সারাক্ষণ স্টাফ রাইটার
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার তিন বছর পূর্তি হয়েছে এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে। কীভাবে এই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটবে, সেটি ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার নতুন রূপরেখা তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের মধ্যে একটি শীর্ষ বৈঠকের আলোচনা চলছে, তবে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির উপস্থিতি সেখানে থাকছে না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৮০ বছর পূর্তি ও পরিবর্তনশীল বিশ্বব্যবস্থা
এ বছর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার ৮০ বছর পূর্তি। এতদিন ধরে টিকে থাকা যুদ্ধ-পরবর্তী আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা এই গুরুত্বপূর্ণ বার্ষিকীতে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
চীনের লক্ষ্য
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার সময় (১৯৪৫) চীন তখনো কমিউনিস্ট পার্টি দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্র ছিল না। ১৯৪৯ সালে মাও জেদং গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। বর্তমানে, বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধকে ঘিরে, চীন নিজেকে শক্তিশালী সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতাসম্পন্ন দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে প্রস্তুত। চীনা নেতৃত্বের ধারণা, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সম্ভাব্য নতুন সমঝোতায় (“ইয়াল্টা ২.০”) প্রেসিডেন্ট সি জিনপিংকে “নতুন বড় তিন”-এর একজন হিসেবেই গণ্য করা হতে পারে।
ইয়াল্টা সম্মেলনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে কৃষ্ণ সাগরের তীরে ক্রিমিয়ার ইয়াল্টায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল এবং সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্তালিন মিলিত হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থার পরিকল্পনা করেন। জার্মানিকে বিভক্ত করা, জাতিসংঘ গঠন ও নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যপদ দেওয়া—এসব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ওই সম্মেলনেই চূড়ান্ত হয়। ফলাফল হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যপদ পায়।
ইউক্রেন ও সম্ভাব্য ইয়াল্টা ২.০
রাশিয়া-আধিপত্যের ক্রিমিয়ার ইয়াল্টা সেই ঐতিহাসিক সম্মেলনের স্থান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৮০ বছর পূর্তিতে সেখানকার আলোচনার ছায়ায় এখন আবারও ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ নিয়ে আলোচনা হতে যাচ্ছে। ট্রাম্প-পুতিন বৈঠকে ক্রিমিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধ পরিস্থিতি অগ্রাধিকারে থাকবে, তবে উল্লেখযোগ্যভাবে অনুপস্থিত থাকবেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি।
ইউরোপ নিয়ে মার্কিন অবহেলা ও চীনের সুযোগ
অনেকের অভিযোগ, ট্রাম্প প্রশাসন ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে না। সম্প্রতি মার্কিন উপ-প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে এমন মন্তব্য করেছেন, যা এই ধারণাকে আরো জোরালো করে। এই পরিস্থিতিতে সি জিনপিংয়ের লক্ষ্য—যেন ট্রাম্প ও পুতিনের সম্ভাব্য আলোচনা থেকে চীন উপেক্ষিত না থাকে। সামরিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার জোরে সি চান, “নতুন বড় তিন”-এর একজন হিসেবে তাকে গণ্য করা হোক।
চীনের শান্তিরক্ষা পরিকল্পনা
চীনের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র ইঙ্গিত দিচ্ছে, যদি যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধবিরতির আলোচনা চালিয়ে যায়, তবে চীন পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) পাঠাতে প্রস্তুত—শান্তিরক্ষী বাহিনীর অংশ হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, চীন সরাসরি শান্তি প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী এবং যুদ্ধ-পরবর্তী নিরাপত্তা বজায় রাখতে পিএলএ সৈন্য মোতায়েনের প্রস্তাব দিয়েছে।
রাশিয়ার আপত্তি ও বাস্তবতা
রাশিয়া কি ইউক্রেনের মাটিতে চীনা সৈন্য মেনে নেবে—এটি বড় প্রশ্ন। কেননা রাশিয়া নিজেই ইউক্রেনে সেনা অভিযান চালিয়েছে এবং তৃতীয় পক্ষের সামরিক উপস্থিতি সম্পর্কে বরাবরই সংশয়ী। তবু চীন মনে করে, যদি যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতির পর নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তুলতে সাহায্য চায়, তবে পিএলএ মোতায়েনের বিষয়টি আলোচনায় আসবেই।
একটি চিত্রকর্ম ও ইয়াল্টা ২.০ এর আভাস
ক্রিমিয়ার লিভাদিয়া পার্কের একটি গ্যালারিতে “ইয়াল্টা ২.০” শিরোনামের একটি চিত্রকর্ম রয়েছে, যেখানে ট্রাম্প, পুতিন ও সি জিনপিংকে একসঙ্গে দেখানো হয়েছে। স্থানীয়দের ধারণা, এটি তিন নেতার সম্ভাব্য নতুন চুক্তির প্রতীকী উপস্থাপনা।
তাইওয়ান প্রশ্নে সম্ভাব্য প্রভাব
যদি ইউক্রেন যুদ্ধের নিষ্পত্তি এমনভাবে হয় যাতে রাশিয়ার বিশেষ সুবিধা হয়, তবে চীন সেটিকে উদাহরণ হিসেবে দেখে তাইওয়ান ইস্যুতেও তার কৌশলগত অবস্থান জোরদার করতে পারে। চীনা সরকার সবসময়ই তাইওয়ানকে “বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চল” বলে দাবি করে এবং প্রয়োজনে সামরিক উপায়ে সমস্যার সমাধান করতে পিছপা হবে না বলে জানিয়েছে।
সৌদি আরবের মধ্যস্থতা ও চীনের অস্বস্তি
চীন আশা করছিল, তারা হয়তো ইউক্রেন সংকট সমাধানে সরাসরি মধ্যস্থতাকারী হতে পারবে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে সৌদি আরব নতুনভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে আলোচনা পরিচালনার মঞ্চ হয়ে উঠেছে। রিয়াধে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ও রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ বৈঠক করে দ্রুত ও স্থায়ী সমাধানের পথ খোঁজার ব্যাপারে একমত হয়েছেন। চীনের দৃষ্টিতে এটি তাদের নিজস্ব মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নেওয়ার পরিকল্পনায় একটি বড় বাধা।
তাইওয়ান সংক্রান্ত ওয়েবসাইট হালনাগাদে চীনের প্রতিক্রিয়া
যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ওয়েবসাইট থেকে “আমরা তাইওয়ানের স্বাধীনতাকে সমর্থন করি না”—এই বিবৃতি সরিয়ে নেওয়া হলে চীন কড়া প্রতিবাদ জানায়। এতদিন ওয়াশিংটন “ওয়ান চায়না” নীতিকে সম্মান করে আসছিল, যেখানে তাইওয়ানকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়ার কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল। ওয়েবসাইট হালনাগাদের পর যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, তারা চায় শান্তিপূর্ণ উপায়ে চীনা প্রণালীর বিরোধ মিটুক এবং তাইওয়ানের আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণের সুযোগ আরও প্রসারিত হোক।
জাপান ও অন্যান্য প্রসঙ্গ
জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা ও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাম্প্রতিক বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতেও তাইওয়ানের আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণের বিষয়ে সমর্থন জানানো হয়। অন্যদিকে, পানামা খাল নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের মন্তব্য ও চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে মতবিরোধ চলছে।
সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা ও ভবিষ্যৎ
১৯৪৫ সালের ইয়াল্টা সম্মেলনে জার্মানিকে ভাগ করা থেকে শুরু করে ইউক্রেনের ভবিষ্যৎসহ বিভিন্ন গোপন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এখন, ৮০ বছর পর, যদি ট্রাম্প ও পুতিন উভয়ে মিলিত হয়ে ইউক্রেন সংকট নিয়ে নিজেদের ইচ্ছেমতো সমঝোতা করেন, তবে এক নতুন “ইয়াল্টা ২.০”-এর প্রেক্ষাপট তৈরি হতে পারে। এতে বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্যে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে। চীন এই প্রক্রিয়ায় নিজেকে অপরিহার্য করে তুলতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সম্ভাব্য এই নতুন সমঝোতা শুধু ইউক্রেনকেই নয়, এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের ভবিষ্যৎকেও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করতে পারে।