লিটন রহমান
অনেকটা অভ্যাসেই পরিণত হয়েছে এসি বাসে ওঠার । হ্যা “ ঢাকার চাকা”ই এখন রাজধানী ঢাকার একটি মাত্র এসি বাস সার্ভিস। কাউন্টারে আগে টিকিট কেটে লাইন ধরে সেই বাসে ওঠেন গুলশান-বনানীতে যাতায়াতকারীরা। বেশিরভাগই করপোরেট অফিসের মধ্যমসারির কর্মী। তাদের সাথেই প্রায় যাই শুটিং ক্লাব থেকে গুলশান দুইয়ের আগে আগোরা স্টান্ডে। দ্বিতীয় রোজায় গত ৩ মার্চ ইফতারের আগে আগেই বনানী থেকে দুই নম্বর গোলচক্করের ডিসিসি মার্কেট লাগোয়া ঢাকার চাকার স্টান্ডে পৌছতেই দেখি যাত্রীদের লম্বা লাইন আছে,কিন্তু নেই একটি বাসও। এটি এই রুটের সূচনাস্থল, সবসময় দাড়ানো থাকে একাধিক বাস। সুশৃঙ্খল সুবেশি যাত্রী সব। সারি বেধে দাড়িয়ে আছেন বাসের অপেক্ষায়! ছোট্ট পজ মেশিন থেকে এক টুকরো চিরকুটের মত সাদা পাতলা কাগজের টিকিট দেয়ার সময় কাউন্টারের লোকটা বললেন, বাস আসতে দেরী হতে পারে!
সেই দেরিটা কতক্ষণ হতে পারে বুঝতে পারি নাই। করপোরেট জব করেন এমন একজন নারী পিছে এসে দাড়ালেন সেলফোনে কথা বলতে বলতে । “ না কোনো বাস নেই ,কতক্ষণে আসবে বুঝতে পরছি না,এক নম্বর যাবো তারপর মোহম্মদপুরের বাস ধরবো। জানিনা পৌছতে পরবো কি না ? নাতো আমাদের ফ্লাটের কাছেই খুশীখালরার বাসা। হাটার দুরত্ব। সবাই চলে যাবে। আমি মনে হয় ইফতারের পরেই যাবো। কালও রাস্তায় ইফতার করেছি, আজো একই অবস্থায় পড়তে যাচ্ছি,এইটা হলো কিছু ? প্রথম ইফতারও বাসার বাইরে,আজো তাই,ভাল্লাগছে না ‘’।
ঐ নারীর পিছেও আরো অনেকে। ডিসিসি মার্কেটের কোনায় কতগুলো মটরবাইক । দুএকজন ইশারা করলেন বাইক রাইডে যাবো কি না ? হাতে তখন ২৫ টাকার ঢাকার চাকার টিকিটি। জানিনা এর মেয়াদ কতক্ষণ ? যদি আজ না যাই বাসে ? ফুটপাত ঘেষে হটাৎ দেখি খালি সিএনজি! মামা যাবেন নাকি ? মাথা নাড়িয়ে জানিয়ে দিলেন ‘না’ সূচক ইচ্ছেটা। মামা কি নিজে কোথাও ইফতারে যাচ্ছেন যে ,যাত্রী নিবেন না,আহা স্বাধীন পেশা। কথাটা মাথায় এলো যাত্রী সারিতে থাকা দুজনের কথপোকথনে। বোঝাই যায়- দুই সহকর্মী। “ নারীর কন্ঠে ঝাঝ আছে!” বসের আর কি? “ ওনার বাসা তো অফিস থেকে ১০ মিনিট,গাড়িও লাগে না। মিটিংয়ে তুললাম, স্যার সাড়ে তিনটার বদলে তিনটায় ছেড়ে দেন,সবার ট্রান্সপোর্ট পেতে সুবিধা হয়। এইচ আরের রূপক স্যার উল্টো বলে দিলেন । ওনার কি? অফিসের গাড়িতে লিফট নেন,আমাদের তো আর পিক-ড্রপ নাই” । হঠাৎ নড়েচড়ে উঠলো ঢাকার চাকার যাত্রী সারিটা। সড়কের উল্টো দিকেই একটা বাস । মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ফ্রেশ ব্রান্ডের জামা গায়ে ( বিজ্ঞাপন) যানজট পেরিয়ে এগিয়ে আসছে। ওয়েস্টিন হোটেলের সামনে থেকে গুলশান দুইয়ের গোল চক্কর পেরিয়ে এপারে আসতে সময় নিল ১২ মিনিট । এর নাম যানজট।
বাসে সিট ৪০ । কখনও দাড়িয়ে থাকে স্বল্প দুরত্বের যাত্রীরা। কিন্তু কাউন্টার থেকে বলা হলো এখন দাড়ানো যাত্রী নেয়া যাবে না। ক্ষেপে গেলেন অনেকটা সময় ধরে দাড়িয়ে থাকা যাত্রীরা,তখন সবারই দ্রুত বাসায় যাবার তাড়া, বাসায় ইফতার করার আসায়। জোরজার করে ওঠা গেলো। ভেতরে দাড়িয়ে শুনলাম ড্রাইভার ধমক দিচ্ছে কেন দাড়ানো যাত্রী নিল হেল্পার ? বোঝা গেলো যানজটে আটকা পড়ে মেজাজ তিরিক্ষি তার। সামনেও এগুতে পারছেন না। সব গাড়ি থমকে আছে,একবারে বাম্পার টু বাম্পার অবস্থা। যতদুর চোখ যায় শুধু গাড়ি আর গাড়ি। অডি,র্যাঞ্জরোভার থেকে শুরু করে সিএনজি আর তার মাঝেই বৈষম্য দুর করার ঈংগিতে ব্যটারিচালিত রিক্সা । ১০ মিনিট কেটে গেলো। যে নারী এক নম্বর গোল চক্কর গিয়ে মোহম্মদপুরের দোতালা বাস ধরবেন তিনি ছটফট করছেন। একটু এগিয়ে বাসটা আবারো জ্যামে আটকে যেতেই নেমে গেলেন তিনি ,হেটে চলে যাবেন এক নম্বরে। বাসটা তখন দেশের এক্সপোর্ট জায়েন্ট “ জাবের এন্ড জুবায়ের” ডিসপ্লে গ্যালারির গা ঘেষে। সেই রপ্তানীর মূল শক্তিও নারী শ্রমিক,তাদের কি এসি বাসে অফিস যাওয়ার সুয্গে হবে কোনো দিন ?
শামুকের চেয়েও কম গতিতে এগোয় ঢাকার চাকা। চালকের মাথার ওপর ডিজিটাল ঘড়ির ডিসপ্লে। আমার সেলফোনের সময়রে সাথে তার পার্থক্য সাত মিনিটের। এক নম্বরের গোলচক্কর কোনো রকমে পার হলো দেশি বডির বিদেশি ইঞ্জিনের বাস। এবার একটা সিট পেয়ে গেলাম। গোলচক্কর থেকে আবারো বাস ভরে গেলো দ্রুতগতিতে,অথচবাস চলছে খুবই ধীরগতিতে। আশে পাশে অনেকের হাতেই দেখি পানির বোতল । বাসেই ইফতারের প্রস্তুতি। এক নং গোল চক্কর থেকে পুলিশ প্লাজার মাঝামাঝি মসজিদের সামনে নেমে গেলেন আরো কয়েকজন। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি বাসের ডিসপ্লে ঘড়িটা অফ হয়ে গেছে। সেলফোনে ৫.৫২। আজ ইফতার ঢাকায় ৬.০২ । পুলিশ প্লাজার সামনে ব্রেক কষতেই ইফতারের আজান। প্রায় সবাই হুড়মুড় করে নেমে গেলো। জনা কয়েক যাত্রী নিয়ে ড্রাইভার বাসটা টান দেয়ার আগেই নেমে গেলাম। হিসেব করে দেখলাম গুলশান দুই থেকে পুলিশ প্লাজা পর্যন্ত আসতে সময় লাগলো ৫০ মিনিট। হায় যানজট , হয়তো হেটে এলেও ২০/২৫ মিনিটে আসা যেত। ২০ টাকায় হাফ লিটারের একটা ঠান্ডা পানির বোতল নিয়ে বসলাম । এক প্লেট চাউমিন ২০০ টাকা হাকলো ইট-ইটালিয়ার সেলসর্গাল। বড্ড বেশি লাভ করে এরা ,খাবোই না । এরপর হাতিরঝিল চক্রাকার বাস সার্ভিসের কাউন্টারের পাশের বেঞ্চে বসলাম। পরের গন্তব্য এফডিসি। আবারো বাসের অপেক্ষায় !