আজকের তরুণ প্রজন্মের জীবনে সোশ্যাল মিডিয়া এমনভাবে ঢুকে পড়েছে যে, তা শুধু বিনোদন বা যোগাযোগের মাধ্যম নয়—এটি মানসিক স্বাস্থ্য, মনোযোগের ক্ষমতা, দৈনন্দিন অভ্যাস এমনকি সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যকেও প্রভাবিত করছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে যেখানে প্রযুক্তি ও শিক্ষা-অবকাঠামো সমানভাবে পৌঁছায়নি, সেখানে সোশ্যাল মিডিয়া একটি বিভাজক রেখা এঁকে দিচ্ছে।
সোশ্যাল মিডিয়ার আসক্তি ও মানসিক স্বাস্থ্য
সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো তরুণদের এমনভাবে নেশাগ্রস্ত করে তোলে যে, তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্ক্রল করে সময় নষ্ট করে। এতে—
- হতাশা ও ঈর্ষা:অন্যের সাজানো-গোছানো জীবন দেখে নিজের জীবনকে মূল্যহীন মনে হয়।
- FOMO (Fear of Missing Out):মনে হয় নিজের জীবনে কিছুই ঘটছে না।
- নিজেকে হীন মনে করা:নিজের সক্ষমতা বা অর্জনকে ছোট করে দেখা শুরু করে।
গবেষণায় দেখা গেছে, সোশ্যাল মিডিয়া বেশি ব্যবহারকারী কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে হতাশা, উদ্বেগ ও আত্মহত্যার প্রবণতা উল্লেখযোগ্য হারে বেশি।
মনোযোগের ক্ষমতা ও একাগ্রতা ক্ষয়
অগণিত নোটিফিকেশন, ছোট ভিডিও, ইনস্ট্যান্ট রিওয়ার্ড—সব মিলিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া একধরনের “ডোপামিন-হিট” দেয়। এর ফলে—
- দীর্ঘক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষমতা কমে যায়।
- পড়াশোনা বা কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
- বই পড়া,গবেষণা, সৃজনশীল চিন্তাভাবনা কমে যায়।
একদম ছোটবেলা থেকে বাচ্চারা ফোনে ভিডিও দেখে বড় হচ্ছে। ফলত, তারা ধৈর্যহীন ও অমনোযোগী হয়ে উঠছে।
শারীরিক অলসতা ও স্বাস্থ্যঝুঁকি
- সোফায় বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইল চালানো শারীরিকভাবে অলস করে তুলছে।
- হাঁটা-চলা,খেলাধুলা, শরীরচর্চা কমে যাচ্ছে।
- স্থূলতা,ডায়াবেটিসের মতো রোগের ঝুঁকি বাড়ছে।
একটা প্রজন্ম যেন আস্তে আস্তে বাস্তব জীবনের অভ্যাস ভুলে ভার্চুয়াল জগতে ডুবে যাচ্ছে।
উন্নয়নশীল দেশের বৈষম্যের নতুন মাত্রা
তৃতীয় বিশ্বের দেশে সোশ্যাল মিডিয়া বিভাজনেরও হাতিয়ার হয়ে উঠছে।
- ডিভাইস-অ্যাকসেসে বৈষম্য:গ্রামের গরিব যুবকরা যেসব সস্তা, ধীর গতির, পুরনো ফোন পায়, তাতে ভালো মানের শিক্ষা বা দক্ষতা শেখার কনটেন্ট সহজলভ্য নয়। অপরদিকে শহরের মধ্যবিত্ত বা ধনী পরিবারের সন্তানরা ভালো ফোন, ইন্টারনেট, কোর্স অ্যাপ ব্যবহার করে এগিয়ে যাচ্ছে।
- ডিজিটাল শিক্ষা বনাম বিনোদন:অনেকে বিনোদনকেন্দ্রিক কনটেন্টে আসক্ত হয়ে পড়লেও, সমান সুযোগ থাকা সত্ত্বেও শেখার সংস্কৃতি গড়ে উঠছে না।
- তথ্য-বৈষম্য:যাদের ভালো নেটওয়ার্ক নেই বা ইন্টারনেট ব্যয়বহুল, তারা ভালো মানের তথ্য, কোর্স, চাকরির খবর থেকে বঞ্চিত হয়।
ফলত, একটি বড় অংশ পিছিয়ে পড়ছে—যেটা অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য আরও প্রকট করছে।
সামাজিক সংযোগের ভাঙন
সোশ্যাল মিডিয়া সংযোগ তৈরি করে বলে দাবি করা হয়। বাস্তবে—
- পরিবার বা বন্ধুদের সাথে সরাসরি কথা বলার অভ্যাস কমে গেছে।
- ভার্চুয়াল কথোপকথন ঠুনকো,অগভীর হয়ে গেছে।
- মানসিক সমর্থনের নেটওয়ার্ক দুর্বল হচ্ছে।
অসংখ্য “ফ্রেন্ড” থাকলেও সত্যিকারের বন্ধুত্ব, সহানুভূতি ও সহমর্মিতা কমে যাচ্ছে।
কী করা যায়?
- ডিজিটাল শিক্ষা:স্কুল-কলেজে সচেতনতা গড়ে তোলা দরকার—কীভাবে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতে হবে।
- ডিভাইস-অ্যাকসেসে সমতা:উন্নয়নশীল দেশে সাশ্রয়ী ইন্টারনেট, সস্তা স্মার্টফোন এবং শিক্ষামূলক অ্যাপ সহজলভ্য করা।
- অভিভাবকের ভূমিকা:সন্তানদের অনলাইন সময় সীমিত করা, বিকল্প বিনোদন—খেলা, গল্প বলা—তাদের সঙ্গে ভাগ করা।
- নীতিমালা:সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলো যেন শিশুদের জন্য নিরাপদ কনটেন্ট তৈরি করে এবং আসক্তি কমাতে নীতিমালা মেনে চলে।
সোশ্যাল মিডিয়া একদিকে যোগাযোগের বিপ্লব এনেছে। অন্যদিকে এটি আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য, মনোযোগ, শারীরিক সুস্থতা এবং সামাজিক বৈষম্যে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে প্রযুক্তিগত বৈষম্য—ডিভাইস ও ইন্টারনেট সুবিধার সীমাবদ্ধতা—যুব সমাজকে অসম প্রতিযোগিতার মুখে ফেলেছে। এখন সময় এসেছে এই বিষয়গুলো নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করে নীতি নির্ধারণ ও সামাজিক উদ্যোগ নেওয়ার।