সারাক্ষণ রিপোর্ট
সারাংশ
- শিল্প খাতে প্রয়োজনের তুলনায় ৩০% কম গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে
- গ্যাস সংকট মোকাবিলায় সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিচ্ছে
- গ্যাস সংকটের কারণে শতাধিক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে অথবা বন্ধ হওয়ার পথে
- অতিরিক্ত বিদ্যুৎ খরচ এবং নিয়মিত জেনারেটর নষ্ট হওয়ার কারণে নিট পোশাক রপ্তানিতে ৪০% পতন হয়েছে
দেশের বেশ কিছু বড় শিল্পাঞ্চলে গ্যাসের চাহিদার সঙ্গে সরবরাহের মিল নেই। ফলে শিল্প কারখানাগুলো ধীরে ধীরে চরম সংকটের দিকে যাচ্ছে। শুধুমাত্র প্রোডাকশন বন্ধ নয়, অনেকে মনে করছে এ অবস্থায় কারখানা বন্ধ রাখলে তাদের জন্যে লাভজনক। এমনকি দেশের মূল শিল্প গার্মেন্টস এর ক্ষেত্রেও ঘটছে এমন ঘটনা।
গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহের বাস্তবতা
- দৈনিক চাহিদা: প্রায় ৪২০ কোটি ঘনফুট।
- বর্তমান সরবরাহ: ২৮৫ কোটি ঘনফুট (এলএনজির মাধ্যমে ৯৫ কোটি ঘনফুট)।
- বণ্টন:
- বিদ্যুৎ: ৯৬ কোটি
- শিল্প: ১১৮ কোটি
- সার কারখানা: ১৩ কোটি
- সিএনজি: ১ কোটি
- আবাসিক-ব্যবসায়: ৫৭ কোটি
শিল্প খাতে সংকটের গভীর প্রভাব
- কারখানার কার্যক্রমে ব্যাঘাত: শতাধিক কারখানা বন্ধ বা বন্ধের প্রান্তে, যার ফলে উৎপাদনে ব্যাপক ক্ষতি।
- কর্মসংস্থান ও রপ্তানি: উৎপাদন কমে যাওয়ায় কর্মচারীদের ছাঁটাই হচ্ছে, রপ্তানি হ্রাস পাচ্ছে এবং বিদেশী কাঁচামালের আমদানি খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
- ব্যবসায়ীদের মন্তব্য: বেশিরভাগ ব্যবসায়ী মনে করছেন—কারখানা চালু রাখলে ক্ষতি, বন্ধ করলে তুলনামূলকভাবে লাভজনক হতে পারে।
- গ্যাসের ঘাটতি: দৈনিক প্রায় ১৩৫ কোটি ঘনফুট গ্যাসের অভাব।
- সরবরাহে অমিল: শিল্পের প্রয়োজনের তুলনায় গ্যাসের সরবরাহ ৩০% কম।
- প্রভাবিত অঞ্চল: গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, নরসিংদীসহ বিভিন্ন শিল্প এলাকা।
- মূল সমস্যা: উৎপাদনের বাধা, কর্মসংস্থানের সমস্যা, রপ্তানি কমে যাওয়া ও কাঁচামালের আমদানির অতিরিক্ত ব্যয়।
টেক্সটাইল শিল্পে সংকটের বাস্তবতা
- গ্যাসের ব্যবহার: বাষ্প তৈরিতে ৭৫% ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২৫% গ্যাস ব্যবহৃত হয়।
- চাপের সমস্যা: প্রয়োজনীয় ১৫ পিএসআই-এর পরিবর্তে মাত্র ১-২ পিএসআই পাওয়া যাচ্ছে।
- জেনারেটরের কার্যক্ষমতা কমে গিয়ে উৎপাদন মাত্র ৩০-৩৫%।
- অতিরিক্ত বিদ্যুৎ খরচ ও নিয়মিত জেনারেটর নষ্ট হওয়ার সমস্যা।
- ফলাফল: নিট পোষাক রপ্তানিতে ৪০% পতন এবং কাঁচামালের আমদানিতে অতিরিক্ত ব্যয়।
অঞ্চলভিত্তিক প্রভাবের বিশ্লেষণ
গাজীপুর:
- প্রায় ২৫০০ শিল্প প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও, প্রয়োজনীয় চাপের পরিবর্তে মাত্র ১-২ পিএসআই পাওয়া যাচ্ছে।
- ফলস্বরূপ, যন্ত্রপাতি ক্ষয়, কর্মচারীদের বেতন প্রদান ও ছাঁটাইয়ের সমস্যা।
সাভার ও আশুলিয়া:
- অধিকাংশ কারখানায় গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন লাটে গেছে।
- ডিজেল চালানোর ফলে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি; ইতোমধ্যে ১৫ থেকে ২০ কারখানা বন্ধ হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী:
- বহু ডাইং কারখানা বন্ধ হয়েছে।
- নিম্ন চাপের কারণে উৎপাদন ৩৫-৪০% কমে গেছে।
- শূন্য বা খুব কম চাপের কারণে কারখানা ও জেনারেটরের কার্যক্রম স্থগিত।
গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি ও বিনিয়োগের প্রভাব
- বর্তমান মূল্য: শিল্প কারখানায় প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৩০ টাকা, ক্যাপটিভ পাওয়ারে ৩০.৭৫ টাকা।
- প্রস্তাবিত নতুন মূল্য: নতুন কারখানার ক্ষেত্রে দাম বাড়িয়ে ৭৫.৭২ টাকা করার পরিকল্পনা।
- উচ্চ দাম শিল্পে নতুন বিনিয়োগে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
- বিনিয়োগকারীদের মতে, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এই মূল্যবৃদ্ধি ক্ষতির সম্ভাবনা বৃদ্ধি করবে।
বিশেষজ্ঞ ও শিল্পপক্ষের মন্তব্য
- ব্যবসায়ী অভিযোগ: গ্যাস সংকট চালু রাখলে ব্যাপক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে, ফলে অনেক কারখানা বন্ধ রাখতে পারলে লাভের সম্ভাবনা বাড়ে।
- সরকারি উদ্যোগ: বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা জানিয়েছেন, সরকার গ্যাস সংকট মোকাবিলায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিচ্ছে।
- অর্থনৈতিক প্রভাব: পোশাক শিল্প দেশের রপ্তানি আয়ের ৮৩% অংশ নিয়ন্ত্রণ করে; সংকট দীর্ঘস্থায়ী হলে সামগ্রিক অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব পড়বে।
উপসংহার
গ্যাস সংকট শিল্প উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও রপ্তানি ক্ষেত্রে মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করছে। উৎপাদনের ব্যাঘাত, বাড়তি খরচ ও কর্মসংস্থান হ্রাস ছাড়াও, নিম্ন গ্যাস চাপ কারখানার কার্যক্রমে বড় ধরনের বিঘ্ন ঘটিয়েছে। এই সমস্যা মোকাবিলায় সরকার ও শিল্পক্ষেত্রের মধ্যে দ্রুত সমন্বয় ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।