লেখা ও আলোকচিত্র: ভিনচেনজো মন্টেফিনেসে
ফাথি (৪৭) এন’কোব শহরের একটি খাল থেকে পানি ভর্তি পাত্রগুলো ভরছেন। খরার কারণে মরক্কোর সরকার ফুলের বাগান ও গলফ কোর্স সেচে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। আটলাস পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত অনেক গ্রামে কূপ ব্যবহার সপ্তাহে একবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ, ফলে পানি সংগ্রহের জন্য দীর্ঘ লাইন দেখা যাচ্ছে।
একসময় প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর ছিল যে মরূদ্যানগুলি, সেগুলো এখন উচ্চ তাপমাত্রা, দীর্ঘস্থায়ী খরা ও অনিয়ন্ত্রিত পানি ব্যবস্থাপনার কারণে শুকিয়ে যাচ্ছে। সাহেল অঞ্চলে মরুকরণের যে প্রক্রিয়া চলছে, তার চড়া মূল্য দিচ্ছে মরক্কো। শুকিয়ে যাওয়া, অগ্নিকাণ্ডে ধ্বস্ত ও ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হওয়া এসব মরূদ্যানকে প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট—উভয় ধরনের কারণই মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে ফেলেছে।
মরোক্কোর কৃষি মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট ভূখণ্ডের প্রায় ১৫ শতাংশজুড়ে থাকা এবং প্রায় ২০ লক্ষ মানুষের আবাস এই মরূদ্যানগুলি গত শতকে নিজেদের দুই-তৃতীয়াংশ ভূমি হারিয়েছে। অর্থনীতি ও মরূদ্যানের বাস্তুতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ খেজুরগাছের সংখ্যা ১ কোটি ৫০ লক্ষ থেকে কমে মাত্র ৬০ লক্ষে নেমে এসেছে।
দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের দ্রা উপত্যকায় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়, যেখানে উচ্চ অ্যাটলাস পর্বত থেকে উত্পত্তি হওয়া মরক্কোর দীর্ঘতম নদী দ্রা এখন ক্রমশ কম প্রবাহিত হয়। বাঁধ নির্মাণ ও কৃষি বা শিল্পকার্য পরিচালনার জন্য অতিরিক্ত পানি ব্যবহারে পরিস্থিতি আরও সংকটাপন্ন হয়েছে, মরূদ্যানগুলোর বেঁচে থাকা এখন হুমকির মুখে।
সাইফ (৪৯), তিনজুলিন, দ্রা উপত্যকায়, খেজুরগাছে বিশেষ সবুজ জাল দিয়ে খেজুরকে পোকা ও রোগবালাই থেকে রক্ষা করছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খরা ও উচ্চ তাপমাত্রার কারণে এসব সমস্যা বেড়ে গেছে।
গত কয়েক বছরে দৃশ্যপট ব্যাপকভাবে বদলে গেছে: দ্রা নদীর উপর নির্মিত সেতুগুলো এখন আর কোনো পানির প্রবাহ নয়, বরং শুকিয়ে যাওয়া নদীতীরের দুই প্রান্তকে সংযুক্ত করে। বিস্তীর্ণ সবুজ এলাকাগুলো রুক্ষ, অনুর্বর জমিতে রূপান্তরিত হয়েছে। বৃষ্টিপাতের অভাব আর বেড়ে যাওয়া তাপমাত্রায় মরূদ্যানের স্বাভাবিক জলব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটছে।
প্রাচীন খাতারা পদ্ধতি—যেখানে ভূগর্ভস্থ জলাধার থেকে সুড়ঙ্গের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করা হতো—চরম খরার মুখে আর যথেষ্ট নয়। আরো গভীর কূপ খুঁড়তে গিয়ে মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে, ফলে অনেক কৃষিজমি অনুর্বর হয়ে পড়ছে।
একজন নারী এখন পানিশূন্য দ্রা নদীর তীরে হাঁটছেন। এই নদী মরক্কোর দীর্ঘতম নদী, যা উচ্চ অ্যাটলাস পর্বতমালার দাদেস ও ইমিনি নদী থেকে ১,১০০ কিলোমিটার পথে সাহারার বালিয়াড়ি পেরিয়ে আটলান্টিক মহাসাগরের ক্যাপ দ্রা অঞ্চলে গিয়ে মিলিত হয়। পর্বতমালা, খেজুরবাগান ও বার্বার সম্প্রদায়ের গ্রাম অতিক্রম করে যাওয়ার পথে এই নদীর পানি কৃষিকাজের জন্য অপরিহার্য।
নিয়মিত বৃষ্টিপাত না থাকায়, অল্প যে সবুজ এলাকা টিকে আছে সেগুলো পুরোদমে মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। স্থানীয়রা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে মানিয়ে নিতে। কেউ কেউ নতুন পদ্ধতির আশ্রয় নিচ্ছেন—যেমন বৃষ্টির পানি ধরে রাখা ও প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে মাইক্রো-সেচব্যবস্থা গড়ে তোলা। আবার কেউ কেউ পর্যটনের মাধ্যমে অর্থনীতি সচল রাখতে চান; পুরোনো কাসবা ও কারাভানসেরাইকে অতিথিশালায় রূপান্তরিত করা হচ্ছে। কিন্তু পানি ব্যবস্থাপনায় স্থায়ী সমাধান না করলে পর্যটনও পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলতে পারে।
সালিম এল কাবির (৪২) দ্রা নদীর কাছে খেজুরবাগান সেচের জন্য ব্যবহৃত কূপ থেকে পানি তোলার পাম্প চালাতে সৌরপ্যানেল সামঞ্জস্য করছেন। ক্রমবর্ধমান খরার কারণে দ্রা নদী অববাহিকায় কৃষকরা অনেক সময় অবৈধভাবে নতুন কূপ খুঁড়ে ভূগর্ভস্থ পানির খোঁজ করছেন।
ঘনিষ্ঠভাবে পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, স্থানীয় ওইসব উদ্যোগ মরুকরণ ঠেকাতে যথেষ্ট নয় এবং কেন্দ্রীয় প্রশাসনের কাছ থেকে বড় পরিসরে সমর্থন প্রয়োজন। রাবাত সরকার ইতোমধ্যে টেকসই পানি ব্যবস্থাপনার জন্য কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে। তার মধ্যে ‘সবুজ পরিকল্পনা’ নামে একটি উদ্যোগ রয়েছে, যেখানে মরু এলাকায় পুনরায় বনায়ন, পানি সংরক্ষণ ও পরিশোধনের জন্য নতুন পরিকাঠামো তৈরির পরিকল্পনা আছে। তবে এই সব পরিকল্পনার বাস্তবায়ন এখনও ধীর গতির এবং তহবিলের অভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে।
তৌদা ইহসিস্ন (৩৫) ও তাঁর সন্তানেরা—মারিয়াম (১৫), ফাতিমা (১৩) ও রাশিদ (১১)—উচ্চ অ্যাটলাস পর্বতের অঞ্চল ঘিরে যাযাবর জীবনযাপন করেন। তাঁবু বানাতে তাঁরা উট ও ছাগলের লোম ব্যবহার করেন। গত বিশ বছরে খরা ও বেড়ে যাওয়া মরুকরণের প্রভাবে খাদ্যের অভাব তীব্র হওয়ায় অনেক আইত আত্তা পরিবার যাযাবর জীবন ছেড়ে শহরমুখী হয়েছে।
বিশ্ব ব্যাংক ও জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা মরূদ্যানগুলোকে রক্ষা করতে স্থিতিশীলতার উদ্যোগ নিচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, খরা-সহনশীল শস্যের প্রচলন ও কম পানি ব্যবহার করে এমন চাষপদ্ধতি প্রসারের চেষ্টা চলছে। কিন্তু এত কিছুর পরেও মরুকরণের ক্রমবর্ধমান সমস্যায় তেমন প্রভাব পড়ছে না।
তিনেরহির মরূদ্যানের এক বিরাট অংশের দৃশ্য, যা টোদরা নদীর ধারে প্রায় ৩০ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত। দক্ষিণ-পূর্ব মরক্কোর এই অঞ্চলে রয়েছে সবুজ খেজুরবাগান ও প্রাচীন কাদামাটির কাসবা।
এখানে ঝুঁকিতে রয়েছে কেবল প্রকৃতিক পরিবেশ নয়, বরং এই অঞ্চলের মানুষের সংস্কৃতিও। উচ্চ অ্যাটলাস ও জবল সাগরোর মধ্যবর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী আমাজিঘ উপজাতি আইত আত্তারা ঘন ঘন খরার মুখে পড়ে পশুদের জন্য খাদ্য জোগাড় করতে অক্ষম হয়ে পড়ছেন। ফলে ঐতিহ্যবাহী যাযাবর-প্রাণিসম্পদ-নির্ভর জীবিকা ছেড়ে শহরে পাড়ি জমাতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে গ্রামীণ ও শহুরে জীবনের ফারাক বাড়ছে, হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি।
আহমেদ এল মানডোরি (৭২) খাতারা সেচব্যবস্থার পানি প্রবাহিত করার খালের মুখ খুলছেন, যাতে সপ্তাহে দু’বার খেজুরক্ষেত সেচের জন্য পানি পেতে পারেন।
চাষের জমি ক্রমে পরিত্যক্ত হওয়ার কারণে অগ্নিকাণ্ডের প্রবণতা বেড়ে গেছে। এসব আগুন খেজুরবাগান ও কৃষিক্ষেত ধ্বংস করে মরুভূমির বিস্তার আরও ত্বরান্বিত করছে। সম্প্রতি দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে বেশ কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডে বিশাল এলাকা পুড়ে গেছে, যেখানে খরা ও সাহারার উষ্ণ বাতাস আগুনকে আরো ভয়াবহ করে তুলেছে।
জাইদ ওউখাজাইদ (৫৬), ইমাজিঘেন সম্প্রদায়ের একজন ব্যক্তি, জবল সাগরোতে তাঁর গবাদিপশুর জন্য ঘাস সংগ্রহ করে নিয়ে যাচ্ছেন। সাম্প্রতিক খরায় পশুখাদ্যের অভাব তীব্র হয়েছে।
তিনজুলিন, দ্রা উপত্যকায় সম্পূর্ণ শুকিয়ে যাওয়া ও পরিত্যক্ত একটি কূপ খেজুরবাগানের মধ্যে বিরাজ করছে।
একজন ব্যক্তি এরগ শেবি মরুভূমির কিনারায় তাঁর পশুদের জন্য খড়ের গাঁট কিনছেন। প্রচণ্ড খরায় সেখানকার চারণভূমি ক্রমেই অপ্রতুল হয়ে পড়ছে।
ইসসাম মোহা (৪৬), আফুরের সম্প্রদায়ের এক যাযাবর, জবল সাগরোর এক কূপের পানি কতটা অবশিষ্ট আছে তা দেখতে নেমে যাচ্ছেন। পানি সরবরাহের অনিশ্চয়তা প্রতিটি কূপ-যাত্রাকেই দুশ্চিন্তা ও উৎকণ্ঠার কারণ করে তুলেছে।
অনেক পরিবার বসতবাড়ি ছেড়ে বড় শহরে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। জলবায়ু সংকট ও বাধ্যতামূলক অভিবাসনের এ ছবিতে প্রশ্ন উঠছে মরূদ্যানগুলোর ভবিষ্যৎ ও মরক্কোর সক্ষমতা নিয়ে।
প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য হারিয়ে যাচ্ছে, পাশাপাশি ক্ষয় হচ্ছে স্থানীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। দেশের এই অমূল্য সম্পদ হারিয়ে যাওয়ার ফল গোটা দেশই একদিন ভোগ করতে বাধ্য হবে।