সারাক্ষণ রিপোর্ট
সারাংশ
-
মুদ্রা বিনিময় হারের অস্থিরতা, দেশের ক্রেডিট রেটিং হ্রাস এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোর ঋণ সীমা কমানোর কারণে বেসরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ কমেছে।
-
গত এক বছরে বায়ার্স ক্রেডিট ও স্বল্পমেয়াদি ঋণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে, যার ফলে আমদানিকারকরা আগের মতো ঋণ সুবিধা পাচ্ছে না।
-
রেমিট্যান্স ও রপ্তানি ইতিবাচক থাকলেও আগামী কয়েক মাসে স্বল্পমেয়াদি ঋণের পরিস্থিতির বড় কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা কম। মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীল করা এবং দেশের ক্রেডিট রেটিং উন্নত করা প্রয়োজন।
দেশের বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ প্রায় চার বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো $১০ বিলিয়নের নিচে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারিতে এই ঋণের পরিমাণ ছিল $৯.৮ বিলিয়ন, যা ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে সর্বোচ্চ $১৬.৪২ বিলিয়ন ছিল।
এর আগে, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ঋণের পরিমাণ ছিল $৯.২ বিলিয়ন। ২০২১ সালের শেষে এটি বেড়ে $১৫.৪৬ বিলিয়নে পৌঁছেছিল, মাত্র এক বছরের ব্যবধানে প্রায় $৬ বিলিয়ন বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।
ঋণ হ্রাসের প্রধান কারণসমূহ
মুদ্রা বিনিময় হারের অস্থিরতা
ব্যাংকাররা বলছেন, গত দুই বছরে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমাগত কমেছে। এই কারণে বিদেশি ব্যাংক ও ঋণদাতাদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। এর ফলে নতুন ঋণ অনুমোদনের পরিমাণ কমছে এবং আগের তুলনায় ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে উঠেছে।
দেশের ক্রেডিট রেটিং হ্রাস
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিং কমিয়ে দিয়েছে, যা বিদেশি ঋণদাতাদের আস্থার সংকট আরও গভীর করেছে। এর ফলে, বিদেশি ব্যাংকগুলো বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর ঋণসীমা কমিয়ে দিয়েছে, যা স্বল্পমেয়াদি ঋণের পরিমাণ কমার অন্যতম কারণ।
৩. আমদানিকারকদের জন্য বৈদেশিক ঋণের আকর্ষণ কমে যাওয়া
একজন শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি ব্যাংকের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন,
“আমরা আগের মতো বিদেশি সরবরাহকারীদের কাছ থেকে একই পরিমাণ ক্রেডিট সুবিধা পাচ্ছি না। ফলে বড় পরিসরে ডেফার্ড এলসি (বিলম্বিত ঋণের মাধ্যমে আমদানির সুবিধা) খোলা সম্ভব হচ্ছে না।”
তিনি আরও বলেন, যদিও আন্তর্জাতিক ঋণের সুদের হার কিছুটা কমেছে, তবে মুদ্রা বিনিময় হারের অনিশ্চয়তার কারণে আমদানিকারকদের মধ্যে ঋণ গ্রহণের আগ্রহ কমে গেছে।
বায়ার্স ক্রেডিট ও স্বল্পমেয়াদি ঋণের পতন
বায়ার্স ক্রেডিটের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে যেখানে এই ঋণের পরিমাণ ছিল $৫.৯৭ বিলিয়ন, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে তা কমে $৫.০৮ বিলিয়নে নেমে এসেছে। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে প্রায় $৯০০ মিলিয়ন কমেছে।
একইভাবে, স্বল্পমেয়াদি ঋণের পরিমাণও কমেছে। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে এই ঋণের পরিমাণ ছিল $২.৮ বিলিয়ন, যা ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে নেমে এসেছে $২.০৫ বিলিয়নে।
দীর্ঘমেয়াদি ঋণের সংকোচন
ব্যাংকারদের মতে, বিদেশি ব্যাংকগুলো এখন আর আগের মতো দীর্ঘমেয়াদি ঋণ প্রদান করছে না। যেখানে আগে এক বছরের জন্য ঋণ অনুমোদিত হতো, এখন তা ছয় মাসে নেমে এসেছে।
একজন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন,
“আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলো প্রায় সব বাংলাদেশি ব্যাংকের জন্য ঋণ সীমা কমিয়েছে। ফলে ইউপিএএস এলসি (Usance Payable at Sight Letter of Credit) এবং বায়ার্স ক্রেডিট সুবিধা দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। এমনকি কিছু বিদেশি ব্যাংক বাংলাদেশি ব্যাংকের সঙ্গে ঋণ লেনদেনই করতে চাইছে না। ফলে সামগ্রিকভাবে বায়ার্স ক্রেডিটের পরিমাণ কমে যাচ্ছে।”
মুদ্রা বিনিময় হারের অস্থিরতা ও সুদের হার পরিবর্তন
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে আন্তর্জাতিক ঋণের ক্ষেত্রে ৮% সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে, যা SOFR (Secured Overnight Financing Rate) ভিত্তিক। অন্যদিকে, স্থানীয় মুদ্রার ঋণের সুদের হার ১২%। ফলে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করলে ৪% সুদ সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে।
তবে একজন সিনিয়র ব্যাংকার বলেন,
“যদিও বৈদেশিক ঋণে সুদের হার কম, কিন্তু মুদ্রা বিনিময় হারের অস্থিরতার কারণে অনেক গ্রাহক বৈদেশিক ঋণ নিতে আগ্রহী নন।”
রিজার্ভের অবস্থা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারির শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল $১৯.৯৬ বিলিয়ন। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতেও একই পরিমাণ রিজার্ভ রয়েছে, অর্থাৎ এই সময়ে রিজার্ভ কমেনি বা বাড়েনি।
ব্যাংক এশিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সোহেল আর কে হুসাইন বলেন,
“যখন মুদ্রা বিনিময় হারের অস্থিরতা থাকে, তখন আমদানিকারকরা দৃষ্টিপত্র এলসি (sight LC) খোলার প্রতি বেশি মনোযোগী হন। কারণ, ডেফার্ড এলসি খোলার ক্ষেত্রে মুদ্রা বিনিময় ঝুঁকি থাকে এবং নিশ্চিতকরণ চার্জ পরিশোধ করতে হয়।”
তিনি আরও বলেন,
“বর্তমানে রেমিট্যান্সের প্রবাহ ভালো এবং রপ্তানি কার্যক্রমও ইতিবাচক প্রবণতায় রয়েছে। যদি এই দুটি খাত ভালো পারফর্ম করে, তাহলে মুদ্রা বিনিময় হারের ওপর চাপ কমবে। তবে আগামী ৪-৫ মাসের মধ্যে বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের পরিস্থিতিতে বড় কোনো পরিবর্তন আসবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে।”
উপসংহার
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। মুদ্রা বিনিময় হারের অস্থিরতা, দেশের ক্রেডিট রেটিং হ্রাস, বিদেশি ব্যাংকগুলোর ঋণ সীমা কমানো এবং আমদানিকারকদের অনাগ্রহ – এসব কারণে ঋণের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে।
যদিও রেমিট্যান্স ও রপ্তানি খাত ইতিবাচক প্রবণতায় রয়েছে, তবু ব্যাংকাররা মনে করছেন, আগামী কয়েক মাসে স্বল্পমেয়াদি ঋণ পরিস্থিতির বড় কোনো পরিবর্তন হবে না। ঋণ প্রবাহ স্বাভাবিক করতে হলে মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীল করা এবং দেশের ক্রেডিট রেটিং উন্নত করা জরুরি।