়পণ্য চালু।
• সঞ্চয়পত্রে স্বচ্ছতা ও ডিজিটাল সেবা বৃদ্ধি।
• ‘টার্গেটেড’ পদ্ধতিতে বড় বিনিয়োগকারীর ক্ষেত্রে সুদ বেশি কাটা, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ছাড়।

সঞ্চয়পত্রে সুদ কমানো দায়িত্বশীল ঋণ নীতির ইঙ্গিত দিতে পারে, কিন্তু এর সামাজিক-অর্থনৈতিক অভিঘাতও গভীর। মধ্যবিত্তের আস্থা হারালে বাজারে তারল্যের অভাব আরও তীব্র হতে পারে, বিনিয়োগের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে। তাই সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়নে সরকারকে সূক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে, যাতে আস্থা নষ্ট না হয় এবং অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।

তারল্য সংকটের নতুন ডোমিনো ও মধ্যবিত্তের দুর্ভাবনা

১০:০০:৩২ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৫ জুলাই ২০২৫

বাংলাদেশ সরকারের সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কেটে দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেশের আর্থিক বাজারে বড় ধরনের আলোড়ন তুলেছে। বহু গ্রাহক ক্ষুব্ধ ও হতাশ। এক ক্ষুদ্র-বিনিয়োগকারীর আক্ষেপ—

“আমরা বেসরকারি চাকরিজীবী মানুষ। ব্যাংক ঋণের সুদ আকাশছোঁয়া, শেয়ারবাজারে স্বচ্ছতা নেই—দুর্নীতির অভিযোগও আছে। তাই সঞ্চয়পত্রই ছিল শেষ ভরসা। এখন ওটারও সুদ কমিয়ে দিলে টাকা রাখব কোথায়? এটা কি আবার নতুন করে তারল্য সংকট তৈরি করবে না?”

এই প্রশ্নগুলো বাস্তব, আর অর্থনীতিবিদরাও বিস্মিত ও চিন্তিত।

শেয়ারবাজারের অনিশ্চয়তা ও আস্থাহীনতা

  • ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ বহু দিন ধরেই অস্থির।
    •অনেক কোম্পানির আর্থিক বিবরণী সন্দেহজনক।
    • হঠাৎ অস্বাভাবিক দাম বাড়া-কমা নিয়ে অভিযোগ রয়েছে।
    • প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী, গোপন চুক্তি ও ইনসাইডার ট্রেডিংয়ের কথাও শোনা যায়।

ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা নিরাপদ বিকল্প খুঁজতে গিয়ে সঞ্চয়পত্রকেই ভরসা করেছিলেন।

সঞ্চয়পত্র কেন জনপ্রিয়?

  • ঝুঁকিমুক্ত সুদের হার
    •নির্দিষ্ট মেয়াদ শেষে মূলধন ফেরতের নিশ্চয়তা
    • বৃদ্ধ, অবসরপ্রাপ্ত ও ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীদের জন্য বাড়তি সুবিধা
    • ব্যাংক ফিক্সড ডিপোজিটের চেয়ে তুলনামূলক বেশি মুনাফা

চাকরিজীবী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, গ্রামীণ নারী ও প্রবাসী পরিবার—সবাই এই পণ্যকে সেভিংসের প্রধান মাধ্যম হিসেবে দেখেন।

সুদ কমলে বিনিয়োগকারীরা কোথায় যাবেন?

  • শেয়ারবাজারে আস্থা নেই।
    •ব্যাংকে সুদ স্বল্প; ঋণ পেতে শর্ত কঠিন।
    • বন্ড মার্কেট দুর্বল, বিকল্প নেই।
    • সোনা, জমি বা রিয়েল-এস্টেটের জন্য বড় অঙ্কের টাকার প্রয়োজন।

ফলে মধ্যবিত্ত বা চাকরিজীবী মানুষের উপযুক্ত বিনিয়োগ ক্ষেত্র সংকুচিত হতে পারে।

তারল্য সংকট কি বাড়বে?

বর্তমানে ব্যাংক খাতে তারল্য সমস্যা চলমান। অনেক ব্যাংক আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দিতে দেরি করছে, ঋণপত্র নবায়নে টালবাহানা করছে। সরকার আগে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে যে অর্থ উঠাত, সুদ কমার সঙ্গে সঙ্গে সেই বিক্রি কমে যেতে পারে—
• সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন চাপে পড়বে।
• নিরাপদ সঞ্চয়ের অপশন কমে গেলে অর্থ ‘ক্যাশ’ আকারে, হাওলা বা অনিয়মিত খাতে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
• ব্যাংকে আমানত বাড়ার বদলে কমতেও পারে, কারণ ব্যাংকও কম সুদ দিচ্ছে।

সব মিলিয়ে পদক্ষেপটি নতুন রকমের তারল্য সংকটের ঝুঁকি ডেকে আনতে পারে।

সরকারি অবস্থান ও সম্ভাব্য সমাধান

সরকারের যুক্তি
• উচ্চ সুদে সঞ্চয়পত্র চালু থাকলে সরকারি ঋণের বোঝা বাড়ে।
• ব্যাংকগুলোর ঋণ ব্যয়ও বেড়ে যায়।
• মিতব্যয়ী নীতির জন্য সুদ কমানো প্রয়োজন।

অর্থনীতিবিদদের পরামর্শ
• আস্থা ফেরাতে শেয়ারবাজার সংস্কার।
• ব্যাংক খাতের অনিয়ম নিয়ন্ত্রণ।
• বন্ড ও বিকল্প সঞ্চয়পণ্য চালু।
• সঞ্চয়পত্রে স্বচ্ছতা ও ডিজিটাল সেবা বৃদ্ধি।
• ‘টার্গেটেড’ পদ্ধতিতে বড় বিনিয়োগকারীর ক্ষেত্রে সুদ বেশি কাটা, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ছাড়।

সঞ্চয়পত্রে সুদ কমানো দায়িত্বশীল ঋণ নীতির ইঙ্গিত দিতে পারে, কিন্তু এর সামাজিক-অর্থনৈতিক অভিঘাতও গভীর। মধ্যবিত্তের আস্থা হারালে বাজারে তারল্যের অভাব আরও তীব্র হতে পারে, বিনিয়োগের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হবে। তাই সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়নে সরকারকে সূক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে, যাতে আস্থা নষ্ট না হয় এবং অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।