জোনাকি
মাঝেমাঝে মাথায় একটা গামছা ফেলে বাঁশগাঁও থেকে মাইলখানেক পথ ভেঙে দড়িকান্দা পার হয়ে মেঘনার পাড়ে চলে যেতেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানিতে পা চুবিয়ে বসে থাকতেন, হুশহুশ করে ডুব দিতেন ইচ্ছেমতো। নরোম মাংসের মতো থরপড়া বেলেমাটিতে হাঁটা, মেঘনার ভিজে কোল বরাবর হাঁটা আর হাঁটা, কত কিছু।
কী খাওয়াটাই না খেয়েছেন এই ক’টা দিন। খিদেও পেত, রাক্ষুসে। শুধু পাটশাক দিয়েই থালার পুরো ভাত সাবাড় করে দিতেন। নড়বড়ে চৌকিতে শুয়ে ইচ্ছে করে পা ঝুলিয়ে দিতেন ঝাড়াই কাওনের শীষের ডাঁই-এ। মনে হতো মখমল। মনে হতো আদর। পায়ের পাতার সেকি আহ্লাদিপনা, শুধু উম্ চায়, ভালোবাসা চায়, শুধু ছেলেমানুষি চায়, শৈশব চায়। যতো বলো, শৈশব মানে বিমাতার অত্যাচার, শৈশব মানে দুঃখ, সে তবু চায়, কিছুতেই তাকে বোঝানো যায় না, বলে আরো দাও, আরো দুঃখ দাও, আমাকে শৈশব দাও, আমাকে কোলে নাও, আমাকে মারো…
চোখের পাতা ভিজে আসে আবুল হোসেনের, তাই-ই, সত্যিই তিনি ছেলেমানুষের মতো যাচ্ছেতাই করে বেড়িয়েছেন ক’দিন। শুধু একা একা ঘুরে বেড়ানো আর বিড়বিড় করে নিজের সঙ্গে কথা বলা। না ছিলো মানুষের ভিড়, না চক্ষুলজ্জা, পেয়ে বসেছিলো পাগলামি। গ্রাম প্রত্যেকটি মানুষকে বড়ো আড়াল করে রাখে। হরহামেশাই তিনি একা একা কথা বলতেন। বলতেন, আবুল হোসেন, এখন তুমি আবুল হয়ে যাও, আবুল, আ-বুলি, মাদার গাছ তোমার ভালো লাগে, খেজুর গাছের বালদোয় ঘেরা তিলক্ষেত তোমার ভালো লাগে?
আবুল, আ-বুলি ঐ যে দ্যাখো প্রজাপতির ঝাঁক। গতরাতে ধানক্ষেতের ওপর ঢেউয়ের মতো জোনাকির সারি দেখতে তোমার ভালো লেগেছিলো তো! আবুল, কোথায় ছিলে এতোদিন, মনে পড়ছে সবকিছু, চিনতে পারছো। বলতেন, হে হিজলগাছ, হে মৌরলা মাছ, ঘাসফড়িং, তোমরা আমাকে চিনতে পেরেছ তো? তারপরই বলতেন, আবুল, ওরে বিশ্বাসঘাতক, মাপ চেয়ে নে, বল আমি আর কোথাও যাবো না. আমি মরবো, আমি এইখানেই এই মাটিতেই মরবো, ঘাসের বিছানায়, জামগাছের ছায়ায়, এই একরত্তি টুনটুনির দস্যিপনা দেখতে দেখতেই মরবো।