মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:৪৪ অপরাহ্ন
শিরোনাম :

মেরুঅঞ্চলে দ্বায়িত্বশীল ভ্রমন  

  • Update Time : বুধবার, ১৯ মার্চ, ২০২৫, ১০.০০ পিএম

থিয়া দে গালিয়ার

পোলার বা মেরু-ভূমি অঞ্চলে পর্যটনের জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছেআর বিশেষজ্ঞরা এর পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে সতর্কতা জানাচ্ছেন। পরিবহনের ধরন থেকে শুরু করে স্থানীয় খাদ্যকীভাবে এই নাজুক বাস্তুতন্ত্রকে রক্ষা করে দায়িত্বশীলভাবে ভ্রমণ করা যায়তা এখানে তুলে ধরা হলো।

আমি প্রথম গ্রিনল্যান্ড সম্পর্কে জানতে পারি আমার ছোটবেলার শোবার ঘরের দেয়ালে টাঙানো একটি বিশ্ব মানচিত্র থেকে। বহু বছর পরআমি শেষ পর্যন্ত দেশটির রাজধানী নুক শহরে পৌঁছাই। ছোটবেলা থেকে যেসব উজ্জ্বল রঙের কাঠের ঘরের ছবি দেখতামলালহলুদসবুজ ও নীলসেসব আর তাদের পেছনে বরফে মোড়া দৃশ্য আমাকে ভীষণ টানত। সমুদ্র উপকূলে ভেসে বেড়ানো ক্ষুদ্র বরফখণ্ডচারদিকে গাছের অনুপস্থিতিসব মিলিয়ে যেন অন্য জগত। ঠান্ডাতীব্র বাতাস উপভোগ করানুক কুনস্টমিউজিয়ামে ইনুইট শিল্পের নমুনা দেখাআর ভাগ্য ভালো হলে সীল বা তিমির দেখা পাওয়ার আশায় ছিলাম।

শুধু আমিই নইগ্রিনল্যান্ডের এই বরফসুন্দর স্থানে অনেকেরই আকর্ষণ বেড়েছে। ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে দেশটিতে পর্যটকের সংখ্যা ৪৬% বেড়ে ২০২৩ সালে ১,৩১,৭৬৭ জনে পৌঁছেছে। এর বেশিরভাগই বড় বড় ক্রুজ জাহাজের কারণেযা আর্টিক মহাসাগরে চলাচল করছে।

আর্কটিক কাউন্সিলের তথ্য অনুযায়ীআর্কটিক পোলার কোড এলাকায় (উত্তর মেরুকে ঘিরে একটি নিয়ন্ত্রিত সামুদ্রিক অঞ্চলে) ঢোকা জাহাজের সংখ্যা ২০১৩ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ৩৭% বেড়েছে। হার্টিগ্রুটেনসোয়ান হেলেনিক ও পনঁ-র মতো অনেক ক্রুজ অপারেটর আইসল্যান্ডস্ভালবার্ড ও গ্রিনল্যান্ডের রুট চালু রেখেছে। গ্রিনল্যান্ডের পর্যটন আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছেকারণ ২০২৪ সালে নুক বিমানবন্দরের সম্প্রসারণ এবং ২০২৬ সালের মধ্যে দুটি নতুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।

অপর দিকে পৃথিবীর অন্য প্রান্তেঅ্যান্টার্কটিকাতেও পর্যটন ক্রমেই বাড়ছে। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) উল্লেখ করছে১৯৯০-এর দশক থেকে সেখানে ধীরে ধীরে পর্যটক বেড়েছে। ২০২২-২৩ মৌসুমে ১,০৪,৮৯৭ জন অ্যান্টার্কটিকা সফর করেছেযা গত বছরে ১,২৪,২৬২-এ দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে ৮০,০০০-এর বেশি মানুষ স্থলে পা রেখেছেনযা গবেষকদের দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। কারণমানুষের উপস্থিতি সংবেদনশীল বাস্তুতন্ত্রকে ব্যাহত করতে পারেপ্রাণীদের স্বাভাবিক আচরণ পাল্টে যেতে পারেএমনকি অনাকাঙ্ক্ষিত বিদেশি জীবাণু বা অণুজীবও সেখানে নিয়ে আসতে পারে।

যেহেতু মেরু অঞ্চলে পর্যটন বাড়ছেআর্কটিক কাউন্সিলঅ্যাসোসিয়েশন অব আর্কটিক এক্সপেডিশন ক্রুজ অপারেটর্স (এইসিও) এবং ভিজিট গ্রিনল্যান্ডের মতো সংস্থা অর্থনৈতিক লাভ ও পরিবেশগত দায়বদ্ধতার মধ্যে ভারসাম্য রাখার প্রয়োজনীয়তার কথা জোর দিয়ে বলছে। পোলার অঞ্চলের আকর্ষণ অস্বীকার করা কঠিন: প্রায় চাঁদসদৃশ প্রাকৃতিক দৃশ্যবরফময় ঠান্ডা দিনে উজ্জ্বল নীল আকাশটাটকা বরফে পা ফেলে হাঁটার রোমাঞ্চআর এসব অঞ্চলের অনন্য বন্যপ্রাণী।

ডরহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী ও জলবায়ু বিষয়ক অলাভজনক সংস্থা আর্কটিক বেসক্যাম্পের বিজ্ঞানী ইন-রেসিডেন্স জেমস গ্রেসিয়ান বহু বছর ধরে মেরু অঞ্চলের বন্যপ্রাণী নিয়ে কাজ করছেন। গত বছর তিনি অ্যান্টার্কটিকায় স্নো পেট্রেল পাখি নিয়ে গবেষণা করছিলেনসরাসরি পাখিগুলো নয়বরং তাদের উগরে দেওয়া খাবার নিয়ে।

স্নো পেট্রেলের পাকস্থলীর তেল জমে শক্ত তাল হয়ে থাকেল্যাব বিশ্লেষণে সেসব থেকে বোঝা যায় কীভাবে তাদের খাদ্যাভ্যাস বদলেছেএবং এর মাধ্যমে স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রের পরিবর্তন সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায়। গ্রেসিয়ান বললেন, “পরিবেশ থেকে বা প্রাণী থেকে সংগৃহীত নমুনা বিশ্লেষণ করে আমরা অতীত সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারি। যেমনমৃত তিমির বেলিন প্লেট’ পরীক্ষা করলে সেখানকার রাসায়নিক চিহ্ন বলে দেবে পরিবেশগত অবস্থা অথবা প্রাণীটি কী খাচ্ছিল।

তিনি নিজেও মেরু অঞ্চলে প্রায়ই যানবুঝতে পারেন সেখানকার পরিবেশের আকর্ষণ ও ঝুঁকিআর দেখিয়েছেন যে কিছু সিদ্ধান্ত আমাদের ক্ষতি কমিয়ে আনতে পারে। পোলার পর্যটন বন্ধ হওয়ার লক্ষণ নেইকিন্তু গ্রেসিয়ানের আশামানুষ এসব অঞ্চলে ভ্রমণের সময় সচেতন পছন্দ করলে পরিবেশের ক্ষতি কিছুটা হলেও রোধ করা সম্ভব। তার কিছু পরামর্শ নিচে তুলে ধরা হলো।

মেরু অঞ্চলে যাওয়ার পথে পরিবহনের পছন্দ গ্রেসিয়ান বললেন, “ক্রুজ জাহাজের সমস্যা হলোপুরো হোটেল আর অন্যান্য সুবিধাসহ সবকিছু আপনার সঙ্গেই যাচ্ছে। কখনও কখনও স্থানীয় শহরগুলোর বাসিন্দারা অনেক পর্যটকের হঠাৎ আগমনে বিরক্ত হয়কারণ তারা জাহাজেই খাবার খায়ফলে স্থানীয় ক্যাফে বা রেস্তোরাঁয় তেমন যায় না। অন্যদিকেযদি আপনি উড়োজাহাজে যানতাহলে স্থানীয় হোটেলে থাকবেনস্থানীয় ট্যুর অপারেটর ব্যবহার করবেনফলে সেখানকার মানুষ অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হবে। কিন্তু এর সঙ্গে উড়োজাহাজের বিশাল কার্বন নিঃসরণের বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে।

অনেকেই মনে করেন জাহাজের মাধ্যমে ভ্রমণ উড়োজাহাজের চেয়ে পরিবেশবান্ধবকিন্তু বৈশ্বিক পরিসংখ্যান বলছে ভিন্ন কথা। বিমান চলাচল পুরো বিশ্বের ২.৫% কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের জন্য দায়ীআর জাহাজ ৩%যদিও এর বেশিরভাগই পণ্যবাহী জাহাজ থেকে আসে। পাশাপাশি জাহাজের শব্দদূষণ তিমির ন্যাভিগেশন বা ইকোলোকেশন ক্ষমতাকে বিঘ্নিত করতে পারে।

গ্রেসিয়ান বললেন, “একটি ভয়াবহ অ্যানিমেশন দেখেছিলামযেখানে নীল তিমি মাইগ্রেশনের সময় জাহাজ চলাচলের পথে পড়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল কোনো পিনবল মেশিনে আটকে গেছেও পাশ থেকে শব্দ আসছেএই পাশ থেকে শব্দ আসছেতিমিটি কী করবে বুঝতে পারছে না।

তাহলে উপায় কী? “ট্রেন ব্যবহার করলে বিমানযাত্রার তুলনায় প্রায় ৯০% বা ৯৫% কার্বন নিঃসরণ কম হয়তাই জলবায়ুর দিক থেকে দেখলে নরওয়ের ফিয়র্ডে যেতে ট্রেন ভালো বিকল্প।” বেশ সময় লাগলেও ইউরোপের কিছু অঞ্চল থেকে ট্রেনেও আর্কটিক অঞ্চলে যাওয়া সম্ভব। উদাহরণস্বরূপস্টকহোম থেকে নরওয়ের নারভিকট্রনহেইম থেকে বোদোআর হেলসিঙ্কি থেকে ফিনল্যান্ডের উত্তরের রোভানিয়েমি পর্যন্ত ট্রেন চলে।

অথবা আপনার কাছে পর্যাপ্ত অর্থ থাকলে ছোট পালতোলা নৌকা ভাড়া করে যেতে পারেন। ফকল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জে এমন অনেকে আছেন যারা নিয়মিত পালতোলা নৌকায় অ্যান্টার্কটিকায় যান,” বললেন গ্রেসিয়ান। খুব দামি মনে হতে পারেকিন্তু বিলাসবহুল ক্রুজের কেবিনের খরচের সঙ্গে তুলনা করলে খুব একটা বেশি পড়বে না।

ছবির জন্য প্রাণীদের বিরক্ত করবেন না মেরু অঞ্চলের বন্যপ্রাণী দেখার লোভ অস্বীকার করা কঠিন। কিন্তু সেই প্রাণীদের যাতে বিরক্ত না করিসেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

গ্রেসিয়ানের পরামর্শ, “এখানে আপনি অতিথিসেই শ্রদ্ধাবোধ নিয়ে ঘুরতে হবে। ছবি তোলার লোভে বা সেলফি পেতে প্রাণীদের কাছে চলে যাওয়া ঠিক না। তারা মানুষ দেখায় অভ্যস্ত নয়দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে। তাদের তাড়া করা যাবে না।

ধৈর্য ধরার পরামর্শ দেন তিনি। চুপচাপ বসে থাকলে অনেক প্রাণীই কৌতূহল নিয়ে কাছে চলে আসে। আমি ফকল্যান্ড দ্বীপে পেঙ্গুইন দেখেছিআর তারা ৩-৪ মিটারের মধ্যেও চলে এসেছিল। আপনারা চুপচাপ থাকলে তারাই কাছে চলে আসবে।” স্থানীয় গাইডদের জ্ঞানও গুরুত্বপূর্ণ। বড় প্রাণীর দিকে না তাকিয়ে কখনো কখনো নিচের দিকে চোখ রাখলে প্রাণীদের পদচিহ্ন বা মল দেখে তাদের উপস্থিতি বা গতিবিধি সম্পর্কে জানতে পারবেন।

স্থানীয়ভাবে সীলের মাংস খাওয়া এটি কিছুটা রক্ষণশীল বা কঠিন শোনাতে পারেতবে যদি আপনি স্থলভাগে অবস্থান করেন (ক্রুজ নয়)তাহলে স্থানীয় খাবারযেমন সীলের মাংসখাওয়ার পিছনে যৌক্তিক কারণ আছে। দূরবর্তী এই অঞ্চলে খাবার আমদানি করতে অনেক কার্বন নিঃসরণ হয়। বিশ্বজুড়ে খাদ্য উত্পাদনে তিন বিলিয়ন টন কার্বন নিঃসরণ হয় annually

গ্রিনল্যান্ড বা কানাডার কিছু অঞ্চলে ইনুইট জনগোষ্ঠী এখনো নিজেদের টিকে থাকার জন্য শিকার করে। কানাডা ও গ্রিনল্যান্ডের আইনে তাদের এই শিকারের অধিকার স্বীকৃত এবং এটি নিয়ন্ত্রিত হয় যাতে মাত্রাতিরিক্ত শিকার না হয়। গ্রেসিয়ান বললেন, “সেখানে রিং সীল বা হার্প সীলের মাংস খাওয়া আমদানি করা মাংস বা অন্য কিছু ফসলের তুলনায় অনেক কম কার্বন নিঃসরণ ঘটায়।

নিশ্চিতভাবেই সীলের মাংস খাওয়া না-খাওয়া আপনার ব্যক্তিগত পছন্দতবে মনে রাখতে হবে যে গ্রিনল্যান্ডের মতো ইনুইট-অধ্যুষিত অঞ্চলে স্থানীয় মাংসই সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব বিকল্প। একটি গবেষণায় দেখা গেছেগ্রিনল্যান্ডে আমদানি করা শূকর বা মুরগির মাংসের তুলনায় সীলের মাংসের কার্বন নিঃসরণ অনেক কম।

প্যাকিংয়ের আগে চিন্তা করুন যারা সত্যিকারের অভিযাত্রী হিসেবে শিবিরে থাকবেন বা দুর্গম পথে হাঁটবেনতাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ঠিকমতো নিতে হবে। শুধু মাত্র বেস লেয়ারজুতার স্পাইক বা ওয়াটারপ্রুফ পোশাকই নয়আরও কিছু দরকারি জিনিস ভুলে গেলে চলবে না।

গ্রেসিয়ান বললেন, “যদি খুব ঠান্ডা জায়গায় বা দুর্গম অঞ্চলে শিবিরে থাকতে যানতাহলে সেখান থেকেই অনেক সরঞ্জাম ভাড়া নিতে পারেন। এতে আপনার লাগেজও হালকা হবে এবং স্থানীয় ব্যবসাও উপকৃত হবে।

তিনি আরও বলেন, “ঠান্ডা ও শুষ্ক পরিবেশে নাকে শুষ্কতা ও রক্তক্ষরণ হতে পারেতাই নাকের স্প্রে সঙ্গে রাখুন। আর সূর্যের তেজ অনেক বেশি হতে পারেতাই ৫০ এসপিএফ সানস্ক্রিন নিতে ভুলবেন না। যদি অনেক দিন শিবিরে বা দুর্গম জায়গায় থাকেনসঙ্গে আরামদায়ক কিছু রাখুন। আমি নিজে কফি খুব পছন্দ করিতাই শেষবার আমি একটি মোকা পট আর ফ্রেঞ্চ প্রেস নিয়েছিলাম।

প্রকৃতির ছন্দের সঙ্গে মিলিয়ে চলুন গ্রেসিয়ান মজা করে বললেন যে আমি যখন গ্রিনল্যান্ডে গিয়েছিলামতখন একটাও তিমি দেখতে পাইনি। কারণ আমি গিয়েছিলাম অক্টোবর মাসেযখন শীত শুরু হয় আর হাম্ব্যাক তিমি ক্যারিবিয়ানের দিকে রওনা হয়।

তিনি বললেন, “আপনি যদি নির্দিষ্ট কোনো প্রাণী বা দৃশ্য দেখতে চানতাহলে তাদের অভিবাসনকাল বা মাইগ্রেশন প্যাটার্ন জেনে নিন। কোনো প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার ইচ্ছে থাকলে জেনে নিন ঠিক কখন সেটি ঘটে। যেমননিউফাউন্ডল্যান্ডে অনেকে মে-জুন মাসে যায়তখন বরফখণ্ডের পেছনে সবুজ ঘাস আর ফুলের সমারোহ দেখা যায়। আপনি যদি সেটা দেখতে চানওই নির্দিষ্ট সময়ে যেতে হবে।

তার এই কথাগুলো মূলত একটা বড় সত্যকে মনে করিয়ে দেয়: পোলার অঞ্চলে ভ্রমণ পরিকল্পনা করা উচিত সেসব এলাকার প্রাকৃতিক অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেশুধু সামাজিক মাধ্যমে আকর্ষণীয় ছবি দেওয়ার কথা ভেবে নয়।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024